ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সন্দেহজনক দুটি আউট নিয়ে চলছে তোলপাড়, ক্ষুব্ধ দেশের সাবেক-বর্তমান অনেক ক্রিকেটারও।
Published : 10 Apr 2025, 04:10 PM
‘এমন অভিনয় করে খেলা… সেই অভিনয়ও কত কাঁচা...’- এটুক বলে হাসি যেন থামেই না রাজিন সালেহর। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের দুই ব্যাটসম্যানের আলোচিত আউট নিয়ে বলছিলেন অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের প্রধান কোচ। সেখানেই বলতে বলতে আক্ষেপ আর হতাশা মেশানো হাসি জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কের।
শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বুধবার গুলশান ক্রিকেট ক্লাব ও শাইনপুকুর ম্যাচের এসব ঘটনা নিয়ে দেশের ক্রিকেটে হইচই পড়ে গেছে। সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় চলছে, সন্দেহের তির ছুড়ছেন সাবেক-বর্তমান অনেক ক্রিকেটার। নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দেওয়া ওই দুই আউট নিয়ে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে বিসিবি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বোর্ডের ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমুল আবেদীন জানান, তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিষয়টি।
“গুলশান ক্রিকেট ক্লাব ও শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচের দুটি আউট বিসিবির নজরে এসেছে। এই বিষয়ে এরই মধ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় এনে তদন্ত করা হবে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজন হলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই।”
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট পরিচালনা করে বিসিবির যে কমিটির, সেই ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন চৌধুরি জানালেন, প্রিমিয়ার লিগের টেকনিক্যাল কমিটি ও বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগ (অ্যান্টি করাপশন ইউনিট) পুরো ঘটনার তদন্ত করবে।
“আমরা এরই মধ্যে এই বিষয়ে প্রিমিয়ার লিগের টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এটি নিয়ে কাজ করছে। একইসঙ্গে বিসিবির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটও (আকু) কাজ করেছে। আমরা আপাতত আকুর তদন্তের অপেক্ষা করব।”
“এসব বিষয়গুলো আসলে সরাসরি বোর্ড বা সিসিডিএমের দেখার ব্যাপার নয়। সব কিছু বিচার বিবেচনা করে যথাযথ তদন্তের পর টেকনিক্যাল কমিটি বা আকু যেটা সুপারিশ করে, আমরা সেটা বাস্তবায়ন করি।”
সাবেক বাঁহাতি স্পিনার ও বিসিবির আম্পায়ারদের কোচ এনামুল হক মনিকে আহ্বায়ক করে প্রিমিয়ার লিগের টেকনিক্যাল কমিটিতে আছেন সাবেক ক্রিকেটার ও ম্যাচ রেফারি সেলিম শাহেদ ও অভি আব্দুল্লাহ আল নোমান। তারা ম্যাচের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে কাজ করবেন।
ম্যাচের স্বচ্ছতার বিষয়গুলো দেখভাল করবে দুর্নীতি দমন বিভাগ। এর মধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা। অভিযুক্ত দুই ক্রিকেটারকে বৃহস্পতিবার ডেকেছেন বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রধান রাইয়ান আজাদ। একাডেমি মাঠে আউট দুটির পুনঃমঞ্চায়ন করা দেখা হয়েছে
আলোচিত দুই আউটের প্রথমটি শাইনপুকুরের ইনিংসের ৩৬তম ওভারে। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলার চেষ্টা করেন রহিম আহমেদ। কিন্তু অনেক বাইরে থাকা বলের কাছে যাওয়ার কোনো চেষ্টা ছিল না তার। উইকেটরক্ষক বল ধরেছেন কি না, সেটিও না দেখে সোজা ড্রেসিং রুমের পথে হাঁটা ধরেন তিনি।
এর চেয়েও দৃষ্টিকটূ ও সন্দেহজনক ঘটনার জন্ম হয় দশম উইকেটে। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে বল করেন নাঈম ইসলাম। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে বল খেলা বা কাছেও যাওয়ার কোনো তাড়না দেখাননি মিনহাজুল আবেদিন সাব্বির। ক্রিজের বাইরে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন তিনি। ফেরার কোনো চেষ্টাই করেননি। বল গ্লাভসে নিয়ে প্রথম দফায় স্টাম্পের লাগাতে পারেননি গুলশানের উইকেটরক্ষক আলিফ হাসান ইমন। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় স্টাম্প ভাঙেন তিনি। পুরোটা সময় কাছ থেকে দেখলেও ক্রিজের ভেতরে ব্যাট রাখেননি সাব্বির। বরং তিনি যেন অপেক্ষা করছিলেন, কখন আউট করেন কিপার!
সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ রাজিন সালেহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, দেশের ক্রিকেটের জন্য এসব অশনী সংকেত।
“ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের জন্য খুবই লজ্জার ব্যাপার। যে কোনো ম্যাচে হার-জিত হতেই পারে। কিন্তু এভাবে অভিনয় করে খেলা... আর অভিনয়টাও তো একদম কাঁচা (হাসি)। দেশের শীর্ষ পর্যায়ে এভাবে খেলা আমরা আশা করি না। দেশের ক্রিকেটে এমন কিছু হওয়া মানে বাচ্চারা ভালো কিছু শিখছে না, ভালো বার্তা পাচ্ছে না। এভাবে এগোলে আমরা ভবিষ্যতের ক্রিকেটার কীভাবে পাব।”
প্রশ্নবিদ্ধ দুটি স্টাম্পিংয়ের পর মাত্র ১৭৮ রানের পুঁজি নিয়েও ৫ রানে জেতে গুলশান। নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের সুপার লিগের টিকেট। আর ম্যাচটি হারায় রেলিগেশন লিগে পড়ে গেছে শাইনপুকুর। অবনমন অঞ্চল এড়াতে তাদের জয়ের বিকল্প ছিল না।
গুলশানের জয়ে কঠিন হয়ে গেছে অগ্রণী ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লবের সমীকরণ। দুই দলের যে কোনো একটি হয়তো পাবে সুপার লিগে খেলার সুযোগ। অভিযোগ উঠছে, গুলশানকে সুপার লিগে তোলার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই হেরে গেছে শাইনপুকুর।
৩৬তম ওভারে রহিমের আউট দেখে অগ্রণী ব্যাংকের কোচ রাজিনও বুঝে গিয়েছিলেন, ম্যাচ জেতার চেষ্টা করবে না শাইনপুকুর।
“আমাদের দলের অনেকে আশায় ছিল শাইনপুকুর জিতবে। কিন্তু ৩৬তম ওভারের ঘটনা দেখে আমি বলে দিয়েছিলাম, ১ রানে হলেও হারবে শাইনপুকুর। সেটাই হয়েছে। শেষের আউটে তো সবাই দেখলাম। দুইবার সুযোগ ছিল ভেতরে ঢোকার। সে অপেক্ষা করছিল স্টাম্পে লাগানোর। বাংলাদেশের সেরা লিগে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।”
স্টাম্পিং দুটি নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুললেও সুপার লিগের টিকেটের জন্য নিজেদের ওপরই আস্থা রাখছেন অগ্রণী ব্যাংকের কোচ।
“আমরা আশা করি না যে, অন্য দল হারবে, তার ওপর নির্ভর করে আমরা সুপার লিগ খেলব। নিজের অর্জিত জিনিসের আনন্দটা আলাদা। আমরা জিতেই সুপার লিগ যেতে চাই। আমরা আশা করিনি যে, গুলশান হারুক বা ওরা হেরে তারপর আমরা সুপার লিগ যাব।”
“তবে গতকাল যেটা সবাই দেখলাম, গুলশান অবশ্যই ম্যাচটা হারত। শাইনপুকুরের অবস্থা ভালো ছিল। শেষের আউট নিয়ে বেশি আলোচনা। কিন্তু ৩৬তম ওভারে সে (রহিম) যেভাবে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেল, পাড়ার ক্রিকেটেও এমন হয় না।”
রাজিনের মতো উদার হতে চান না অগ্রণী ব্যাংকের অধিনায়ক ইমরুল কায়েস। সামাজিক মাধ্যমে স্টাম্পিংয়ের ভিডিও আপলোড করে গুলশান ও শাইনপুকুরের বিপক্ষে সাজানো ম্যাচ খেলার অভিযোগ তুলেছেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
“একটা দলকে সুপার লিগে উঠতে না দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আরেক মাঠে দুই দল নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছে! এটা কী ধরনের নাটক? আজকের সেই ম্যাচের ভিডিও প্রমাণসহ নিচে রয়েছে—আপনারা নিজেরাই দেখুন, বিচার করুন।”
“এই যদি হয় ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা, তাহলে ভবিষ্যতে জাতীয় দলে কারা খেলবে? কাদের হাতে আমরা তুলে দিচ্ছি দেশের পতাকা? যারা মাঠে নামার আগে ম্যাচের ফয়সালা করে নেয়, তাদের দিয়ে কী দেশের প্রতিনিধিত্ব হয়? লজ্জা! যাদের ব্যবহার করে এসব নোংরা খেলা খেলানো হচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ ওরা আজ নিজেরাই নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে।”
তবে রহিম বা সাব্বিরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পক্ষে নন ইমরুলদের কোচ রাজিন। বরং ক্লাব কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুললেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক।
“ছেলেরা যারা নতুন বা তরুণ আছে, ওরা নিজ থেকে এমন কিছু করার কারণ নেই। ওদের নিজেদের প্রমাণ করার জায়গা এই লিগ। ওরা এখানে ভালো খেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে। পারফর্ম করে জাতীয় দলে ঢোকার চেষ্টা করে।”
“এটা স্পষ্টই যে ক্লাব থেকে কোনো নির্দেশনা গিয়েছে। নয়তো এভাবে খেলা ছেড়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ছেলেরা পারফর্ম করার জন্য মরিয়া থাকে কিন্তু তাদের যদি বলা হয় যে পারফর্ম করিস না, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।”
বুধবারের ম্যাচ শেষে বাড়ি ফেরার পথে শাইনপুকুরের একাধিক ক্রিকেটারের কন্ঠেও শোনা যায় এসব আক্ষেপের কথা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ইচ্ছাকৃত আউটের বিষয়ে ক্লাব কর্মকর্তাদের নির্দেশনার কথা বলেন এক ক্রিকেটার।
“সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ছড়িয়ে গেছে। সবাই কত কিছু বলছে। আমাদের অনেক বড় ভাই (বর্তমান-সাবেক ক্রিকেটার) ভিডিও শেয়ার দিয়ে নানা কথা বলছেন। অথচ তারাই একসময় এসব কাজ করেছেন। যে কারণে এখন আমরা যারা নতুন আছি, তাদেরও অনেক কিছু করতে হয়। তারাই তো আসলে পথটা খুলে দিয়েছেন।”
“সাব্বিরের ক্যারিয়ারের জন্য এটা বড় একটা ধাক্কা নিশ্চিত। কিন্তু এটা কি নিজ থেকে করতে পারে? ক্লাব কর্মকর্তারা যদি নির্দেশনা না দিত, তাহলে তো ওর এরকম করার কথা না। সবাই এমনিতেই নামমাত্র পারিশ্রমিকে এবারের লিগ খেলছে। তার ওপর ক্লাবের কথার বাইরে গেলে তো টাকা পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।”
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের আগে সবশেষ বিপিএলেও একাধিক ম্যাচে দেখা গেছে সন্দেহজনক নানা কর্মকাণ্ড। সেসব নিয়ে দেশের ক্রিকেটে তোলপাড়ও হয়েছে অনেক। তবু বন্ধ হচ্ছে না কিছুই। ঘরোয়া ক্রিকেটে বারবার দেখা যাচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ সব ঘটনা।
ক্রিকেট মাঠে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে দুর্নীতি দমন বিভাগের কাজ নিয়ে তাই প্রশ্ন তুললেন রাজিন।
“একটা বিষয়ে আলাদা করে বলতে চাই, অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের কাজ আসলে কি? তারা শুধু ড্রেসিং রুমে বসে থাকবে, বাইরে এসে একটু হাঁটাহাঁটি করা, এতেই কাজ শেষ? শুধু তো প্রিমিয়ার লিগ নয়, এর আগে বিপিএলেও অনেক সন্দেহজনক কাজ দেখেছি। সবগুলোই তো ওপেন সিক্রেটের মতো। সেসব নিয়ে অ্যান্টি করাপশন কি করছে? এটা আমার বড় প্রশ্নের জায়গা।”
এত প্রশ্নের জন্ম দেওয়া ম্যাচটি আবার আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন ইমরুল।
“আমি জোরালভাবে দাবি জানাই- এদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা এই কাজে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। আর যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত আজকের ম্যাচ বাতিল করে পুনরায় রিশিডিউল করা উচিত।”
“বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এভাবে শেষ হতে দেওয়া যায় না। আজকে চুপ থাকলে, কাল হয়তো আর কিছু বলার সুযোগ থাকবে না।”