বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি
শেয়ানে শেয়ানে লড়াইয়ে সিডনি টেস্টে লড়াই জমে উঠেছে দারুণ, দুই দিনে ২৬ উইকেট পতনের পরও এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না কোনো দলকে।
Published : 04 Jan 2025, 02:05 PM
ভিরাট কোহলি তখন মাত্রই আউট হয়েছেন। ১৭ রানের মধ্যে তিন উইকেট হারিয়ে নড়বড়ে অবস্থায় দল। রিশাভ পান্ত ক্রিজে নেমে কী করলেন? প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা! আগের টেস্টে তাকে উইকেট ছুড়ে আসতে দেখে ধারাভাষ্যে সুনিল গাভাস্কার বলেছিলেন, ‘স্টুপিড… স্টুপিড…স্টুপিড…।” কিন্তু পান্ত পাত্তাই দিলেন না সেই সমালোচনাকে। ছক্কায় শুরুর পর টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের মহড়া মেলে ধরলেন তিনি সিডনির ২২ গজে।
উইকেটে সিম মুভমেন্ট ছিল যথেষ্ট। বাউন্স তো প্রথম দিন থেকেই অসমান। ম্যাচের প্রথম দুই ইনিংসে দুই দল মিলিয়ে ফিফটি ছিল স্রেফ একটি। সেখানেই অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের তুলাধুনা করে পান্ত খেললেন ৩৩ বলে ৬১ রানের ইনিংস! আরও একবার দেখালেন, তার মতো আর কেউ নেই।
আরও একজন দেখালেন, তিনিও আলাদা। পেস আক্রমণের কেউ চোট-বিশ্রাম পেলেই কেবল তার সুযোগ মেলে একাদশে। প্রায় প্রতিবারই পারফর্ম করেন দারুণভাবে। এই টেস্টেও প্রথম ইনিংসে শিকার করেছিলেন চার উইকেট। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার পর দল যখন আবার তাকিয়ে বোলারদের দিকে, সেই স্কট বোল্যান্ড জ্বলে উঠলেন আবার। ম্যাচে দ্বিতীয়বার তিনি পেলেন চার উইকেটের স্বাদ।
সব মিলিয়ে সিডনি টেস্ট এখন জমজমাট। প্রথম দুই দিনে ২৬ উইকেট পতনের পরও এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না কোনো এক দলকে।
প্রথম ইনিংসে ১৮৫ রানের পুঁজি নিয়েও ভারত আদায় করে নেয় চার রানের লিড। ভারতীয় বোলারদের কৃতিত্ব আসলে আরও বেশি। তাদের বোলিংয়ের মূল অস্ত্রই যে অর্ধেক সময় ছিল মাঠের বাইরে!
অস্ট্রেলিয়ার রান যখন ৫ উইকেটে ১১১, তখনই চোটের কারণে মাঠ ছেড়ে যান জাসপ্রিত বুমরাহ। ভারত এরপরও দারুণ বোলিংয়ে ২০ ওভারের মধ্যে তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া বাকি ৫ উইকেট।
ভারতীয় ব্যাটিং আবারও ভেঙে পড়ে বোল্যান্ডের সামনে। কিন্তু জবাব হয়ে আসেন পান্ত। শেষ পর্যন্ত ভারত দিন শেষ করে ৬ উইকেটে ১৪১ রানে।
চার উইকেট বাকি রেখে ভারত এগিয়ে এখন ১৪৫ রানে। উইকেটের যা অবস্থা, ১৮০ রান তাড়া করাও এখানে অস্ট্রেলিয়ার জন্য হবে চ্যালেঞ্জিং।
অস্ট্রেলিয়া দিন শুরু করে ১ উইকেটে ৯ রান নিয়ে। আগের দিন শেষ বলে উসমান খাওয়াজাকে ফিরিয়েছিলেন বুমরাহ। নতুন দিনের প্রথম উইকেটও আসে তার হাত ধরে। মার্নাস লাবুশেনকে বিদায় করে দেন তিনি ২ রানে।
এই উইকেটে একটি রেকর্ড গড়েন বুমরাহ। ৩২ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে এক সিরিজে ভারতের সফলতম বোলার এখন তিনিই। পেরিয়ে যান তিনি ১৯৭৭-৭৮ সিরিজে বিষেন সিং বেদির ৩১ উইকেটের কীর্তি।
স্যাম কনস্টাসের রোমাঞ্চকর অভিযান অবশ্য চলতে থাকে। আগের দিন ইনিংসের প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বুমরাহকে চার মেরেছিলেন তিনি। এ দিনও একবার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে চার মারেন বুমরাহকে, তার বলেই পরে চার মারেন রিভার্স র্যাম্প শটে।
তবে তাকে ২৩ রানেই থামান মোহাম্মদ সিরাজ। ওই ওভারেই অস্ট্রেলিয়াকে বড় ধাক্কা দেন এই পেসার। ট্রাভিস হেড আউট হয়ে যান একটি চার মেরেই।
৩৯ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে এগিয়ে নেন স্টিভেন স্মিথ ও বাউ ওয়েবস্টার। জুটিতে সাবলিল ব্যাটিং করছিলেন দুজনই। প্রাসিধ কৃষ্ণাকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন স্মিথ।
তবে লাঞ্চের আগেই প্রাসিধ শোধ তোলেন স্মিথকে ৩৩ রানে ফিরিয়ে।
লাঞ্চের পর এক ওভার বোলিং করেই মাঠ ছেড়ে যান বুমরাহ। তবে সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। প্রাসিধ, সিরাজরা দারুণ বোলিং করতে থাকেন। বুমরাহর অনুপস্থিতিতে দারুণভাবে নিজেকে মেলে ধরেন নিতিশ কুমার রেড্ডিও।
স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে ৫৭ রানের দারুণ ইনিংস খেলেন অভিষিক্ত ওয়েবস্টার। ২১ রান করা কেয়ারিকে ফেরানোর পর ওয়েবস্টারের উইকেটও নেন প্রাসিধ।
আকাশ দিপ ফিট থাকলে খেলাই হতো না এই পেসারের। কিন্তু এক বছর পর খেলতে নেমে তিনিই ভারতের সফলতম বোলার।
অস্ট্রেলিয়া শেষ চার উইকেট হারায় ১৯ রানে।
চার রানের লিড নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে ইয়াসাসভি জয়সওয়াল নিজের মনোভাব বুঝিয়ে দেন প্রথম ওভারেই। মিচেল স্টার্কের প্রথম ওভারেই চারটি চার মারেন তিনি। উদ্বোধনী জুটিতে ৪২ রান আসে ওয়ানডের গতিতে।
যথারীতি বোল্যান্ড আক্রমণে আসার পর বদলে যায় চিত্র। লোকেশ রাহুলকে (১৩) বোল্ড করে জুটি ভাঙেন তিনি। পরে অসাধারণ এক ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করে দেন জয়সওয়ালকেও (২২)।
বোল্যান্ডের ছোবল শেষ নয় সেখানেই। সিরিজে তার প্রিয় শিকারে পরিণত হওয়া কোহলিকে আবারও ফেরান তিনি সেই অফ স্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতেই।
৬ রান করে সিরিজের শেষটা হলো তার। এক ইনিংসে সেঞ্চুরির পরও তার মোট রান সিরিজে ১৯০। ব্যাটিং গড় ২৩.৭৫। অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচ সফরে তার সবচেয়ে বাজে সিরিজ এটিই।
শুবমান গিলকে ফিরিয়ে ওয়েবস্টার পান প্রথম টেস্ট উইকেটের দেখা। কিন্তু আরেকপ্রান্তে চলতে থাকে ‘পান্ত-শো।’ প্রথম বলে বোল্যান্ডকে ছক্কার পর ওয়েবস্টারকে এক ওভারে চার মারেন তিনি টানা তিন বলে, আরেক ওভারে মারেন চার ও ছক্কা।
স্টার্ককে ছক্কা মেরে ফিফটি করেন তিনি ২৯ বলে। ভারতের হয়ে যা দ্বিতীয় দ্রুততম। ভারতের হয়ে ২৮ বলে ফিফটির রেকর্ডও তারই। পরের বলে স্টার্ককে ছক্কায় ওড়ান আরেকবার।
পরের ওভারে প্যাট কামিন্সের অনেক বাইরের বল তাড়া করে শেষ হয় পান্তের তাণ্ডব। বোল্যান্ড আক্রমণে ফিরে দ্রুত ফেরান নিতিশকে।
অস্ট্রেলিয়া উইকেট পেতে পারত আরেকটি। কিন্তু শেষ বেলায় ওয়েবস্টারের বলে স্লিপে স্মিথ ফেলে দেন রাভিন্দ্রা রাদেজার ক্যাচ।
ম্যাচ আর সিরিজের ভাগ্য তাই এখনও দোদুল্যমান। দিনের শেষ ভাগে মাঠে ফিরতে দেখা গেছে বুমরাহকে। তার চোট নিয়ে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি এখনও। তার বোলিং করতে পারা বা না পারার ওপর নির্ভর করবে ম্যাচের ভাগ্যের অনেকটুকু।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত ১ম ইনিংস: ১৮৫
অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: (আগের দিন ৯/১) ৫১ ওভারে ১৮১ (কনস্টাস ২৩, লাবুশেন ২, স্মিথ ৩৩, হেড ৪, ওয়েবস্টার ৫৭, কেয়ারি ২১, কামিন্স ১০, স্টার্ক ১, লায়ন ৭*, বোল্যান্ড ৯; বুমরাহ ১০-১-৩৩-২, সিরাজ ১৬-২-৫১-৩, প্রাসিধ ১৫-৩-৪২-৩, নিতিশ ৭-০-৩২-২, জাদেজা ৩-০-১২-০)।
ভারত ২য় ইনিংস: ৩২ ওভারে ১৪১/৬ (জয়সওয়াল ২২, রাহুল ১৩, গিল ১৩, কোহলি ৬, পান্ত ৬১, জাদেজা ৮*, নিতিশ ৪, ওয়াশিংটন ৬*; স্টার্ক ৪-০-৩৬-০, কামিন্স ১১-৪-৩১-১, বোল্যান্ড ১৩-৩-৪২-৪, ওয়েবস্টার ৪-১-২৪-১)।