উপমহাদেশে প্রথমবার খেলতে নেমেই টার্নিং উইকেটে বাংলাদেশের স্পিনারদের এলোমেলো করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দুইশর বেশি লিড এনে দিয়েছেন এই কিপার-ব্যাটসম্যান।
Published : 22 Oct 2024, 02:59 PM
ইনিংসটি যেমন দর্শনীয়, উদযাপনও হলো তেমন আকর্ষণীয়। শতরান ছোঁয়া রানটি নেওয়ার মাঝপথেই দু হাত উঁচিয়ে ছুটতে থাকলেন কাইল ভেরেইনা। রান পূর্ণ করে অনেকটা দৌড়ে গেলেন তিনি ড্রেসিং রুমের দিকে। ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন ডাগ আউটের দিকে। পরে ব্যাট ফেলে দিয়ে করলেন কুর্নিশ। শেষ নয় সেখানেই। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে উল্লাস করতে করতে এগিয়ে গেলেন ক্রিজে থাকা সঙ্গী ডেন পিটের দিকে। ‘হাই ফাইভ’ হলো সজোরে, পরস্পরকে আলিঙ্গনে জড়ালেন প্রবল আবেগে।
পুরো সময়টাতেই তার মুখে ফুটে থাকল চওড়া হাসি। দীর্ঘ ও প্রগাঢ় সেই উদযাপনেই ফুটে উঠল, এই ইনিংসের মাহাত্ম্য তার কাছে কতটা।
মিরপুর টেস্টে ১১৪ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০২ রানের লিড এনে দিয়েছেন ভেরেইনা। বাংলাদেশের তিন স্পিনারকে এলোমেলো করে দিয়েছেন তিনি একের পর এক সুইপ আর রিভার্স সুইপে। তাকে থামানোর কোনো পথই খুঁজে পাননি বাংলাদেশের বোলাররা।
১৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ আগেও পেয়েছেন ২৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। ২০২২ সালে ক্রাইস্টচার্চে সাউদি-হেনরি-জেমিসন-ওয়্যাগনারদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পঞ্চাশের বেশি গড় সাড়ে ৫ হাজার রান আছে তার। সবশেষ ইনিংসেই ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে ১৪৮ রানের ইনিংস খেলেছেন ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে। তার পরও এই সেঞ্চুরিটি স্পেশাল। নিশ্চিতভাবেই তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। কন্ডিশন, উইকেট, প্রতিপক্ষ- সবকিছু মিলিয়েই এবারের চ্যালেঞ্জটি যে ভিন্ন!
বাংলাদেশে তো বটেই, উপমহাদেশেই তার প্রথম টেস্ট ইনিংস এটি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮৫ ম্যাচের ক্যারিয়ারে উপমহাদেশে আগে ম্যাচ খেলেছেন একটিই, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের হয়ে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকার একজন ব্যাটসম্যানের জন্য এত অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে উপমহাদেশে এসে এরকম স্পিন সহায়ক উইকেটে খেলাটা সবসময়ই ভীষণ কঠিন। ভেরেইনার কাজটা আরও কঠিন ছিল ম্যাচের পরিস্থিতির কারণেও।
তিনি যখন ক্রিজে যান, ৯৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তখন ধুঁকছে দক্ষিণ আফ্রিকা। মাত্রই ওভারে জোড়া উইকেটের পতন হয়েছে। তাইজুল ইসলাম তখন প্রায় প্রতি ডেলিভারিতেই ফণা তুলে ছোবল দিচ্ছেন যেন। একটু পরই রায়ান রিকেলটেনের বিদায়ে দলের রান হয়ে যায় ৬ উইকেটে ১০৮।
দুই দল তখন বলতে গেলে সমতায়। বাংলাদেশকে অল্প রানে গুটিয়েও স্বস্তিতে নেই দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে হবে তা তাদেরই। প্রথম ইনিংসে বড় লিড না নিতে পারলে অপেক্ষায় মহাবিপদ।
দলের সব দুর্ভাবনা দূর করার ভার বয়ে নিল ভেরেইনার ব্যাট। তার প্রথম কাজ ছিল, দিনটা নিরাপদে পার করা। সঙ্গী হিসেবে পেলেন ভিয়ান মুল্ডারকে। দুজন মিলে পার করে দিলেন শেষ বিকেলের চ্যালেঞ্জ।
দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার ক্রিকেট বিশ্বকে ভেরেইনা দেখালেন তার ব্যাটসম্যানশিপের পরিধি। দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি উইকেটে খেলে বেড়ে উঠলেও মিরপুরের মতো মন্থর, নিচু বাউন্সের ও টার্নিং উইকেটেও যে তিনি পিছিয়ে নন মোটেও, তা দেখালেন দারুণভাবে। শুধু স্পিন সামলানো বা কোনোরকমে উতরে যাওয়া নয়, সাবলিল ব্যাটিংয়ে দলের রানও বাড়ালেন দ্রুত। সেই পথে তার মূল বাহন ছিল সুইপ।
বিশেষ করে, দুই অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসানকে সুইপে সুইপে ব্যতিব্যস্ত করে তাদের পরিকল্পনা পুরো ভেস্তে দেন তিনি। তাইজুলের সামনে সুইপ খেলায় একটু সতর্ক ছিলেন ২৭ বছর বয়সী কিপার-ব্যাটসম্যান। তবে সুযোগ পেলে এই বাঁহাতি স্পিনারকেও সুইপ খেলতে ছাড়েননি।
তাইজুল ও হাসান মাহমুদের বলে দারুণ কিছু ড্রাইভও তিনি খেলেন। এক পেসারের বাংলাদেশ বাউন্সার বা শর্ট দিয়ে তার পরীক্ষা খুব একটা নিতে পারেনি। তার জন্য সকাল থেকেই ফিল্ডার ছিল ছড়ানো। চার-পাঁচ ফিল্ডার ছিল সীমানায়। তবু তার রানের গতিতে বাধ দেওয়া যায়নি।
১১৯ রানের জুটি ভাঙে ৫৪ রান করে মুল্ডারের বিদায়ে। পরের বলে বিদায় নেন কেশাভ মহারাজও। তবে ডেন পিটকে নিয়ে ৬৬ রানের জুটিতে বাংলাদেশের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে তোলেন তিনি।
তার শতরানে বাউন্ডারি ছিল ৮টি, এরপর ৫টিই ছিল সুইপ শটে। তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন তিনি ১৩৪ বলে। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, মাইলফলকে পা রাখা শট ছিল সুইপই।
শেষ পর্যন্ত শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি আউট হন ৮ চার ও ২ ছক্কায় ১৪৪ বলে ১১৪ রান করে। ৫০ রানের লিড পাওয়া নিয়েও শঙ্কায় ছিল যে দল, সেই দলের লিড তখন পেরিয়ে গেছে দুইশ।
মিরাজের বলে স্টাম্পড হয়ে মাঠ ছাড়ার সময় বাংলাদেশ দলের অনেকের কাছ থেকেই অভিনন্দন পেলে তিনি। অনেকটা দৌড়ে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিলেন মুশফিকুর রহিম।
যে ইনিংসটি তিনি খেলেছেন, ভবিষ্যতের জন্য প্রবল আত্মবিশ্বাসের রসদ যেমন সেখানে পাবেন, তেমনি ব্যাটসম্যান হিসেবেও পৌঁছে যাবেন পরের ধাপে।
ভেরেইনা আসলে নিজেও নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে পারেন।