পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে আম্পায়ারিংকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পর ট্রফি নিয়ে উল্লাসরত বাংলাদেশ দলের দিকেও তীর্যক মন্তব্য ছুড়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর।
Published : 22 Jul 2023, 08:54 PM
ম্যাচ শেষে ততক্ষণে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও শেষ। বাংলাদেশ দল উল্লাস করছিল ট্রফি ও পতাকা নিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে হারমানপ্রিত কৌর ছুড়ে দিলেন মন্তব্য, এই ট্রফি বাংলাদেশ জেতেনি, আম্পায়াররা জিতিয়েছে! গ্যালারির দিকে ঘুরেও ভারতীয় অধিনায়ক অনেকটা কটাক্ষ করেই যেন হাত নাড়লেন, ‘থামস আপ’ দেখালেন। বাংলাদেশ দলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ফটোসেশনে যেন আম্পায়ারদেরও সঙ্গে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এসব দেখে অনেকটাই হতভম্ব। অধিনায়ক নিগার সুলতানা অনেক রেগেমেগে দলকে নিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।
কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ শেষে এক দলের অধিনায়কের আরেক দলের সামনে গিয়ে এমন মন্তব্য বিরল বললেও কম বলা হয়। বিস্ময়কর সব কথা অবশ্য এর একটু আগে আনুষ্ঠানিক আয়োজনেও বলেছেন হারমানপ্রিত। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ ‘টাই’ হওয়ার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি এরকম ধুয়ে দেন আম্পায়ারিংকে।
আম্পায়ারিংয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে টুকটাক মন্তব্য করার ঘটনা ক্রিকেটে কম নেই। কিন্তু হারমানপ্রিতের মতো এত ঢালাওভাবে আম্পায়ারিংকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর নজির আধুনিক ক্রিকেটে নিশ্চিতভাবেই খুব একটা নেই।
ম্যাচ চলার সময়ও হারমানপ্রিত যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাতে অবশ্য বড় জরিমানা কিংবা শাস্তি তিনি পেতে যাচ্ছেন আইসিসির আচরণবিধি অনুযায়ীই। আম্পায়ারিং ঘিরে তার এত ক্ষোভের শুরু নিজের আউটকে ঘিরেই।
ভারতের রান তাড়ার ৩৪তম ওভারে নাহিদা আক্তারের বলে হারমানপ্রিতকে আউট দেন আম্পায়ার তানভির আহমেদ। বাঁহাতি স্পিনারের ফুল লেংথ বল সুইপ করার চেষ্টায় ঠিকমতো খেলতে পারেননি হারমানপ্রিত। বল তার প্যাডে লাগা মাত্র উদযাপন করতে শুরু করে দেন নাহিদা। পরে বলটি স্লিপে মুঠোয় জমান ফাহিমা খাতুন। আম্পায়ার দেন ক্যাচ আউট।
আম্পায়ারের আঙুল উঠতে দেখেই যেন ফুঁসে ওঠেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। শুরুতে এক হাত দিয়ে থাবা মারেন আরেক হাতে ধরে রাখা ব্যাটে। আম্পায়ারের দিকে তাকান আগুনে দৃষ্টিতে। এরপর ব্যাট দিয়ে স্টাম্পে এতটাই জোরে মারেন যে, একটি স্টাম্প উড়ে গিয়ে পড়ে অনেকটা দূরে। ক্রিজ ছেড়ে যাওয়ার সময় আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে থাকেন টানা। এরপর ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে গ্যালারির দর্শকদের উদ্দেশে দেখান ‘থামস আপ।’
টিভি রিপ্লে থেকে বোঝা যায়নি, আদৌতেই বল তার ব্যাটে বা গ্লাভসে লেগেছে কি না। এই সিরিজে ডিআরএস নেই। তবে ব্যাটে বা গ্লাভসে যদি বল স্পর্শ নাও করে, এলবিডব্লিউ একরকম নিশ্চিতভাবেই ছিলেন তিনি।
ম্যাচের শুরুর দিকে একটি এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে অসন্তোষ প্রকাশ করেন ভারতীয় ব্যাটার ইয়াস্তিকা ভাটিয়া। টিভি রিপ্লে দেখে সেই সিদ্ধান্তও সঠিক বলেই মনে হয়েছে।
শেষ ব্যাটার মেঘনা সিংয়ের যে আউট দিয়ে ম্যাচ ‘টাই’ হয়, সেটি নিয়েও মাঠে আপত্তি জানাতে দেখা যায় উইকেটে থাকা জেমিমা রদ্রিগেস ও মেঘনাকে। টিভি রিপ্লে দেখে এই ‘কট বিহাইন্ড’ সিদ্ধান্ত নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বল কিপারের গ্লাভসে যাওয়ার পর নিজ থেকেই হাঁটা দিয়েছিলেন মেঘনা। আম্পায়ার আঙুল তোলেন একটু পর। নন-স্ট্রাইকে থাকা জেমিমা আপত্তি জানানোর পর মেঘনাও থমকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
সবকিছুর যোগফল ম্যাচ শেষে হারমানপ্রিতের বিস্ফোরণ। পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে দুই দফায় ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি দুবারই নিজ থেকে টেনে আনেন আম্পায়ারিং প্রসঙ্গ।
“এই ম্যাচ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এমনকি ক্রিকেটের বাইরেও, যে ধরনের আম্পায়ারিং ওখানে হচ্ছিল, আমরা খুবই বিস্মিত হয়েছি। পরে আমরা যখনই বাংলাদেশে আসব, নিশ্চিত করব যেন এই ধরনের আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
“তারা (বাংলাদেশ) সত্যিই ভালো ব্যাট করেছে, এটা নিয়ে সংশয় নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করেছে। সিঙ্গেলগুলো নিয়েছে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা কিছু রান বিলিয়ে দিয়েছি। তবে ব্যাটিংয়ে আমরা খুব ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে ছিলাম। কিন্তু আগে যেমনটি বললাম, আম্পায়ারিং ছিল ‘প্যাথেটিক’ এবং আম্পায়ারদের কিছু সিদ্ধান্তে আমরা খুবই হতাশ।”
ভারতীয় অধিনায়কের ক্ষোভ শুধু আম্পায়ারিং নিয়েই ছিল না। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের অতিথি নিয়েও তীর্যক কথা উঠে আসে তার কণ্ঠে।
“ভালো ম্যাচ হয়েছে, অনেক কিছু শিখেছি এবং সবশেষে ভারতের হাই কমিশন (হাই কমিশনার) এখানে আছেন এবং আশা করেছিলাম, তাকেও আপনারা এখানে আমন্ত্রণ জানাবেন। তবে সমস্যা নেই।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৪ বছর ও ২৮৪ ম্যাচের অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটারের কথায় সেখানে উপস্থিত অনেকের চোখেমুখেই দেখা যায় বিস্ময়।
পরে তো বাংলাদেশ দলকে উদ্দেশ্য করে আবার সেই বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ অধিনায়ক নিগার সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে এসে শুরুতে এই বিতর্কের গভীরে যেতে চাইলেন না।
“আমি তো ম্যাচ খেলেছি, ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি। আমার কাছে মনে হয়, এটাই ভালো। আমরা আম্পায়ারিং নিয়ে চিন্তা করিনি, উইকেট নিয়ে চিন্তা করিনি, ম্যাচ খেলেছি। আমার কাছে মনে হয়, প্রতিটি ক্রিকেটার শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাকি ওরা কী বলছে না বলছে, এটা আমি চিন্তা করছি না।”
“ও যেটা করেছে, সেটা ওরই। সেটা আমাদের কোনো কিছু নয়। তবে আমি বলব, ক্রিকেটার হিসেবে সে আরেকটু ভালোভাবে কথা বলতে পারত। তবে ও করেছে, ওর ব্যাপার। আমার কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না।”
তবে পুরস্কার বিতরণী শেষে বাংলাদেশ দলকে উদ্দেশ্য করে হারমানপ্রিতের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্নে কিছুটা খোলাসা করলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“কিছু কথা…সবসময় তো সবকিছু বলা যায় না। যা হয়েছে, আমার কাছে মনে হয়নি যে আমার দল নিয়ে ওখানে থাকব। তো আমি চলে এসেছি।”
“কিছু কথা ছিল যে আমার মনে হয়নি ওখানে থাকা উচিত হবে দল নিয়ে। কারণ, ক্রিকেট খুবই সম্মানজনক একটি জায়গা। শৃঙ্খলার জায়গা। জেন্টলমেন’স গেম। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওই পরিবেশ ছিল না। তাই দল নিয়ে চলে এসেছি।”
এই ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়ে আপত্তির জায়গাও খুব একটা দেখেন না নিগার।
“আউট না হলে তো আম্পায়ার আউট দিতেন না। সেরা আম্পায়ারদের মধ্য থেকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা (ছেলেদের) আন্তর্জাতিক সিরিজেও আম্পায়ারিং করেন। আমরা তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছি। আমরা যে আউট হলাম, আমরা তাহলে অমন করলাম না কেন? আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, আমাদের এটা মানা উচিত।”
“আমার কাছে মনে হয়েছে, আম্পায়ারিং ভালো ছিল। ওদের যারা ক্যাচ আউট হয়েছে, রান আউট হয়েছে, সেসব কি ছিল? কি বলবেন তারা? সেগুলো তো স্পষ্ট।”
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেননি হারমানপ্রিত। ম্যাচ সেরা হার্লিন দেওলের সঙ্গে দলের প্রতিনিধি হয়ে আসেন সহ-অধিনায়ক স্মৃতি মান্ধানা। একের পর এক প্রশ্ন তার দিকে ছুটে গেল হারমানপ্রিতের কাণ্ড ও মন্তব্য নিয়ে। স্মৃতি চেষ্টা করলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে।
“মাঠে যা হয়েছে, তা খেলারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এসব অতীতেও অনেক দেখেছি, ছেলেদের ক্রিকেটে দেখে থাকি। ভারতের হয়ে খেলার সময় সবাই জিততে চায় এবং মুহূর্তের উত্তেজনায় এই ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। সে (হারমানপ্রিত) সিদ্ধান্ত নিয়ে খুশি ছিল না, তার মনে হয়েছে সে আউট ছিল না। এজন্য এটা হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এটা স্রেফ মুহূর্তের উত্তেজনা, এর বেশি কিছু নয়।”
পুরস্কার বিতরণী আয়োজন শেষে বাংলাদেশ দলের দিকে হারমানপ্রিত কিছু বলেছেন কি না, তা ঠিক নিশ্চিত নন বলে দাবি করলেন স্মৃতি। আম্পায়ারদের নিয়ে যে ভারতীয় অধিনায়ক কিছু বলেছেন, তা অবশ্য স্বীকার করলেন সহ-অধিনায়ক।
হারমানপ্রিতের আচরণ গ্রহণযোগ্য কি না, এই প্রশ্নে তার পাশেই দাঁড়ালেন স্মৃতি।
“যখন কেউ মরিয়া হয়ে জিততে চায়… খেলার স্পিরিট এবং এসব নিয়ে অবশ্যই আমরা পরে কথা বলতে পারি। তবে হারমানকে যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে জানি এবং জানি যে সে কতটা তীব্রভাবে ভারতের জয় চায়… খেলার স্পিরিটের দিক থেকে হয়তো এটা নয় (গ্রহণযোগ্য), তবে জয়টা তীব্রভাবে চাইলে অনেক সময় এরকম হয়ে থাকে।”