সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ইংল্যান্ডের মিডিয়া ম্যানেজার বললেন, “আমাদের সঙ্গে আছেন জস বাটলার, ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক….।” কক্ষের এক প্রান্ত থেকে তখন চিৎকার করে উঠলেন একজন। চমকে সেদিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই হেসে ফেললেন বাটলার। চিৎকার করেছেন আসলে স্যাম কারান! ফাইনাল শেষে হয়েছে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। ইংলিশরা তখন বিশ্বকাপ জয়ের ঘোরে বুঁদ হয়ে আছেন।
এই কারান চোটের কারণে লম্বা সময় বাইরে থেকে মাত্র কিছুদিন আগে ফিরেছেন দলে। অথচ এই বিশ্বকাপে তিনি ফাইনালের সেরা, আসরের সেরা। এই বাটলার নেতৃত্ব পেয়েছেন, সাড়ে চার মাস হয়েছে মোটে। এখন তিনি বিশ্বজয়ী অধিনায়ক।
চোটের কারণে এই দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আসতেই পারেননি মূল স্ট্রাইক বোলার জফ্রা আর্চার ও প্রথম পছন্দের ওপেনার জনি বেয়ারস্টো। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে খেলতে পারেননি বোলিং আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র মার্ক উড, নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান দাভিদ মালান।
এই দলে খেলেছেন ফিল সল্ট, হ্যারি ব্রুকের মতো নবীনরা। এমনকি লিয়াম লিভিংস্টোনেরও তো ৩০ ম্যাচ হয়নি।
তবু এই দল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কারণ, সাদা বলের ক্রিকেটে ইংলিশ বিপ্লবের যে প্রতিচিত্র, ২০১৫ পরবর্তী সময়ের যে রেনেসাঁ, এই দল সেটিকে ধারণ করে মনে-প্রাণে। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে ওই আগ্রাসন, ওই মানসিকতা, এই ধরন ইংলিশ ক্রিকেটের সহজাত চরিত্র হয়ে গেছে। জিনের অংশ হয়ে গেছে।
বেন স্টোকস টেস্ট অধিনায়ক হওয়ার পর লাল বলের ক্রিকেটেও এই দাপটের আভাস মিলতে শুরু করেছে। তবে সেটাকে ‘সফল’ বলতে কিংবা প্রতিষ্ঠিত করতে সময় লাগবে আরও। কিন্তু সাদা বলের ক্রিকেটে কোনো সংশয় নেই।
এই ধরনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাও আসবে অনেক সময়। অধিনায়কত্বে পরিবর্তন আসবে। ক্রিকেটার যাবে-আসবে। তাদের ভূমিকায় বদল আসবে। তবে ধরনটা রয়ে যাবে। সেটিই আরও নিশ্চিত হয়ে গেল এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
সাড়ে সাত বছর আগে যে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার পর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে ফেলেছে তারা, সেই অস্ট্রেলিয়াতেই এবার তার পা রেখেছে ইতিহাসের চূড়ায়। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, কোনো দলকে নিয়ে একসঙ্গে আগে কখনও এটি বলা যায়নি। ইংল্যান্ড এটি সম্ভব করেছে তাদের ভয়ডরহীন ব্র্যান্ডের ক্রিকেট দিয়ে।
ফাইনাল শেষে বাটলারের কণ্ঠে অসঙ্কোচ উচ্চারণ, এই পথ ধরেই ছুটে যাবেন তারা দৃপ্ত পায়ে।
“গত কয়েক বছরে আমাদের দল নিয়ে লোকের ভাবনা অনেক বদলেছে বলেই মনে করি। আমরা অবশ্যই নিরাপদ পথ বেছে নেইনি এবং এই পথে হেঁটেই আমরা ফল পেয়েছি। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করেছি নতুন সীমানায় পা রাখতে, বাকি দুনিয়ার চেয়ে এগিয়ে থাকতে এবং সবার চেয়ে বেশি সাহসী হতে।”
“এই পথে যা আসবে, আমরা আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। আমরা জানি, চলার এই পথে আমরা হোঁচটও খাব। তবে আমরা অবশ্যই এই ধরনটায় আস্থা রেখে যাব। এটা আমাদের ভালো ফল দিয়েছে এবং বড় ম্যাচেও এটির ওপরই আমাদের ভরসা থাকবে।”
২০১৫ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর সাদা বলের ক্রিকেটে টানা পাঁচটি আইসিসি টুর্নামেন্টের দুটিতে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন, একটিতে রানার্স আপ, অন্য দুটিতে সেমি-ফাইনালিস্ট। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ও পেশাদারীত্বের এই যুগে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সৌজন্যে পরস্পরকে খুব ভালোভাবে চেনার এই সময়ে ইংল্যান্ডের এই ধারাবাহিকতা অবিশ্বাস্য। তাদের খেলার ধরনে যে পরিমাণ ঝুঁকি থাকে, সেদিক থেকে ভাবলেও তাদের এই ধারাবাহিকতা চমকপ্রদ।
১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত টানা তিন বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়ার প্রসঙ্গ এখানে চলে আসে। ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা কোনো ম্যাচ না হেরেই। ওই সময় তারা টেস্ট ক্রিকেটেও রেকর্ড গড়া ধারাবাহিকতা ও দাপট দেখায়। তবে স্রেফ ওয়ানডেতেও তাদের সাফল্য রূপকথা হয়ে আছে।
বিশ্বকাপই শুধু নয়, ২০০৬ ও ২০০৯ সালে টানা দুইবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তারা প্রতিষ্ঠিত করে অবিসংবাদিতভাবে। সেখানেই এখন প্রবলভাবে বিচেনায় চলে আসছে ইংল্যান্ড।
অস্ট্রেলিয়ার সেই দলের সাফল্য ছিল শুধু ওয়ানডে সংস্করণেই। তখনও পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি সেভাবে জেঁকে বসেনি। অস্ট্রেলিয়া এই সংস্করণের বিশ্বকাপে সাফল্যও পায়নি। ২০১০ বিশ্বকাপে যদিও তারা ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে।
অস্ট্রেলিয়ার মতো বছরের পর বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে হলে ইংল্যান্ডের এই দাপট অব্যাহত রাখতে হবে আরও কয়েক বছর। তবে দুই সংস্করণের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বাড়তি পয়েন্টও তারা দাবি করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে তাই প্রশ্নটাও উঠে গেল, গত কয়েক বছরের এই ইংল্যান্ড কি সর্বকালের সেরা সীমিত ওভারের দল?
বাটলার সরাসরি সমাধানের বিতর্কে গেলেন না স্বাভাবিকভাবেই। তবে নিজেদের দিকটা তুলে ধরে তিনি শোনালেন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথাও।
“এটার বিচার তো আমরা করতে পারি না। তবে আমরা অবশ্যই তা উপভোগ করতে পারি! সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের যে পরিবর্তন ও এই ভ্রমণ, এটা নিয়ে অনেক চর্চাই হয়েছে। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পর এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাফল্য প্রমাণ করে দেয়, যে দূরদৃষ্টি নিয়ে এই বদলের সূচনা যারা করেছিলেন, তারা দেখতে পাচ্ছিলেন, সাদা বলের ক্রিকেটে আমরা কোন উচ্চতায় যেতে পারি এবং এখান থেকে আরও এগিয়ে না যাওয়ার কোনো কারণই নেই।”
বাটলারের শেষ কথাটিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ, আরও উঁচুতে যাওয়া। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ওপরে তো আর কিছু নেই। কিন্তু শিরোপা জয়কে অভ্যাস বানিয়ে ফেলা। আগামী বছরই ওয়ানডে বিশ্বকাপে শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে নামতে হবে তাদের। পরের বছর আবার টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসর। ইংলিশদের সামনে চ্যালেঞ্জ, অস্ট্রেলিয়ার ওই দলটির মতোই টুর্নামেন্টের পর টুর্নামেন্ট জয় করা, দাপট দেখিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখা, বড় আসর ছাড়া অন্যান্য সিরিজ-টুর্নামেন্টগুলোয় অন্যদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়া।
বাটলারের ইংল্যান্ড যদি তা পারে, তাহলে সর্বকালের সেরা সীমিত ওভারের দল কোনটি, তা নিয়ে সংশয়ও থাকবে না।