২০১০ সালে তামিম ইকবাল করেছিলেন ১ হাজার ৬৪৬ রান। এক পঞ্জিকাবর্ষে যা ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। সদ্য সমাপ্ত বছরে তাকে ছাড়িয়ে মুশফিকুর রহিম করেছেন ১ হাজার ৬৫৭ রান। এই রেকর্ড কেবল একটি উপলক্ষ্য, আরও অনেক কিছুতেই দুজনকে মেলে একই বন্ধনীতে। বাংলাদেশের সবসময়ের সেরা দুই ব্যাটসম্যান মনে করা হয় দুজনকে, দুজনের সম্পর্কও দারুণ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে একসঙ্গে বসে দুজন কথা বললেন দুজনের ক্যারিয়ার, অর্জন, বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে।
Published : 04 Jan 2019, 11:27 AM
রেকর্ড দিয়েই শুরু করা যাক। তামিম কি এটিকে রেকর্ড হাতছাড়া হিসেবে দেখছেন নাকি হাতবদল?
তামিম: হাতছাড়া বলব না। এই রেকর্ড এমন যে ম্যাচ বেশি খেলা হলে রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আমাদের টপ অর্ডারে যারা আছে, তারা যদি এই পরিমাণ ম্যাচ খেলে এবং একটি ভালো বছর কাটায়, তাহলে রেকর্ডটি আবার ভাঙবে। (রেকর্ড ভাঙতে তামিমের চেয়ে ১১ ইনিংস বেশি লেগেছে মুশফিকের)।
আমার বা মুশফিকের রান সংখ্যা যদি দেখেন এই রেকর্ডে, কিংবা গড়, বেশ ভালো। কিন্তু অসাধারণ কোনো কিছু নয়। আমি বা মুশফিক, কিংবা অন্য কেউ যদি দুই হাজার রান বা সেরকম কিছু করে, এর পর সেই রেকর্ড যদি কেউ ভাঙে, তখন আমি মনে করি দারুণ কোনো অর্জন হবে।
তবে আমি এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। মুশফিক যেমন টেস্টে আমাদের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল, আমি পরে পেরিয়ে গেছি, সাকিব নতুন রেকর্ড গড়েছে, মুশফিক আবার ছাড়িয়ে গেছে। আমিও চাইব এভাবেই আবার ছাড়িয়ে যেতে। এরকম স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা দলের জন্য ভালো।
মুশফিক, নিজের কাছে আপনার এই অর্জন কেমন আর তামিমকে ছাড়াতে পারা বিশেষ কিছু কিনা...
মুশফিক: আমি তো এই রেকর্ডের কথা আগে জানতামই না। কখনোই ঠিক করি না যে এই বছর এত রান করতে হবে। সবসময়ই চাই, ফর্ম থাকলে সেটিকে যত লম্বা সময় সম্ভব ধরে রাখা যায়। আর রান করলে সেটি যেন ম্যাচ জয়ী কিছু হয়।
তামিমকে ছাড়াতে পারা অবশ্যই বিশেষ কিছু। আমি সবসময়ই বলি, তামিম আমাদের সব ব্যাটসম্যানের জন্যই অনুপ্রেরণা। ও যখন দারুণ কিছু করে, তখন আমাদেরও মনে হয় যে তামিম পারলে আমাদেরও পারার চেষ্টা করা উচিত। তামিম সবসময়ই একটি মানদণ্ড ঠিক করে দেয়।
আমিও তামিমের সঙ্গে একমত। এটি ভালো রেকর্ড, তবে অসাধারণ কিছু নয়। বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথরা দেখা যায় এক ফরম্যাটেই বছরে হাজার-পনেরশ রান করে ফেলে। আমরা যদিও এত বেশি ম্যাচ খেলি না, তবু আরও ভালো করা সম্ভব। অন্তত দুই-আড়াই হাজার রান করা উচিত।
তামিম: আরেকটি ব্যাপার এখানে আমি যোগ করতে চাই। আমাদের রানকে শুধু সংখ্যা দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। আমাদের সমান ম্যাচ খেললে অন্য দেশের কেউ হয়তো দুইশ রান বেশি করতে পারে। কিন্তু একটি ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত, আমাদের উইকেটে খেলা সহজ নয়। আমরা বেশিরভাগ ম্যাচ খেলি মিরপুরে। এটি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র মাঠ, যেখানে এখনও ২৪০-২৫০ রান করেও জেতা সম্ভব। বেশিরভাগ সময়ই উইকেট ট্রিকি থাকে, ব্যাটসম্যানদের কাজ কঠিন।
আমার টেস্ট গড় যা, বা মুশফিকের গড়, ৪৫-৫০ নয়, তিরিশের ঘরে এখনও। তবে এটিও বিবেচনা করতে হবে, আমরা কোন ধরনের উইকেটে খেলছি। আমরা সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র টেস্ট দল, যাদের ব্যাটসম্যানরা কোনো টেস্টেই ব্যাটিং সহায়ক উইকেট পায় না। দেশে আমরা খেলি টার্নিং উইকেটে, বিদেশে তো সবুজ বা বাউন্সি, কিংবা কঠিন উইকেট থাকেই। এমনিতে ১০ ইনিংসে ৩ বার ভালো করলে হয়তো আমরা বলি যে ব্যর্থ। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময় যে ধরনের উইকেটে খেলি, ৩৫ গড়ও অনেক ভালো।
এসব উইকেটে খেলে রান করলে তৃপ্তি কি বেশি আসে না? হয়তো খুব বড় রান নয়, কিন্তু দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ!
গত ২-৩ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে দেশের মাটিতেও আমাদের জন্য খেলা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। ওপেনারদের জন্য তো আরও কঠিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেল, পেস বল ছোবল দিচ্ছে। দেশের মাটিতে যেরকম উইকেট, নতুন বলে স্পিন খুব ভয়ঙ্কর। এজন্যই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওর যে ৭১ ও ৭৮ রানের দুটি ইনিংস (২০১৭ সালে), ওর অনেক বড় ইনিংসের চেয়েও ভালো। আমি ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে ৪৮ ও ৩৯ রানের যে দুটি ইনিংস খেলেছিলাম, আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা দুটি ইনিংস। অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান তামিম। তবে সফল হলেই তো সবসময় সেরা নয়। অনেকের মতে তামিমই সেরা, অনেকের মতে মুশফিক। আপনাদের দুজনের চোখে সেরা কে?
মুশফিক: আমার কোনো সংশয় নেই। আপনি জিজ্ঞেস করুন বা যে কেউ, তামিমের মতো ব্যাটসম্যান এখনও বাংলাদেশে আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে কিনা সন্দেহ। আমি তো বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে দেখিনি। তামিমকে দেখেছি, ক্রমান্বয়ে নিজের ব্যাটিংয়ে যে উন্নতি সে করেছে, এটা অবিশ্বাস্য।
ওর ব্যাটিং দেখে আমিও অনেক শিখেছি। ওর সঙ্গে কথা বললে ব্যাটিংয়ের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। ওর ব্যাটিং দেখলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কখনও ওকে বলিনি, আমি কিন্তু ইউটিউবে ওর ভিডিও দেখি। কোহলি-স্মিথদের ব্যাটিংও দেখি, তামিমের ভিডিও অনেক দেখি। বিশেষ করে যখন রানে থাকি না। ওদের ব্যাটিং দেখলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আমার কাছে তাই যতবার জিজ্ঞেস করবেন, সেরার বিচারে ওর জায়গা কেউ নিতে পারবে না।
তামিম: কে সেরা, বলা খুবই কঠিন। আমি যেভাবে দেখি, দুজন পরস্পরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছি। আমি বলব না যে আমি এগিয়ে আছি, কিংবা মুশফিক এগিয়ে আছে। এখান থেকে কে ওপরে যাবে, সেটা নির্ভর করবে দুজনের ওপরই। এই বছরই যদি দেখেন, ও অনেক রান করেছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, দলের প্রয়োজনের সময় অনেক রান করেছে। এখন তাই বলব, দুজন পিঠেপিঠি। আশা করি, আগামী দুই-তিন বছরে স্পষ্ট হবে কে এগিয়ে।
ব্যাটসম্যান মুশফিকের সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা তামিমের কাছে কোনটি?
তামিম: ওর কম্পোজার। ওর একটি ব্যাপার আমি গত ২-৩ বছর ধরে দেখছি, পারিপার্শ্বিকতা যেটাই থাকুক, মুশি সবসময়ই একই ভাবে ইনিংস শুরু করে। এটা অনেক বড় ব্যাটসম্যানের লক্ষণ, বিরাট কোহলিকেও দেখবেন। মুশফিকের ইনিংস শুরু করার একটি ধরন আছে। রান সে ১০ করুক বা ১০০, প্রায় প্রতি ম্যাচেই একইভাবে শুরু করে। কেউ যদি একদিন এভিন লুইসের মতো শুরু করে, আরেকদিন মারভান আতাপাত্তুর মতো, তাহলে বুঝতে হবে কোনো ঝামেলা আছে। মুশফিক হয়তো একদিন ১০ বলেই ২০ করে ফেলে, আরেকদিন ২০ বলে ৫, কিন্তু ব্যাটিংযের ধরন, তার নিয়ন্ত্রণ একই থাকে। কিছুই বদলায় না। অনেক বড় ব্যাপার এটি।
মুশফিকের কাছে ব্যাটসম্যান তামিমের সবচেয়ে ভালো লাগার দিক?
মুশফিক: দুটি ব্যাপার সবচেয়ে ভালো লাগে। প্রথমত, সব বোলারকে খেলার জন্য প্রচুর সময় থাকে ওর হাতে। ১৪০-১৫০ কিলোমিটার গতির বোলারের বিপক্ষে ওর ব্যাটিং দেখলে মনে হয় ১২০ কিলোমিটার গতির বোলারকে খেলছে। সব বড় ব্যাটসম্যানেরই কিন্তু মূল বিশেষত্ব এটি, বল খেলার জন্য হাতে সময় থাকে অনেক। আগেই লেংথ পড়ে ফেলে। অনেক সময় বোলারের মনোভাবও পড়ে ফেলে।
আরেকটি যেটি ভালো লাগে, ওর শরীরী ভাষা। ওর শুরুর দিনগুলোর চেয়ে এখনকার শরীরী ভাষা পুরোই বদলে গেছে। এখন ওকে ব্যাট হাতে যেতে দেখলেই বোঝা যায়, এ যে যাচ্ছে, গিয়ে প্রতিপক্ষকে শাসন করবে। ওর হাঁটাচলা দেখেই আমি বুঝে ফেলি যে আজকে সে রান করবে। ওর ভেতরে কি চলে, সেটি তো জানি না। তবে বাইরের প্রকাশে থাকে দাপুটে।
দুর্বলতা যদি নাও বলা হয়, পরস্পরের ব্যাটিংয়ে উন্নতির জায়গা কোথায় দেখেন?
মুশফিক: তামিমের ব্যাটিংয়ের প্রায় সবকিছুই অনুসরণ করা মতো। এমনিতে উন্নতির তো শেষ নেই। ওর যে উন্নতি করার ক্ষুধা, এটি দারুণ। গত ২-৩ বছরে অনেক উন্নতি করেছে।
তবে ওর একটি চাওয়া পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করা। তার কাছে দলেরও চাওয়া থাকে লম্বা সময় উইকেটে। সম্প্রতি একটি ম্যাচে ৫০ ওভার খেলেছে (জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অপরাজিত ১৩০)। সেটি আরও নিয়মিত করতে হবে। ৫০ ওভার খেলা তো প্রতিদিন সম্ভব নয়, অন্তত ৪০-৪৫ ওভার যেন খেলতে পারে। একটা সময় ও কেবল একটি গিয়ারে ব্যাট করত। এখন পরিস্থিতি বুঝে গিয়ার শিফট করে। আর সঙ্গী ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে অনেক কথা বলে, যা আমাদের সাহায্য করে।
আমি সবসময়ই সাকিব ও তামিমের সঙ্গে ব্যাট করা উপভোগ করি। ওরা উইকেটে এত সক্রিয় থাকে, এত ইন্টেন্ট দেখায়, অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানের কাজ সহজ হয়ে যায়। এজন্যই ওর লম্বা ইনিংস নিয়মিত খেলা দরকার, যত লম্বা সময় উইকেটে থাকবে, অন্য ব্যাটসম্যানের কাজও সহজ হবে।
তামিম: ব্যাটিংয়ে উন্নতির কথা বললে আসলে দুই জনেরই অনেক জায়গা আছে। দুজনের কেউই এখনও পারফেক্ট নই। এমন নয় যে সব জিনিসই আমরা সঠিক করছি। মুশফিক যেমন জানে, তার উন্নতি কোথায় দরকার, আমিও জানি নিজেরটা।
এমন যদি জানতাম যে কোনো ঘাটতির জায়গা আছে, জেনেও মুশফিক কাজ করছে না, তাহলে আঙুল তোলার অবকাশ থাকত। মুশফিক আদর্শ একজন। আমরা সবসময় বাইরের ক্রিকেটারদের উদাহরণ দেই। কিন্তু আমি সবসময় বলি মুশফিককে আদর্শ মানা উচিত। ঘাটতি জেনেও কিছু করছে না, এরকম কিছু মুশফিকের ভেতর দেখিনি। এটিই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনাদের দুজনের সম্পর্কও দারুণ। এই রসায়ন জমল কিভাবে?
মুশফিক: আমরা অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে একসঙ্গে খেলছি। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে নিয়মিত খেলেছি। এছাড়া হাই পারফরম্যান্স বা বিভিন্ন দল, সব জায়গায় একসঙ্গে ছিলাম। দুজনের বোঝাপড়া ভালো। ওর চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনা মিলে ভালো।
তামিমের একটি দারুণ ব্যাপার আছে যে, নিজে যা জানে, নতুন যা জানে বা দেখে, প্রতিপক্ষের কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতা, নতুন কোনো বোলার এলো, এসব নিয়ে কথা বলে। শুধু আমাকে নয়, সবাইকে জানায়। এমনিতে লোকে যেমন কিছু না জানলে গুগলে সার্চ করে, আমাদের দলে গুগল হচ্ছে তামিম। যে কোনো ব্যাপারে, সবকিছু সে জানে। সবাইকে সাহায্য করে। এটা আমার ভালো লাগে।
একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশ দলে মুশফিককে সবচেয়ে ভালো বোঝেন তামিম!
মুশফিক: হতে পারে। আমি আসলে সেভাবে প্রকাশ করতে পারি না। এটা অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, কাছের মানুষেরাও বলে, ভালোবাসলেও ঠিকভাবে বোঝাতে পারি না। মন থেকে দোয়া তাদের সবার জন্যই করি। তামিমের ক্ষেত্রেও একই।
তামিম: দেখুন, প্রতিটি মানুষের আলাদা ধরন থাকে। সবাই হাসিখুশি নয়, সবাই খুব রাগীও নয়। মুশির ক্ষেত্রে আমি যেটা বুঝি, লোকে ওকে না চিনেই ওর সম্পর্কে ধারণা করে। কিছু মানুষের মুড সুইং করতে পারে, কিছু মানুষ আবার সারাদিন হাসাহাসি করবে বা প্রাণবন্ত থাকবে, এটাই তো হয়। ওর ক্ষেত্রে সবসময় আমি মনে করি, ওকে কাছ থেকে না দেখে, না বুঝে ওকে বিচার করে।
ওর সঙ্গে যে আমার কোনো সময় ঝগড়া হয়নি, কথা কাটাকাটি হয় না বা কথা বন্ধ হয়নি, এমন নয়। বন্ধুদের এসব হয়ই। প্রতিটি সফরেই ওর সঙ্গে আমার অন্তত একবার, কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা লাগেই। কিন্তু আমি একটি ব্যাপার খুব ভালো বুঝি যে মুশি কোন জিনিসটিতে কষ্ট পাবে আর কোন ব্যাপারটি আমি ওকে নির্দ্বিধায় বলতে পারব। একটা সম্পর্ক এভাবেই গড়ে ওঠে। আমি বিশ্বাস করি যে আমি ওকে ভালো বুঝি।
অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার সময় আমরা রুমমেট ছিলাম। অনেক সময় কাটিয়ে, এসব কারণে সম্পর্ক হয়েছে। ওকে আমি নিজেকে দিয়েও ভালো বুঝি। অনেক লোকে আমাকে অ্যারোগ্যান্ট ভাবে। কিন্তু তারা কাছ থেকে দেখেওনি। যারা আমাকে চেনে, তারা জীবনেও এটা বলবে না। তেমনি মুশির অ্যাটিটিউড সমস্যা আছে কিনা, সেটা তারাই বলতে পারবে, যারা ওকে চেনে। প্রত্যেকটি মানুষ তো একইরকম প্রাণবন্ত হয় না। সেটা হওয়া জরুরিও নয়, খারাপ কিছুও নয়। লোকে না জেনেই ধারনা নিয়ে বসে থাকে।
ক্রিকেটারদের অনেকেই বলেন, মুশফিককে কেউ কিছু বলতে না পারলেও তামিম পারেন। সেই অধিকার তামিম কিভাবে পেলেন?
মুশফিক: বন্ধুত্ব তো আসলে বিশ্বাস থেকে আসে। ওর ওপর আমার একটা বিশ্বাস আছে যে ওর সঙ্গে সবকিছু নিরাপদে ভাগাভাগি করা যায়। নির্ভরতার একটি জায়গা। মনের কথা বলার জন্য খুব বেশি মানুষ তো পাওয়া যায় না। সেই সম্মানের জায়গা থেকেই তামিম অনেক কিছু বলতে পারে।
তামিম: আপনি যদি কাউকে কোনো চিন্তা ছাড়াই কিছু বলতে পারে, সেটিকেই বলে বন্ধুত্ব। যদি বলার আগে দশ বার ভাবতে হয়, তাহলে তো সেটি বন্ধুত্ব হলো না! আমাদের মধ্যে এই দ্বিধার ব্যাপার নেই।
দুজনের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে?
মুশফিক: প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত আমি অনূর্ধ্ব-১৫ খেলার সময়। তখন একদম এই এতটুকুন ছিল। আমি যে খুব বড়, তা নই। তবে ও একদম ছোট্ট ছিল। কেউ একজন বলল, “এই ছেলেটা খুব ভালো ব্যাটিং করে, উঠে আসছে।” কোথায়, কি জন্য ছিলাম আমরা, এত কিছু মনে নেই।
তামিম: আমার ওর সঙ্গে প্রথম কথা বা পরিচয় হলো বিকেএসপিতে, অনূর্ধ্ব-১৫ খেলার সময়। ওর একটা ব্যাট ছিল, ব্রায়ান লারা ৪০০ লেখা ব্যাট। তখন ও পেস বোলিং করত। স্টিভ হার্মিসনের মতো লাফ দিয়ে বোলিং করত।
সেবার খুব খাতির হয়নি। ওই ক্যাম্পে কিছুদিনের জন্য ছিল। সিরিজটি খেলেনি। পরে অনূর্ধ্ব-১৭ তে আবার দেখা হলো। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার সময় থেকে সম্পর্ক ভালো হতে থাকে।
১৭ বছর বয়সে লর্ডসে যখন মুশফিকের টেস্ট অভিষেক, তামিম তখন কোথায় ছিলেন? আপনাদের একেজনকে টেস্ট খেলতে দেখার অনুভূতি কেমন ছিল?
তামিম: যতটা না খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মেজাজ খারাপ। ওই সময়টা সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। বয়সটা এমন ছিল, মনে রঙ লেগেছিল। ঘোরাফেরা করতাম, রাত ৩টা, ৪টায় নেভাল বিচে যেতাম, গাড়িতে গান বাজিয়ে বেড়াতাম। ক্রিকেট নিয়ে এতটা সিরিয়াস ছিলাম না।
ওই সময় নাফিস ভাইয়া (বড় ভাই ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল) আমাকে ডেকে অনেক কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন যে, ‘তোমার সঙ্গে খেলা একজন টেস্ট খেলছে, তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো, লজ্জা হওয়া উচিত’, বড় ভাইরা যেভাবে শাসন করে আর কী। সেই বয়সে এসব তো ভালোলাগার কথা নয়। মুশফিকের ওপর মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে এখনই খেলতে হবে কেন!
আমি তখন আসলে ক্রিকেট থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছিলাম। ওর সঙ্গে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। পরে আবার পথে ফিরলাম। প্রিমিয়ার লিগে দেখা হলো। আবার সম্পর্ক হলো। জাতীয় দলে আসার পর সম্পর্ক শক্ত হলো।
তামিম যখন জাতীয় দলে এলেন ২০০৭ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে, মুশফিকের মনে পড়ে সেই সময়টা?
মুশফিক: অবশ্যই। আমার তো খুবই ভালো লেগেছিল। পুরোনো বন্ধু বলেই কেবল নয়। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ব্যাচটি তো অসাধারণ ছিল। যুব বিশ্বকাপে আমরা প্রত্যাশিত ফল করতে পারিনি, কিন্তু দারুণ সব ক্রিকেটার ছিল। ওরা যখন জাতীয় দলে আসতে শুরু করল, খুব ভালো লাগছিল। সাকিব এলো, আমি, তামিম, আমরা একসঙ্গে ২০০৭ বিশ্বকাপে গেলাম। ভালো করলাম। সবই দারুণ স্মৃতি। তখনকার তামিম কি ছিল, আর এখনকার তামিম কী!
কি ছিল তখনকার তামিম?
তখন খুব মজার সময় ছিল। টেনশন ছাড়া ক্রিকেট খেলেছি। বাতাসে উড়েছি, ছুটোছুটি করেছি। অনেক উপভোগ করেছি। এখনও উপভোগ করি, সঙ্গে দায়িত্বও আছে। দায়িত্ব সবার কাছে আসে না। দায়িত্ব পাওয়াও অনেক বড় সম্মান। আমরা সবাই এখন অনেক পরিণত। আমার ও তামিমের বন্ধুত্বও আরও ভালো হয়েছে।
দুজনই পরস্পরকে অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আগে। সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে যেটা থেকে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?
মুশফিক: ওর অনেক কিছুই আমি মানার চেষ্টা করি। ও যতটা সহজে খেলাটা নিয়ে ভাবে, এটা অনেক বড় একটি ব্যাপার। রানে না থাকলে অনেক বাজে চিন্তা মনে আসে। কিন্তু ওইটা নিয়ে চলতে থাকলে বেরিয়ে আসা আরও কঠিন। তামিম খুব ভালো জানে কিভাবে সেটি কাটিয়ে উঠতে হয়। ওর মনেও যে বাজে ভাবনা আসে না, তা নয়। তবে প্রক্রিয়াটা জানে ও।
আমাদের পুরো ব্যাটিং ইউনিট পারফর্ম করা শুরু করেছে আসলে তামিম নিজের খেলা পরের পর্যায়ে নেওয়ার পর, অসাধারণ পারফর্ম করার পর। তামিম ও সাকিব যখন ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে শুরু করল, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, আমি কেন ওদের কাছাকাছি যেতে পারব না! আর আমরা কয়েকজন যদি এভাবে চেষ্টা করি, দলও পরের পর্যায়ে যাবে। এভাবেই কিন্তু আমি নিজের ভেতর তাড়নাটা পেয়েছি। তামিম না পারলে তাই আমার ভেতরে বিশ্বাসটা হয়তো কখনও আসতো না।
তামিম: অন্য ক্রিকেটারদের এরকম ঘটনা হয়তো খুঁজে বের করা যায়। কিন্তু মুশির একটি কথা বলার উপায় আমার নেই। আমি সবসময়ই বলে আসছি, ওর সবকিছুই অনুপ্রেরণার। বাংলাদেশের কেউ যদি সত্যিকারের আইডল হতে পারে, সে একমাত্র মুশফিকই। আইডল এই ক্ষেত্রে যে, একটা বাচ্চা বা কিশোর যদি বড় ক্রিকেটার হতে চায়, কোন পথে এগোলে সেটি হতে পারে, সেটির আদর্শ উদাহরণ মুশফিক। সিম্পলি বলি, আমার ছেলে যদি ক্রিকেটার হতে চায়, আমি বলব আমাকে নয়, মুশফিককে অনুসরণ করতে।
পরস্পরের চোখে আপনাদের দুজনের সেরা ইনিংস কোনটি?
তামিম: গত এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৪৪। অবিশ্বাস্য ইনিংস। আরেকটা ইনিংসও ছিল স্পেশাল, ২০১২ এশিয়া কাপে ভারতকে হারানো ম্যাচে ২৫ বলে অপরাজিত ৪৬। ও একটা কথা বলল না, আমাকে ও সাকিবকে দেখে ওরা বিশ্বাস পেয়েছে? তেমনি আমরা যে ২০ বলে ৫০ রান তাড়ায় জিততে পারি, সেটি বিশ্বাস করিয়েছে ওর ওই ইনিংস। তার আগে ওর অধিনায়কত্বে প্রথম টি-টোয়েন্টিতেও দারুণ একটি ইনিংস খেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (২৬ বলে অপরাজিত ৪১)।
তবে ১৪৪ অবশ্যই সেরা। পরিস্থিতিটাই ছিল সেদিন অন্যরকম। শুরুতে দুটি উইকেট হারানো, এরপর ইনজুরিতে আমার বেরিয়ে যাওয়া। একাই দলকে টেনেছে ও। সেঞ্চুরির পর এবং আমি এক বলের জন্য ফেরার পর যে ব্যাটিংটা করল, শুধু ওর সেরা ইনিংস নয়, এটি আমার দেখা অন্যতম সেরা ইনিংস।
মুশফিক: ওর একটি-দুটি ইনিংস আলাদা করা মুশকিল। আমি এগিয়ে রাখব ২০১০ সালের ইংল্যান্ড সফরে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেঞ্চুরি। প্রথম সেঞ্চুরি নিয়ে আলোচনা বেশি, কারণ লর্ডসে ছিল এবং বলে কয়ে সেঞ্চুরি করেছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড এমন দল, যারা খুব ভালো পরিকল্পনা সাজায় এবং তা কাজেও লাগায়। লর্ডসের সেঞ্চুরির পর তারা নিশ্চয়ই অনেক ছক কেঁটেছিল। কন্ডিশন কঠিন তো ছিলই। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছিল আবহাওয়া। সব মিলিয়ে অসাধারণ সেঞ্চুরি ছিল।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরির কথাও বলতে হবে। আমি মনে করি, টেস্টে আমাদের সেরা ইনিংস। যদিও খুলনার উইকেট ব্যাটিং সহায়ক ছিল, কিন্তু আমরা প্রথম ইনিংসে ভালো করিনি। অনেক পেছনে ছিলাম। পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণও দারুণ ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে সেখানে ডাবল সেঞ্চুরি করে ম্যাচ বাঁচানো ছিল অভাবনীয় কিছু।
মুশফিকের নেতৃত্বের একটা পর্যায়ে সহ-অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলেন তামিম ইকবালকে। কেমন ছিল দুই বন্ধুর সময়টা?
মুশফিক: অধিনায়ক হিসেবে আবার সময় তো কঠিনই ছিল। বিশেষ করে ২০১৪ সালে অনেক ম্যাচ কাছে গিয়ে হারায় খুব খারাপ হয়েছিল।
তামিমকে আমি পাশে পেয়েছি সবসময়ই। সহ-অধিনায়ক থাকুক বা না থাকুক, পরামর্শ দিয়ে, কৌশল দিয়ে, পরিকল্পনা দিয়ে। ওর একটা ব্যাপার আছে, কিছু একটা ভাবলে সেটি ক্লিক করে যায় অনেক সময়। ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের ম্যাচে কাইরন পোলার্ড অনেক মারছিল, সব বোলারকেই। তামিম বলল মুমিনুলকে নিয়ে আয়। মুমিনুল এসে পোলার্ডকে বোল্ড করে দিল। এভাবে নানা সময়ই সাহায্য করেছে।
অধিনায়ক মুশফিকের অনেক সমালোচনা ছিল ও আছে। কিন্তু তামিম তখনও মুশফিকের অধিনায়কত্বের প্রশংসা করেছেন, এখনও করেন। কেন?
আমি মনে করি, যতটুকু ওর ভুল ছিল বা ছিল না, মিডিয়া ব্যাপারটিকে বড় করেছে। আমাদের মিডিয়ায় দেখা যায় কেউ একটি কিছু বললে বা লিখলে আরও অনেকে অনুসরণ করতে থাকে। যেমন, ‘নেগেটিভ ক্যাপ্টেন্সি।’ কারও থেকে শুরু হয়েছে, তা ছড়িয়ে গেছে। মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও প্রবলভাবে ছড়িয়েছে।
আমি মুশফিকের নেতৃত্বে নেগেটিভ কিছু দেখিনি। বিশেষ করে পরের দিকে। আর নেগেটিভ ক্যাপ্টেন্সি করে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে পারলে সমস্যা কোথায়!
দুজনের একসঙ্গে মজার স্মৃতি অবশ্যই অনেক আছে। কোনো একটি-দুটি ভাগাভাগি করা যায় এখন?
তামিম: স্মৃতি তো অসংখ্য আছে। সেসব বলছি না। স্রেফ একটি কথা বলছি, ওর প্রতি বন্ধু হিসেবে বা মানুষ হিসেবে তো বটেই, আমার অধিনায়ক হিসেবেও দারুণ সম্মান আছে। আমার খারাপ সময়ে ও প্রকাশ্যে আমাকে সমর্থন দিয়েছে। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। জীবনে কখনও ওর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলেও এই সম্মানবোধ থাকবে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি ক্রিকেটের কোনো কিছুই বলি না সাধারণত। কিন্তু মুশফিকের এই কথা আমি স্ত্রীকেও বলেছি যে কখনোই ভুলব না।
মুশফিক: মজার ঘটনা অনেক আছে। একটা ব্যাপার বলি, আমার বন্ধু হলেও, যখন ওর বিপক্ষে খেলি, তখন ওকেই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা যায়। স্লেজিং করে হোক, বোলারকে কিছু বলে হোক, নানাভাবে আউট করতে চায়। আমাকে আবার কেউ স্লেজিং করলে বা উল্টাপাল্টা কথা বললে সেটি আমার ভালো লাগে। কারণ ভেতরে একটা জেদ চাপে। আর আমি একটা চার মারলে ওর চেহারা হয় দেখার মতো, পারলে বোলারকে খেয়ে ফেলে!
আর আমি আউট হলে ওর সেলিব্রেশন হয় দেখার মতো। যেন দুনিয়া জয় করে ফেলেছে। ও আউট হলে আমি কিন্তু তেমন উল্লাস করি না। ও তো খুশিতে পাগল হয়ে যায়। ওকেই জিজ্ঞেস করেন, কেন এসব করে!
তামিম: ওকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাই সাধারণত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে বা বিপিএলে। এখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে ওর উইকেট তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়! ও সব বোলারদেরই স্বচ্ছন্দে খেলে। এজন্যই ওকে যে কোনোভাবে আউট করতে চাই। আর আউট হলে সেলিব্রেশন দিয়েই এটা বুঝিয়ে দিতে চাই যে দারুণ খুশি হয়েছি!
ক্যারিয়ার শেষে দুজন পরস্পরকে কোথায় দেখতে চান?
তামিম: আমি চাই মুশি অন্তত ২০টি টেস্ট সেঞ্চুরি করুক। ১০ হাজার ওয়ানডে রান করুক। টেস্টে ১০ হাজার করা কঠিন হবে, কারণ আমরা টেস্ট কম খেলি। তবে বাংলাদেশের কেউ টেস্টে ১০ হাজার করলে সেটি মুশফিকই করবে। আমি পারব না, কারণ আমার মনে হয় আমি খুব বেশি দিন খেলব না। মুশফিক যতটা ফিট, যতটা নিবেদন তার এবং টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা, ও আরও অনেক বছর টেস্ট খেলবে। আর ওয়ানডেতে ও ১০ হাজার রান করতে না পারলে আমি হতাশ হব।
মুশফিক: তামিম তো ১২ হাজার আন্তর্জাতিক রান করে ফেলেছে। আমি ওর কথার সঙ্গে একমত নই, টেস্টে ১০ হাজার রান তামিমই আগে করবে। ১০ হাজার হোক বা যত রান, আমার ধারণা টেস্টে আমাদের সর্বোচ্চ রান ওরই থাকবে, আমি চেষ্টা করব কাছাকাছি যাওয়ার। ওয়ানডে আর টেস্ট দুটিতেই ওর আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে সেরা পাঁচে থাকা উচিত।