ট্রফি হাতে পোজ, বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে ফটোসেশন, ক্রিকেটার-কোচিং স্টাফের হাসির ফোয়ারায় বিজয় উৎসব, সবই হলো। তৃপ্তির ঢেকুরও উঠল বেশ। সেটা স্বাভাবিকই। টানা তিনটি সিরিজ জয় তো বাংলাদেশের বাস্তবতায় চাট্টিখানি কথা নয়। টানা দুটি সিরিজ জয়ই তো আগে ছিল না! জিম্বাবুয়ে সফরের পর দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা সিরিজ জয়ে তাই প্রাপ্তির পাল্লা যথেষ্টই ভারি। তবে ঠিক অপর প্রান্তেই, প্রশ্ন ও সংশয়ের পাল্লাও খুব হালকা নয়!
Published : 11 Sep 2021, 06:30 PM
জিম্বাবুয়েতে সিরিজ জয় খুবই প্রত্যাশিত ছিল। বরং সেই সিরিজে তিন ম্যাচের একটি হেরে যাওয়াটাই ছিল হতাশার। তবে অন্য দুই ম্যাচে দলের জয়ের ধরনে তৃপ্তির অবকাশ ছিল যথেষ্টই। প্রথম ম্যাচে ব্যাটিং উইকেটে জিম্বাবুয়েকে ১৫২ রানে আটকে রাখা ছিল বোলারদের কৃতিত্ব। ব্যাটসম্যানরাও অনায়াসে তা টপকে ম্যাচ জিতে যায় ৮ উইকেটে।
সেই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১৬৭ রান তাড়ায় ব্যর্থ বাংলাদেশ শেষ ম্যাচ ১৯৪ রান তাড়া করে জিতে নেয় সিরিজ। বড় রান তাড়ায় ইনিংস গড়া ও শেষ সময়ের দাবি মেটানো, সবই সেদিন ঠিকঠাক করতে পারে দল।
সেখান থেকে দেশে ফিরেই অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। যাদের বিপক্ষে আগে কখনোই কোনো টি-টোয়েন্টি তখনও জিততে পারেনি বাংলাদেশ, কোনো সংস্করণেই পায়নি সিরিজ জয়ের স্বাদ। মূল ক্রিকেটারদের বেশ কজনকে ছাড়া সফরে আসা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবার জয় এবং সিরিজ জয়ের আশাও ছিল। কিন্তু ৪-১ ব্যবধানের জয় সিরিজ শুরুর আগে অভাবনীয় ছিল নিশ্চিতভাবেই। বাংলাদেশ সেটিই করে দেখায়।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও বাস্তবতা ছিল প্রায় একই। টি-টোয়েন্টিতে ১০ ম্যাচ খেলে তাদের বিপক্ষে জয় ছিল না একটিও। তারাও সফরে পাঠায়নি মূল দলকে এবং তাদের বিপক্ষেও ধরা দিয়েছে সিরিজ জয়।
স্রেফ ফলাফল বিবেচনা করলে, দারুণ সাফল্যময় পথচলা।
এতে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা হয়েছে র্যাঙ্কিংয়ে। কিছুদিন আগেও আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের দশে পড়ে থাকা বাংলাদেশ এখন উঠে এসেছে ছয়ে। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে খেলার ঝামেলায় না পড়ার জন্য এই র্যাঙ্কিং কাজে দেবে বেশ। ‘কাট অফ’ তারিখের আগে সেরা আট দলের মধ্যে থাকলেই অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে সরাসরি খেলা যাবে সুপার টুয়েলভ পর্বে।
দূর ভবিষ্যতই শুধু নয়, নিকট ভবিষ্যতে তাকিয়েও এই জয়গুলো কম মূল্যবান নয়। এবারের বিশ্বকাপের আগে এই জয়ের মিছিল দলকে প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস যথেষ্টই জোগানোর কথা। আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর দল অনেক সময় নিজেদের সীমানাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
উত্তর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘না।’
অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে মন্থর ও টার্নিং উইকেট বানিয়ে তাতে জয়ের কৌশল বেছে নেওয়ায় দোষের কিছু নেই। ঘরের মাঠের সুবিধা দুনিয়াজুড়ে সব দলই নেয়। যদিও টি-টোয়েন্টি সংস্করণে সেই সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা কমই, তারপরও এমন দুটি দলকে নিজেদের আঙিনায় পেয়ে হারানোর সুযোগ নিতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফলাফলে সেই লক্ষ্য পূরণও হয়েছে। কিন্তু পারফরম্যান্স আদতে কতটা ভালো ছিল?
অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের জন্য এরকম ধীরগতির, গ্রিপ করা উইকেটে খেলা ভীষণ দুরূহ। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তো এরকম উইকেটে কতই খেলেন। তাদের কাছ থেকে আরও ভালো পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুটি সিরিজেই হতাশ করেছেন প্রায় সব ব্যাটসম্যান।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজের উইকেট যেমন ছিল, তাতে দেড়শ না হোক, অন্তত ১৩০-১৪০ করা যেত নিজেদের সামর্থ্যটা দেখাতে পারলে। নিউ জিল্যান্ড সিরিজের অন্তত দুটি ম্যাচের উইকেটে দেড়শ ছাড়াতে না পারা বড় ব্যর্থতা।
টপ অর্ডার নিয়ে বাংলাদেশ ধুঁকছে অনেক দিন থেকেই। জিম্বাবুয়ে সফরে মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও সৌম্য সরকারের পারফরম্যান্সে আশার আলো দেখা গেলেও দেশে ফিরে তা মিলিয়ে গেছে। দুটি সিরিজেই এই দুজনের পারফরম্যান্স হতাশার। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে না খেলা লিটন দাস নিউ জিল্যান্ড সিরিজে ব্যর্থ পুরোপুরি।
তাদের জন্যও উইকেট খুব আদর্শ ছিল না অবশ্যই। তবে খুব আগ্রাসী বা ঝড়ো না হোক, একটু উইকেটে থেকে রান তো করা যায়! অস্ট্রেলিয়া সিরিজে মিচেল মার্শ যেমন দেখিয়েছেন, নিউ জিল্যান্ড সিরিজে টম ল্যাথাম দীর্ঘদিন পর টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমেই দেখিয়েছেন, এরকম উইকেটেও চাইলে রান করা যায়। কার্যকর ব্যাটিং করা যায়। লিটন-সৌম্য-নাঈমরা তা পারেননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আউট হয়েছেন বাজে শটে।
মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ হোসেনের পারফরম্যান্স অবশ্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক। খুব দারুণ কিছু যদিও নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনিংস মাহমুদউল্লাহ উপহার দিয়েছেন। আফিফ বারবার দেখিয়েছেন তার প্রতিভার ঝলক। যেসব উইকেটে অন্য ব্যাটসম্যানরা ভুগেছেন, রান খুব বেশি না করলেও আফিফকে সেখানে বেশ সাবলীল মনে হয়েছে। ব্যাটিং অর্ডারে আরেকটু ওপরে জায়গা পাওয়ার দাবিও তিনি জানিয়ে রেখেছেন।
নুরুল হাসান সোহান ও তরুণ শামীম হোসেন কিছুটা ঝলক দেখালেও ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি। ফিনিশারের ভূমিকায় তাদের দুজনকে নিয়েও সংশয়ের জায়গা আছে।
সবশেষ দুটি সিরিজে বোলারদের পরীক্ষায় পড়তে হয়েছে সামান্যই। মুস্তাফিজুর রহমান ও সাকিবকে নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ খুব একটা নেই। মুস্তাফিজ তো এখানকার উইকেটে ছিলেন ভয়ঙ্কর। বিশ্বকাপে ভালো ব্যাটিং উইকেটে খেলা হলে তিনি কেমন করবেন, সেটা সময়ই বলবে। সাকিবও তার অভিজ্ঞতা ও চতুরতা দিয়ে খারাপ করার কথা নয়।
বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ উন্নতির ছাপ রাখতে পেরেছেন। যদিও এখনও প্রায় একটি-দুটি শর্ট বল করা, আলগা বল করার দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে উন্নতি সহজেই করা সম্ভব। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন ও তরুণ শরিফুল ইসলামের উন্নতিরও অনেক জায়গা আছে।
তাসকিন আহমেদ দুই সিরিজ মিলিয়ে খেলতে পেরেছেন কেবল একটি ম্যাচ। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই শেষ ম্যাচে প্রথম স্পেলে দারুণ আগ্রাসী ও গতিময় বল করেছেন তিনি। সুইংও আদায় করে নেন কিছুটা। পরে শেষ দিকে যদিও খরুচে ছিলেন। তবে স্লোয়ারসহ বিভিন্ন বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করতে দেখা গেছে তাকে। এখনও নিখুঁত নন তিনি। তবে বিশ্বকাপে দলের কাজে লাগতে পারেন, এই বার্তা দিয়েছেন।
সামগ্রিকভাবে, উইকেট ব্যাটিং সহায়ক হলে বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিং, দুটি ইউনিটের কার্যকারিতা নিয়েই সংশয় আছে যথেষ্ট। বিশ্বকাপের আগে ওমানে প্রস্তুতি ক্যাম্প ও প্রস্তুতি ম্যাচগুলিতে নিজেদের আরও ঝালাই করে নেওয়া যাবে। বিশ্বকাপের প্রত্যাশার সম্ভাব্য চিত্রও তখন হয়তো মিলবে।
আপাতত বলা যায়, এই সিরিজগুলোর সাফল্যে র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হয়েছে, দারুণ কিছু অর্জন ধরা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলের সার্বিক বাস্তবতা খুব একটা বদলায়নি।