ঘণ্টাখানেকের নেট সেশন। বোলিং মেশিনে ব্যাটিং। প্র্যাকটিস শেষে ইনডোর থেকে ব্যাট হাতে বেরিয়ে নাসির হোসেনের মুখে হাসি, “আমি কিন্তু ফর্মে আছি…!” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিজেই ভাঙলেন রহস্য, “শেষ ম্যাচেও তো সেঞ্চুরি করলাম!” নাসিরের মজাটা বোঝা গেল এতক্ষণে। শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন বটে, তবে সেটা প্রায় ৮ মাস আগে! সেই ম্যাচের পর এ দিনই প্রথম ব্যাট হাতে নিলেন চোট কাটিয়ে ফেরার লড়াইয়ে থাকা অলরাউন্ডার।
Published : 25 Nov 2018, 06:25 PM
গত ৫ এপ্রিল, সেই ম্যাচ ছিল বিকেএসপিতে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর শিরোপা জয়ের ম্যাচে করেছিলেন ৯১ বলে ১২৯। লিগ শেষে সিরাজগঞ্জে এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে ফুটবল খেলার সময় চোট পান হাঁটুতে। আনুষ্ঠানিকভাবে যদিও বরাবরই বলা, চোট পেয়েছেন ফিটনেস ট্রেনিংয়ের সময়।
ঘটনা আড়াল করলেও বাস্তবতা বদলানো যায়নি। স্ক্যানে ধরা পড়েছিল হাঁটুর দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। অস্ত্রোপচার করাতে অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তার ডেভিড ইয়াংয়ের কাছে যাওয়ার পর দেখা গেল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মিনিস্কাসও। গত ৮ জুন মেলবোর্নে এক হাঁটুতেই তাই তিনটি অস্ত্রোপচার হলো ৪ ঘণ্টা ধরে। ২২ জুন ফেরেন দেশে।
দেশে ফেরার পর শুরুর হয় নাসিরে মাঠে ফেরার অভিযান। শুরুতে কিছুদিন শুয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না। এরপর ধীরে ধীরে কিছু এক্সারসাইজ, ফিজিওথেরাপি, জিম করার শুরু। সপ্তাহ দুয়েক আগে শুরু করেছেন রানিং। রোববার দুপুরে ফিরলেন ব্যাটিংয়ে। শুরুর দিনে কেবল বোলিং মেশিনে হালকা গতির বল খেলেছেন।
নেট সেশন শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন ফেরার লড়াইয়ে তার অগ্রগতি।
“এখন ৭০-৮০ ভাগ দিয়ে রানিং করছি। আরও সপ্তাহ দুয়েক পর শতভাগ গতিতে রানিং করতে পারব। ব্যাটিং শুরু করলাম, বোলিং এখনও শুরু করিনি। আপাতত এভাবে বোলিং মেশিনে নক করব সপ্তাহখানেক। তার পর আস্তে আস্তে মেশিনের গতি বাড়াব। এরপর নেটে স্পিন, পরে পেস খেলব। এভাবে এগোব।”
ফেরার কয়েক ধাপ
ক্রিকেট শুরুর পর থেকে এত দীর্ঘ সময় ব্যাট-বলের সঙ্গে বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা আগে হয়নি কখনও। চোটের শুরুর দিনগুলো তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় পুড়েছেন। জানালেন, কষ্ট আরও বেশি হবে বলে এই সময়ে ব্যাট ছুঁয়েও দেখেননি।
“অস্থির লাগত সেই সময়ে। প্রিমিয়ার লিগের শেষ ম্যাচের পর আজকেই ব্যাট ধরলাম। মাঝের সময়টায় ব্যাটের দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। আজকেই ব্যাগ খুলে ব্যাট ধরলাম। খেলার চেয়ে বেশি অস্থির লাগত রানিং শুরু করার জন্য, যেহেতু পায়ের ইনজুরি ছিল। রানিং শুরু করার পর স্বস্তি পেয়েছি।”
“সময়টা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। প্রতিটি ক্রিকেটারই ইনজুরি হওয়ার পর বুঝতে পারে কতটা মিস করে ক্রিকেটকে। আমি অনেক মিস করেছি। আজ ৮ মাস পর ব্যাট করলাম। আমি অনেক অপেক্ষা করে ছিলাম দিনটির জন্য। দিন গুনেছি কবে ব্যাট করব, কবে বল করব, রানিং করব।”
এই দীর্ঘ বিরতি প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছে তার মানসিকতায়। নাড়িয়ে নিয়েছে ক্রিকেটার নাসিরের সহজাত সত্তায়। অনাভ্যাসে বিদ্যা হ্রাসের অভিজ্ঞতা হলো ব্যাটিং ফেরার দিনটিতে।
“আজকে যখন প্যাড পরছিলাম, নতুন লাগছিল নিজের কাছে। ব্যাট ধরে আমি স্টান্স নিয়েছি, মনে হচ্ছিল আগে কি এভাবেই দাঁড়াতাম? নাকি বদলে গেল! মাথার ভেতর অনেক কিছু চলছিল। দুই-তিন বল খেলার পর বল মাঝ ব্যাটে লাগছিল। এরপরও বুঝছিলাম না যে হাত ঠিক যাচ্ছে কিনা, পা ঠিক আছে কতটা।”
ফেরার একটি ধাপ পূরণ হয়েছে। বড় আরও কয়েক ধাপ সামনে। পুরোদমে কবে নেট সেশন শুরু করবেন, সেটার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নিশ্চিত নয় এখনও। তবে মাঠের লড়াইয়ে ফেরার একটি ছবি মোটামুটি এঁকে নিয়েছেন নিজের মনে।
“অপারেশনের পর বিপিএল দিয়ে ফেরারই টার্গেট ছিল। আশা করি, বিপিএল শুরুর আগে ফিট হতে পারব। বিপিএল আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। এখানকার পারফরম্যান্সের ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে।”
দুঃসহ দিন-রাত্রি
পেশাদার ক্রীড়াবিদদের জন্য এত লম্বা সময় মাঠের বাইরে থাকার চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই। গত প্রায় ৮ মাসে সেই সত্যিটা প্রতিটি দিন অনুভব করেছেন নাসির। “ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খারাপ সময়?” প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই নাসিরের যন্ত্রণামাথা উত্তর, “জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়...আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ২০১৮ সাল। ইনজুরিসহ বাকি সব মিলিয়ে সবচেয়ে খারাপ।”
তবে কষ্টের দিনগুলিতে নিজের অবলম্বন হয়েছেন নিজেই। খুঁজে নিয়েছেন সান্ত্বনা, “ক্রিকেট অনেক ভালোবাসার জায়গা। বাবা মায়ের পর ক্রিকেটই আসে। তাই খুব খারাপ লেগেছে। দল থেকে বাদ পড়ে বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা একরকম। ইনজুরির কারণে বাইরে থাকা অন্য। খারাপ তো অবশ্যই লেগেছে। মাঠ থেকে দূরে ছিলাম, জাতীয় দল, জাতীয় লিগ, সব খেলা থেকে দূরে...সবাই খেলছে, আমি বাইরে।”
“আমি নিজেকে বুঝিয়েছি যে কপালে ছিল, হয়েছে ইনজুরি। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। সামনে নিশ্চয়ই ভালো হবে। এখন ফেরার চেষ্টায় আছি। চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ফেরার।”
কঠিন এই সময়টায় জগতের অনেক বাস্তবতাও আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন নাসির। সত্যিকারের আপন ও পরকে চিনতে পেরেছেন। নিজেকেও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। নিজেকে তাই এখন মনে করেন আগের চেয়ে আরও পরিণত।
“এই সময়টা শিখিয়েছে অনেক। ২০১৮ সালে অনেক কিছু এসেছে আমার জীবনে। একটা পর্যায়ে আমার খেলা, আমার জীবন, সব নিয়েই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমার খেলা বলেন, বা ক্যারিয়ার, ক্রিকেটের কারণেই আমি আজকের নাসির, যতটুকু হতে পেরেছি। এটা থেকে দূরে থাকা ছিল কষ্টের।”
“চেষ্টা করেছি একা না থাকতে। একা থাকলে বেশি খারাপ লাগত। চেষ্টা করেছি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকতে। আজীবন ভুলব না, এই কঠিন সময়ে যারা আমাকে স্মরণ করেছেন। আর স্মরণ করেনি যারা, ভুলব না তাদেরও।”
আশার ভেলা
অস্ত্রোপচারের পর মাঠ থেকে দূরে থাকার অধ্যায়টাই সবচেয়ে কষ্টের। সেটুকু পার করে ফেলেছেন নাসির। মাঠের প্রক্রিয়াগুলোয় এগোচ্ছেন একটু একটু করে। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছেন আত্মবিশ্বাসও। নিজেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ফিরবেন আরও শক্তভাবে।
“কিছু কিছু মানুষ আছেন, কঠিন সময়ে আরও শক্ত হয়। কিছু ক্রিকেটারকে আমি দেখেছি, ইনজুরির পর আরও ভালোভাবে ফিরে আসে। আমারও ইচ্ছে আছে ভালোভাবে ফিরব। ৮ মাস অনেক সময়। আমি এই সময় খেলা দেখেছি, নিজেরটা বুঝেছি। আমার ইচ্ছে আছে, কয়েকদিন পর বিকেএসপি চলে যাব। ওখানে ক্যাম্পের মতো করে থেকে প্র্যাকটিস করব। ক্যাম্পের আবহে থাকারই ইচ্ছা আছে। চেষ্টা করব ভালোভাবে ফেরার।”
জাতীয় দলে সবশেষ খেলেছেন গত জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। কয়েক মাস পরই বিশ্বকাপ। কিন্তু জায়গা ফিরে পাওয়া কতটা কঠিন হবে, জানেন নিজেও। তার মতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে বাদ পড়াদের জন্য ফেরা আরও কঠিন।
“জাতীয় দলে ঢোকা নতুন ক্রিকেটারদের জন্য এখন সহজ। আর আমাদের মতো যারা, খেলে জাতীয় দলের বাইরে চলে গেছে, তাদের জন্য ফেরা কঠিন। নতুনরা কোনো একটু পারফর্ম করলে, কোথাও ভালো খেললে চোখে পড়ে বেশি। আর আগে খেলে যারা বাদ পড়েছে, ওরা ভালো খেললেও সেভাবে চোখে পড়ে না। কারণ হতে পারে তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকে বেশি। আমি দলের বাইরে আছি। ফিরতে হলে নতুনদের চেয়ে অনেক ভালো খেলে ফিরতে হবে।”
তবে সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ জয়ের আশা নিয়েই ছুটছেন প্রতিদিন। চেষ্টা করছেন একটু করে উন্নতির। খুব বেশি দূর না তাকিয়ে তাই এগোতে চান প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে।
“ফেরা কঠিন মানে এই না যে খেলতে পারব না। জাতীয় দল সবার জন্যই উন্মুক্ত বলে আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয় না কেউ পারফর্ম করলে তাকে বাইরে রাখা যাবে।
“আপাতত শতভাগ ফিট কত দ্রুত হতে পারি, সেটাই ভাবছি। তার পর পারফর্ম করতে পারলে ডাক আসবেই। আমার বিশ্বাস আছে। চেষ্টা করব পারফর্ম করেই জায়গা ফিরে পেতে।