মনকে বশ করাই মাশরাফি-তামিমদের বড় চ্যালেঞ্জ

মাঠের ডাক তো আছেই। মন ছুটে যায় সেই টানে। ঘরে পড়ে থাকা ব্যাট-বল যেন আগের চেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে। ক্রিকেটের বাইরে বন্ধু-আড্ডা-ঘোরাফেরা তো আছেই। এই অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক সবকিছুর টান যেন আরও প্রবলভাবে অনুভব করছেন ক্রিকেটাররা। ঘরবন্দি এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনকে মানানো। কঠিন সেই কাজ কে কিভাবে করছেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেই গল্প শোনালেন ক্রিকেটারদের কয়েক জন।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2020, 01:44 PM
Updated : 29 March 2020, 01:44 PM

মাশরাফি বিন মুর্তজা

“আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ঘরে বসে থাকা। এমনিতে ইনজুরির জন্য জীবনে অনেকটুকু সময় শুয়ে-বসে কাটাতে হয়েছে। সুস্থ থেকে টানা এত লম্বা সময় ঘরে আটকে থাকিনি কখনও। আপনারা প্রায় সবাই জানেন, আমার আড্ডা দিতে, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে। ক্রিকেটের বাইরে নানা ব্যস্ততাও আছে এখন।”

“ঘরে থাকার কঠিন কাজটা সহজভাবে করতে পারছি, কারণ সময়টাই এমন। এখন দুযোর্গ চলছে, বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়। সময়ের ডাক শুনতে হবে সবাইকে। আর এই সমাজের মানুষ হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব বলছে, এখন আমাদের ঘরে থাকতে হবে। তাই মন অস্থির হয়ে উঠতে চাইলেও তাকে শান্ত রাখতে পারছি।”

“সব ঠিক থাকলে এখন হয়তো ঢাকা লিগে খেলতাম। আপাতত অলস সময়ই কাটছে। বাসায় যতটা ভালো থাকা যায়, চেষ্টা করছি থাকার। বাচ্চাদের সঙ্গে মজায় সময় কাটানোর চেষ্টা করছি। এলাকার কিছু কাজ তো থাকেই (নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদ্য হিসেবে), ফোনেই যতটা করা সম্ভব চেষ্টা করছি ও নির্দেশনা দিচ্ছি।”

“ঘরে আটকে থেকে অনেকের অবসাদ আসতে পারে। তবে আমাদের এখানে আসলে মানসিক স্বাস্থ্য ততটা গুরুত্ব পায় না। আমাদের সামাজিক বাস্তবতা ভিন্ন। মার্কাস ট্রেসকোথিক বা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলরা যেভাবে নিজেদের বিষন্নতা কথা বলতে পারে, আমাদের এখানে সেই সুযোগ নেই। কেউ যদি বলে, ‘ভালো লাগছে না’, তাহলে আমরা হয়তো ধরে নেব সে ভয় পাচ্ছে বা কোনো অজুহাত দিচ্ছে। অনেকে আবার ব্যাপারটি সেভাবে অনুভবই করে না। যারা করে, তারা প্রকাশ করে না বা প্রয়োজন বোধ করে না। সবার এদিকটায় সতর্ক থাকা উচিত। তবে আমার মনে হয় না খুব একটা সমস্যা হবে।”

তামিম ইকবাল

“সত্যি কথা বলতে, এখনও পর্যন্ত আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। সকালে ফিটনেসের কাজ করি। এরপর সারাদিন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে, স্ত্রীর সঙ্গে কাটাই। এমনিতে তো খুব একটা সময় ওদের দেওয়া হয় না। খেলার ব্যস্ততার বাইরেও সময় পেলে হয়তো বাইরে যাওয়া, ঘোরাঘুরি, অন্যান্য কাজ থাকে। এভাবে শুধু ঘরে পরিবারের সঙ্গে এতটা সময় কাটানো হয় না। এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা, যা আমি খুবই উপভোগ করছি।”

“আমি এটিকে ঠিক ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইস’ বলব না। কারণ, এভাবে ‘ব্লেসিং’ আমি চাই না। কেউই চায় না। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি বটে। কিন্তু এর চেয়েও জরুরি হলো, সব ঠিক হয়ে যাওয়া। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়া।”

“আরও অনেক দিন এভাবে থাকতে হলে কেমন লাগবে, তা এখনই বলা কঠিন। খারাপ লাগতেও পারে। তবে আমি নিজের মনকে যেভাবে বোঝাচ্ছি যে, ব্যাপারটি শুধু আমার নয়। নিজের ভালো তো দেখতে হবেই, সঙ্গে চারপাশের সবার ভালোও এখানে মিশে আছে। একটা পর্যায়ে খারাপ লাগলেও তাই নিজেকে বোঝাতে হবে, এই খারাপ লাগা ভালো কিছুর জন্য। এই ত্যাগটুকু সবার ভালোর জন্য।”

“মানসিক স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বটে। আমাদের দেশে যদিও সেভাবে এটির গুরুত্ব পায় কম। তবে এদিকটায় নজর দেওয়া উচিত। আমার হয়তো সমস্যা হচ্ছে না, অন্য কারও হতে পারে। নিজেকেই এটি ভালো বুঝতে হবে। কারও লেখা দুটি লাইন পড়ে বা কারও পরামর্শের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজে কিভাবে সামলাতে পারি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার ও আনন্দ নিয়ে সময় কাটানোর উপায় বের করতে হবে। একেকজনের ক্ষেত্রে সেটি একেকরকম। কিন্তু করতে হবে।”

মাহমুদউল্লাহ

“পুরোপুরিই ঘরবন্দি আছি, তবে সময় খারাপ কাটছে না। সকালে উঠে নাশতা করেই ছেলের সঙ্গে খেলতে শুরু করি। কখনও ওর হোমওয়ার্ক দেখিয়ে দেই। এমনিতে তো এসবের সুযোগ খুব একটা হয় না! আজকেই যেমন ওর সঙ্গে ড্রয়িং করলাম। কত বছর পর ছবি আঁকলাম, নিজেরও মনে নেই!”

“দুপুরের দিকে ট্রেডমিলে রানিং করি। কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, ঘরে বসে ফিটনেসের কাজ যতটা করা যায়, চেষ্টা করছি। মারিওর সঙ্গে কথা বলে (জাতীয় দলে সদ্য সাবেক ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়ন) এসব কাজ করছি। ট্রেডমিলে খুব বেশি রানিং করলেও কিছু সমস্যা হয়, মারিও সেসব বলে দিয়েছে।”

“মনকে বশ করা অবশ্যই কঠিন। আমাদের তো এত লম্বা সময় টানা ঘরে থাকার অভ্যাস নেই। নরম্যালি খেলা বা দলের প্র্যাকটিস না থাকলেও দু-একদিন বিশ্রাম নিয়ে আমরা হয়তো ফিটনেস ট্রেনিং করতে বের হই। ব্যাট নিয়ে হালকা নক করি। কিছু না কিছু করি। এখন কিছুই করার সুযোগ নেই। কঠিন সময়। তবে নিজেকে এটিই বোঝাচ্ছি যে, এটাই আমার দায়িত্ব।”

“আমি যদি ঘরে থাকি, তাহলে শুধু নিজেকে না, হয়তো আরও পাঁচ জনকে রক্ষা করছি। সবাই যদি এভাবে ভাবি, তাহলে গোটা দেশ রক্ষা পায়। সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবেই এটা করা উচিত। অন্য কিছুর অপশন আছে বলেও আমি মনে করি না।”

“মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি এখনও হয়তো ততটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। তবে আল্লাহ না করুক, যদি আরও অনেক দিন, ধরুন এক মাস আমাদের এভাবেই থাকতে হলো, তখন কিন্তু এক ধরনের অবসাদ অনেককে পেয়ে বসতে পারে। এজন্য এখন থেকেই সবাইকে নিজে থেকেই চেষ্টা করতে হবে ভালো থাকতে। দৈনন্দিন কাজে নতুনত্ব আনা, উদ্ভাবনী কিছু করা, এসব ভাবতে হবে। কেউ হয়তো অনেকদিন ছোটদের বই পড়ে না, হুট করে পড়লে ভালো লাগতে পারে। এধরনের নানা সময়ে নানা কিছু করার পথ খুঁজতে হবে।”

সৌম্য সরকার

“সময় কেটে যাচ্ছে ভালো-মন্দ মিশিয়ে। এমনিতে আমাদের নতুন সংসার, স্ত্রীর সঙ্গে একসঙ্গে সময় কাটানোর বড় সুযোগ মিলেছে। তবে মাঠের মানুষ তো, মাঠে যেতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছি।”

“গত ১৭ মার্চের পর থেকে বাড়ির বাইরে যাইনি। এমনকি বাসার নিচেও নামিনি। বার দুয়েক ছাদে গিয়েছি কেবল। ব্যাট-বলের দিকে তাকালেই খারাপ লাগে। মনে হয়, ব্যাট নিয়ে বের হয়ে যাই এক্ষুনি।”

“এমনিতে সিনেমা-নাটক দেখছি, গান শুনছি, লুডু-ক্যারম খেলছি। যতভাবে মজা করা যায়, নিজেদের ব্যস্ত রাখা যায়, চেষ্টা করছি। ফিটনেসের কাজও করছি, সীমাবদ্ধতার ভেতর যতটুকু সম্ভব হয়। সিঁড়িতে রানিং করছি।”

“মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি আমাদের দেশে আলোচিত না হলেও আমি মনে করি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিষন্নতা বা রোগের পর্যায়ে হয়তো যাচ্ছে না, কিন্তু খারাপ লাগা স্বাভাবিক। আমার নিজেরই যেমন মাঝেমধ্যে মাথা খারাপের মতো লাগে। অস্থির লাগে। আমি বা আমার স্ত্রী, কারও তো এত লম্বা সময় ঘরে থাকার অভ্যাস নেই। খেলার ব্যস্ততা যখন তুমুল থাকে, বিশ্রাম নিতে মন চায়, তখনও দু-একদিন বাসায় থাকলেই ইচ্ছে হয় আবার ব্যাট হাতে বেরিয়ে পড়ি। এখন তো কতদিন হয়ে গেল!”

“চেষ্টা করছি তবু, যতটা ভালো থাকা যায়। আশা করি, এই সময়টা দ্রুত কেটে যাবে। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব।”

মেহেদী হাসান মিরাজ

“আমার সময় বেশ ভালোই কাটছে। খেলা বন্ধ হওয়ার পরপরই বরিশালে চলে এসেছি, আমাদের আদি বাড়িতে। স্ত্রী আর মাকে নিয়ে এসেছি, এখানে দাদী-চাচারা আছেন। এমনিতে ঢাকা আর খুলনায় বেশি থাকা হয়। এবার অনেক বছর পর এত বেশি সময় বরিশালে থাকছি। সবাই মিলে খুব ভালো সময় কাটছে।”

“গ্রামে এখনও সেভাবে করোনাভাইরাসের প্রকোপ নেই। লোকজনের মাঝে আতঙ্কের ছাপও খুব একটা চোখে পড়েনি। আমরা তবু যতটা সম্ভব, চেষ্টা করছি সতর্ক থাকার। নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছি। বাড়ির নানা গাছে উঠছি, কাঠ কাটছি। সবাই মিলে মজা করছি। ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ কিছু করে ফিটনেস যতটা ধরে রাখা যায়, চেষ্টা করছি।”

“ক্রিকেট মাঠ যদিও টানছে। এভাবে এতটা সময় টানা ক্রিকেট থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা তো হয় না। কিন্তু সেই খারাপ লাগাকে মাথায় রাখতে চাচ্ছি না। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপার নিয়ে আমার মনে হয় না আমাদের দেশে খুব দুর্ভাবনা আছে। আমরা যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি, পরিবারকে সময় দিতে পারি কম। এই সুযোগে সবাই একান্তে সময় কাটাতে পারছি। কারও কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।”