Published : 28 Jan 2024, 08:29 PM
সপ্তাহখানেক আগেও বিশ্ব ক্রিকেটে অপরিচিত এক নাম ছিলেন জশ ব্রাউন। বিগ ব্যাশের চ্যালেঞ্জারে গত সোমবার ১০ চার ও ১২টি ছক্কায় খেলা ১৪০ রানের ইনিংস বদলে দিয়েছে সব কিছু। পরে ফাইনালেও ৫৩ রানের ইনিংস খেলে নিজেকে টি-টোয়েন্টির ‘হট কেকে’ পরিণত করেছেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান। মজার ব্যাপার হলো, বিস্ফোরক ওই ইনিংস তিনি খেলেছেন নিজের হাতে বানানো ব্যাট দিয়ে।
বিগ ব্যাশ মাতিয়ে তিনি এবার এসেছেন বিপিএলে। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে টুর্নামেন্টের বাকি অংশে খেলবেন ৩০ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। রোববার দলের সঙ্গে প্রথম অনুশীলন শেষে টিম হোটেলে ফিরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিগ ব্যাশের রেকর্ড গড়া ইনিংস, নিজের বানানো ব্যাট দিয়ে খেলার আনন্দ, ব্যাট কারিগর হিসেবে এগিয়ে যাওয়া, সামনের দিনের ভাবনাসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন ব্রাউন।
আপনার ওই ইনিংস দিয়েই শুরু করতে চাই। রূপকথার মতো ব্যাটিং। রেকর্ডের পাতায় ঝড় তোলা ১৪০ রান। সেদিনের কথাই বলুন।
ব্রাউন: ওই ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সময় আমার চিন্তা একদম পরিষ্কার ছিল। শুধু একটি পরিকল্পনাই ছিল। আমার রান কত হলো তা দেখিওনি। আমি শুধু বল দেখে সব দিকে শট খেলছিলাম। বড় বড় ছক্কা মারতে আমার ভালো লাগে। এই কাজে সবসময়ই পারদর্শী। মাটিতে নামিয়ে খেলতে গিয়ে অনেকবার ভুগতে হয়েছে আমাকে। এর চেয়ে মাঠে চারপাশে উড়িয়ে মারাই আমার কাছে সহজ লাগে।
সেদিনের ১৪০ রানের ওই ইনিংসে সব কিছুই আমার পক্ষে কাজ করেছে। সাধারণত কী হয়? বল দেখে সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয়। আমারও সেদিন তা-ই হয়েছে। বল দেখেছি এবং মেরে দিয়েছি।
আপনার জীবনের গত এক-দেড় সপ্তাহের কথা যদি বলি… বিগ ব্যাশের চ্যালেঞ্জারে ১৪০ রান, ফাইনালেও ৫৩ রান। ক্রিকেট বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে আপনি। প্রথমবার বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সুযোগ পেলেন। সময়টা কীভাবে দেখছেন?
ব্রাউন: পাগলাটে! পুরোপুরি পাগলাটে সপ্তাহ। বিগ ব্যাশের চ্যালেঞ্জার ম্যাচের পর থেকে আমার জীবন সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। সব কিছু খুব দ্রুত হচ্ছে। আমার ম্যানেজার গত মঙ্গলবার আমাকে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ব্যাপারে বলে। তখন বলেছিলাম যে, আমি এখন ফাইনাল ম্যাচে মনোযোগ দিতে চাই। তারপর দেখা যাবে। এরপর এই তো, আমি এখানে।
একটি ইনিংস জীবন পুরোপুরি বদলে দিলো...
ব্রাউন: সত্যিই! ফুল টাইম চাকরিজীবী থেকে এখন ফুল টাইম ক্রিকেটার। সময়টা সত্যিই অন্যরকম।
চাকরি বলতে কি ক্রিকেট ব্যাট বানানোর কথা বলছেন?
ব্রাউন: হ্যাঁ। আমি আগে ক্রিকেট ব্যাট বানাতাম। কুপার ক্রিকেটের হয়ে ব্যাট বানানোর কাজ করতাম। এটিই আমার ফুল টাইম জব। ক্রিকেটের আগে এটিই করতাম। নিজের ব্যাটও আমি নিজে বানাই। এতে আমার সব ধরনের শট খেলা সহজ হয় (হাসি)।
ক্রিকেটে আপনার শুরুটা তুলনামূলক বেশি বয়সে। শুরুর দিনগুলোর কথা যদি বলতেন।
ব্রাউন: আমি ২৩-২৪ বছর বয়সে প্রথম ক্রিকেট খেলা শুরু করি। তখন আমার ওজন ছিল ১৩০ কেজির বেশি। জিম করে প্রায় ৩০ কেজি ওজন কমিয়েছি। এরপর গ্রেড ক্রিকেট খেলে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকি। তৃতীয় গ্রেড থেকে ১৮ মাসের মধ্যে আমি দ্বিতীয় একাদশে জায়গা করে নিই।
ড্যারেন লিম্যান সম্ভবত প্রথম আপনার প্রতিভা ধরতে পারেন...
ব্রাউন: হ্যাঁ! বিগ ব্যাশে আমার প্রথম মৌসুমের আগের বছরের ঘটনা সেটি। গ্রেড ক্রিকেট থেকে কিছু দিন বিরতি নিয়ে ডারউইনে কিছু হালকা কাজ করি। তারপর ব্রিজবেনে ফিরে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলি।
সেখানে মোট ৮টি ম্যাচ খেলেছিলাম। প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে ৬০ রানের আশপাশে করি। তারপর দ্বিতীয়টিতে মনে হয় ৮-৯ রান করি। এরপর ১৪৭ রানের অপরাজিত ইনিংস। আবার আরেকটি ৬০ রানের ইনিংস খেলি। তারপর রেকর্ড ভেঙে দেই। ১৭ ছক্কায় ৫৯ বলে করি ১৫৯ রান।
ওই টুর্নামেন্টের এই পারফরম্যান্সগুলো বিগ ব্যাশে ব্রিজবেন হিটে সুযোগ পাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বলেছেন, আপনি তার নতুন পছন্দের ক্রিকেটার।
ব্রাউন: (হাসি) অনেক আগে থেকেই তিনি আমার পছন্দের ক্রিকেটার। তাই এটি আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। তার সঙ্গে এখন কথাও হয়। দারুণ অনুভূতি।
বিগ ব্যাশের পর থেকে আপনাকে ঘিরে সব কিছুই বদলে গেছে। এখন আপনার ভালো-খারাপ সব কিছুই আগের চেয়ে বেশি আলোচিত হয়, সামনেও হবে। এই সবকিছুর পরিবর্তন কীভাবে দেখেন?
ব্রাউন: আমি শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছি। নিজের ওপর বাড়তি চাপ দিতে চাই না। এটি বড় বিষয়। আমি জানি, সবাই সবসময় রান করতে চায়। কেউ ব্যর্থ হতে চায় না। আমি সামনের দিনগুলোতেও নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে খেলে যেতে চাই। আমি যা করেছি, তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। নিজের পরিকল্পনায় স্থির থেকে আমি রান করে যেতে চাই।
বিপিএলে এসে আজই প্রথম অনুশীলন করলেন। কেমন লাগছে?
ব্রাউন: অনুশীলন খুব ভালো হয়েছে। উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন উইকেট। বলের বাউন্স অতটা নেই। অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছি।
আপনি তো আইএলটি-টোয়েন্টি থেকেও প্রস্তাব পেয়েছিলেন। বিপিএলকে বেছে নেওয়ার পেছনে ভাবনা কী ছিল?
ব্রাউন: আমার মনে হয়, এখানে বেশি দিন ধরে খেলতে পারব। সেখানে (আইএলটি২০) সম্ভবত দুই সপ্তাহের মতো খেলার সুযোগ পেতাম। এখানে তো টুর্নামেন্টের বাকি অংশ পুরোটা পাব। এছাড়া বিশ্বের এই প্রান্তে এর আগে কখনও আসিনি। আমি খুবই রোমাঞ্চিত সত্যি বলতে।
যে কোনো ক্রিকেটার এখন আইপিএল খেলার আশা রাখে। এবারের বিপিএল থেকে আইপিএল বা উপমহাদেশে খেলার প্রস্তুতি হয়ে যাবে নিশ্চয়ই?
ব্রাউন: হ্যাঁ হ্যাঁ! অবশ্যই। এখানে আসার পরপরই আমি এটি বলেছি। আইপিএলে খেলার কথা মাথায় রেখে বলছি, তা বলব না। নিজের খেলার উন্নতির জন্য মূলত। কারণ আমি এর আগে কখনও ভিন্ন কন্ডিশনে খেলিনি। তাই দেখতে চাইছিলাম, এখানে আমি কেমন করি।
বিগ ব্যাশের চ্যালেঞ্জার ম্যাচের ওই রেকর্ডগড়া ইনিংস থেকেই কি নিজের মধ্যে ভালো করার বিশ্বাস এসেছে?
ব্রাউন: হ্যাঁ! ওই ম্যাচের পরই আমার মধ্যে বিশ্বাস এসেছে আমি সত্যিই এখানের যোগ্য। কখনও কখনও আপনি খেলতে খেলতে অনুভব করবেন, আরেকটু ভালো করা উচিত, আপনি হয়তো এই জায়গায় থাকার মতো নন। তবে ওই ইনিংস আমাকে বিশ্বাস এনে দিয়েছে, এখানে থাকার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য আমার আছে। ওই ম্যাচের পর আমার অনেক আত্মবিশ্বাস এসেছে।
সামনের দিনগুলোতে এই আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই সাহায্য করবে?
ব্রাউন: একদম! আমি সবসময় মনে করার চেষ্টা করি, সেদিন রাতে আমার কেমন লাগছিল। মাঠে ব্যাটিং করার সময় কেমন অনুভূতি ছিল। এই সব কিছু আমাকে অন্যরকম ভালো লাগা এনে দেয়।
চলতি বছর বিশ্বকাপ আছে। সেদিকে কি চোখ রাখছেন?
ব্রাউন: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ! দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারলে তো দারুণ হবে। তবে আমি জানি না। আমার শুধু রান করে যেতে হবে। অনেক রান করতে হবে এবং নিজের সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যাট বানানোর প্রসঙ্গে ফিরি। কবে থেকে এটির শুরু?
ব্রাউন: ২০১৯ সালে আমি যুক্তরাজ্যে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম ম্যাচের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৬ সপ্তাহ ক্রিকেট খেলতে পারিনি। এরপর প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে আমি আমার প্রথম সেঞ্চুরি করি। সম্ভবত ৩০ বলে। যা দারুণ ছিল।
এটি ওই বছরের ডিসেম্বরের ঘটনা। জানুয়ারিতে আমি সেখান থেকে একটি ফোন পাই। তারা বলে যে, তাদের ব্যাট বানানো ও কাঠের ব্যবসা আছে। আমার যেহেতু পেশিবহুল শরীর, তাই কাঠ কাটার ক্ষেত্রে আমার সাহায্য চাইছিল। তখন থেকেই আমার কুপার ক্রিকেটের সঙ্গে যাত্রা শুরু। ব্যাট বানাতে আমি ভালোবাসি।
আমরা সরাসরি যুক্তরাজ্য থেকে উইলো আনার চেষ্টা করছি। এখন সেটি পাকিস্তান হয়ে আসছে। সরাসরি ইংলিশ উইলো পাওয়াটা একটু কঠিন।
আপনার ইনিংসের পর নিশ্চিতভাবেই ব্যাট বিক্রি বেড়েছে?
ব্রাউন: হাহাহা! হ্যাঁ। অবশ্যই। তখন থেকে বিক্রি অনেকটাই বেড়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি আপনি ‘হট ট্যাকল’ নামের মাছ ধরার সরঞ্জামাদি বিক্রির প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেন। মাছ ধরাও কি আপনার শখের তালিকায় আছে?
ব্রাউন: হুম্মম... তারা মূলত আমার স্পন্সর। আমাকে নিয়মিতই মাছ ধরার সরঞ্জামাদি দিয়ে থাকে। মাছ ধরতে আমার ভালো লাগে। সেখানে অবশ্য অনেক ধৈর্য্য রাখতে হয়। এমনও হয় মোবাইল ফোন একপাশে রেখে সারা দিন বসে থাকি। আর ক্রিকেট মাঠে ঠিক উল্টো। বল দেখলেই বড় শট খেলতে ইচ্ছা হয়।