যে মাঠে ১৭৫ রানও নিরাপদ নয়, সেখানেই স্রেফ ১৪৫ রানের পুঁজি। ম্যাচের ভাগ্য গড়া হতে পারত ওখানেই। কিন্তু সাকিব আল হাসান, মুজিব উর রহমানরা দেখালেন, শেষের আগে শেষ বলে কিছু নেই। স্পিন জাদুতে দুজন এমন ধাঁধায় ফেলে দিলেন খুলনা টাইগার্সের টপ অর্ডারকে, পরে আর তারা আলোর দেখা পেল না ইয়াসির আলি চৌধুরির দুর্দান্ত ইনিংসেও।
Published : 31 Jan 2022, 06:24 PM
বিপিএলে সোমবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে শেষ দিকে খানিকটা রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচে ফরচুন বরিশালের জয় ৬ রানে।
ব্যবধান বেশ কম হলেও আদতে রান তাড়ায় জয়ের মতো অবস্থায় কখনোই খুব একটা ছিল না খুলনা। শুরু থেকেই লাগাম হাতে রেখে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে নেয় বরিশাল।
দুর্দান্ত বোলিংয়ের আগে ব্যাট হাতেও এবারের আসরে নিজের সেরা ইনিংসটি খেলেন সাকিব। অধিনায়কের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের সঙ্গে যোগ হয় নতুন বলে স্পিনের মায়াজালে মুজিবের হিসেবি বোলিং। ব্যাটিং উইকেটে ১৪৫ রানের পুঁজিও তাই হয়ে ওঠে যথেষ্ট।
চট্টগ্রামে তো বটেই, বিপিএলের এবারের আসরেই এই প্রথম কোনো দল দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে আগে ব্যাট করে থমকে গেল দেড়শর নিচে। চট্টগ্রামে আগের দুই ম্যাচে হয়েছিল ১৭৫ ও ২০২ রান।
সেই রান তাড়ায় প্রথম ১০ ওভারে স্রেফ ৩৫ রান তুলে যে খাদে পড়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক খুলনা টাইগার্স, সেখান থেকে অনেক চেষ্টায়ও আর উঠতে পারেনি তারা। ইয়াসির আলির ৩৪ বলে ৫৭ রানের ইনিংসটিতে ম্যাচে উত্তেজনা জাগে। খুলনার আশাও জিইয়ে ওঠে খানিকটা। কিন্তু যোগ্য সঙ্গী না পাওয়ায় হতাশ হয়েই মাঠ ছাড়তে হয় তাকে।
২৭ বলে ৪১ রানের ইনিংস খেলার পর ৪ ওভারে স্রেফ ১০ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে বরিশালের নায়ক সাকিব। তাতে এবারের আসরে প্রথমবার তার হাতে উঠল ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
টানা চার ওভার বোলিং করে আফগান রহস্য স্পিনার মুজিব একটি মেডেনসহ দেন কেবল ১৩ রান।
দুটি দলেই বলার মতো জুটি একটি, সেটিও একই- ৭৯ রানের। সাকিব ও নাজমুল হোসেন শান্তর জুটি ৫৯ বলে। মুশফিক ও ইয়াসির ওই একই রান করেন ৫০ বলে। কিন্তু শেষ হাসি হাসে বরিশালই।
টস জিতে প্রথম হাসিটাও ছিল তাদের মুখেই। তবে এবারের আসরে আগের ১৩ ম্যাচের টস জয়ী দলের মতো বোলিং নয়, বিস্ময় জাগিয়ে তিনি নেন ব্যাটিং।
ব্যাটিং অর্ডারেও দেখা যায় চমক। আগের ম্যাচে হুট করে ওপেন করা বাঁহাতি স্পিনার জেইক লিন্টট এবার নেই দলে। একাদশে ফিরেই ওপেনিংয়ে নামেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার ডোয়াইন ব্র্যাভো। তবে কাজে লাগেনি সেই ফাটকা।
ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে সৈয়দ খালেদ আহমেদের দুটি আলগা বল পেয়ে বাউন্ডারি যদিও মারেন ব্রাভো। তবে আউট হয়ে যান পরের বলেই।
প্রমোশন দিয়ে তিনে পাঠানো তৌহিদ হৃদয় রান আউট হয়ে যান ওভারথ্রো থেকে রান চুরির চেষ্টায়।
পাওয়ার প্লেতে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে মাত্র ২৯ রান করে বরিশাল। তিন ওভারের টানা স্পেলে মেহেদি হাসান দেন কেবল ৮ রান।
সেখান থেকে দলকে উদ্ধার করেন সাকিব ও নাজমুল হাসান শান্ত। শুরুতে ইনিংস গড়ায় মন দেন দুজন, পরে বাড়ানোর চেষ্টা করেন গতি।
জুটি অল্পতে থামানোর সুযোগ যদিও পেয়েছিল খুলনা। কিন্তু থিসারা পেরেরার বলে সিকান্দার রাজা ক্যাচ নিতে পারেননি স্কয়ার লেগ সীমানা থেকে এগিয়ে থাকায়। উল্টো তার হাতে লেগে হয়ে যায় ছক্কা! সাকিব তখন ছিলেন ৯ রানে।
১১ ওভার শেষেও বরিশালের রান রেট ছিল ছয়ের নিচে। খালেদের করা দ্বাদশ ওভারে সাকিবের চার ও শান্তর ছক্কায় রান রেট যায় ছয়ে। থিসারাকে পুল করে সাকিব আরেকটি ছক্কা হাঁকানোর পর চার মারেন শান্ত।
পরে জীবন পান শান্তও। কাভারে মেহেদি মুঠোয় জমাতে পারেননি সহজ ক্যাচ।
জুটি অবশেষে ভাঙে সাকিবে বিদায়ে। কামরুল ইসলাম রাব্বিকে একটি ছক্কার পর একই চেষ্টায় ধরা পড়েন তিনি মিড-উইকেটে।
দীর্ঘক্ষণ এক প্রান্তে থাকা শান্ত সীমানায় ধরা পড়েন থিসারার অফ কাটারে। ৪০ বলে তার ৪৫ রানের ইনিংসে তিন চারের পাশে ছক্কা দুটি।
শেষ দিকে ঝড় তোলার মঞ্চ তখন প্রস্তুত। কিন্তু পারেননি নুরুল হাসান সোহান, ইরফান শুক্কুর, জিয়াউর রহমানরা। সাকিব ও শান্ত ছাড়া আর কেউ করতে পারেননি ১৫ রানও। আর কোনো জুটি পারেনি দুই অঙ্কে যেতে। ৪২ রানে শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে তারা থমকে যায় দেড়শর আগেই।
রান তাড়ায় মুজিবের প্রথম বলে বাউন্ডারিতে ভালো শুরু করেন আন্দ্রে ফ্লেচার। ওভারের শেষ বলেই ফিরতে পারতেন ক্যারিবিয়ান ওপেনার। কিন্তু স্লিপে ক্যাচ মুঠোয় জমাতে পারেননি গেইল।
আগের দুই ম্যাচে কেবল ১ ও শূন্য রান করা সৌম্য এবার প্রথম বলে শফিকুল ইসলামকে মারেন বাউন্ডারি। টি-টোয়েন্টিতে স্পর্শ করেন তিন হাজার রানের সীমানা। পরের বলে মারেন আরেকটি বাউন্ডারি।
প্রথম আট বলে আসে ১৪ রান। এরপরই সাকিব ও মুজিবের আঁটসাঁট স্পিনের রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন সৌম্য ও ফ্লেচার। না পারছিলেন তারা বাউন্ডারি মারতে, না পারছিলেন এক-দুই নিয়ে রান বাড়াতে।
কোনো উইকেট না হারালেও পাওয়ার প্লেতে রান আসে কেবল ২২।
সাকিব ও মুজিবের প্রথম স্পেল কোনোরকমে কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় হয়তো ছিলেন সৌম্য ও ফ্লেচার। কিন্তু দুই স্পিনারই টানা ৪ ওভার শেষ করে দিয়ে একদম চেপে ধরেন খুলনাকে।
এরমধ্যেই সাকিবকে উড়িয়ে শেকল ভাঙার চেষ্টায় বিদায় নেন সৌম্য (২২ বলে ১৩ )।
তিন নেমে রনি তালকুদারও পড়ে যান একই চক্করে। মন্থর শুরুর পর রানের খোঁজে সাকিবকে একটি বাউন্ডারি মারতে পারেন তিনি। তবে বোল্ড হয়ে যান পরের বলেই।
ধীরগতির শুরু পরে আর পুষিয়ে দিতে পারেননি ফ্লেচার (২৩ বলে ১২)। দ্রুত রান তোলার জন্য নামা থিসারা পেরেরা বোল্ড তৃতীয় বলেই। এক ওভারেই যখন এই দুজনকে ফেরালেন ব্রাভো, খুলনা তখন দিশাহারা।
মুশফিকের সঙ্গে যখন ইয়াসির আলি জুটি বাঁধেন খুলনার তখন প্রয়োজন ১০ ওভারে ১১১ রান!
ইয়াসির শুরু থেকে পরিস্থিতির দাবি মেটানোর চেষ্টা করেন। তবে মুশফিকের ব্যাটে ছিল না প্রত্যাশিত গতি। তাতে জুটি গড়ে উঠলেও সমীকরণ হতে থাকে কঠিন।
মুশফিক যতক্ষণে হাত খোলেন, ততক্ষণে দেরি হয়ে যায় খানিকটা। মেহেদি হাসান রানাকে একটি বাউন্ডারির পর দুর্দান্ত স্কুপ শটে মারেন ছক্কা। প্রয়োজন ছিল তখন আরও কিছু চার-ছক্কা। পারেননি খুলনা অধিনায়ক। শেষের আগের ওভারে বিদায় নেন ২২ বলে ৩৩ করে।
ইয়াসির চেষ্টা করে যান শেষ পর্যন্ত। নিজের টি-টোয়েন্টি সামর্থ্যের বিজ্ঞাপন মেলে ধরে পেশিশক্তির কিছু শটে ফিফটি স্পর্শ করেন ৩০ বলে।
কিন্তু এমন লড়াইয়ে একার চেষ্টায় পারা কঠিন। ডেথ ওভারের ‘মাস্টার’ ব্রাভোর শেষ ওভারে চার মারেন সিকুগে প্রসন্ন, ইনিংসে শেষ বলে মেহেদির ব্যাট থেকে আসে ছক্কা। কিন্তু জয়ের হাসিতে মাঠ ছাড়ে বরিশাল।
৫ ম্যাচে সাকিবদের এটি তৃতীয় জয়, মুশফিকদের তৃতীয় হার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ফরচুন বরিশাল: ১৮.৫ ওভারে ১৪৫ (ব্রাভো ৯, গেইল ৪, হৃদয় ৫, সাকিব ৪১, শান্ত ৪৫, সোহান ১০, জিয়াউর ৮, ইরফান ৬, মুজিব ১২, মেহেদি রানা ০, শফিকুল ০*; মেহেদি ৪-০-১৩-০, খালেদ ৪-০-৪১-৩, কামরুল ৩-০-২৫-২, থিসারা ৪-০-৩২-১, প্রসন্ন ১-০-১১-০, ইয়াসির ১-০-৮-০, ফরহাদ ১.৫-০-১৪-২)
প্রিমিয়ার ব্যাংক খুলনা টইগার্স: ২০ ওভারে ১৩৯/৬ (ফ্লেচার ১২, সৌম্য ১৩, রনি ৬, মুশফিক ৩৩, থিসারা ৪, ইয়াসির ৫৭*, প্রসন্ন ৬, মেহেদি ৬*; মুজিব ৪-১-১৩-০, শফিকুল ৪-০-৩৯-১, সাকিব ৪-০-১০-২, ব্র্যাভো ৪-০-৪০-৩, মেহেদি রানা ৪-০-৩৬-০)
ফল: ফরচুন বরিশাল ৬ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান