Published : 29 Apr 2025, 12:05 PM
“আপনার কোনো দুর্ভাবনা আছে? ভয় আছে?” সঞ্চালক মুরালি কার্তিকের প্রশ্ন শুনে মিষ্টি করে হাসলেন বৈভাব সুরিয়াভানশি, “নাহ, এরকম কিছু নেই…।” সঞ্চালকের কৌতূহল শেষ হয় না, “এই যে এত আন্তর্জাতিক বোলার, এত বড় বড় বোলার, তাদের নিয়ে ভাবেন না ব্যাটিংয়ে নেমে?” এবার সুরিয়াভানশির সরল উত্তর, “ মাঠে এত কিছু দেখি না। স্রেফ বল দেখে খেলি…।”
তিনি না বললেও অবশ্য চলত। তার যে ভয়ডর কিছু নেই, বোলারদের নামের দিকে তাকান না, ব্যাট হাতেই তো দেখিয়ে দিয়েছেন! প্রথম দুই ইনিংস ছিল ‘ট্রেলার।’ রাজস্থান রয়্যালসের বিস্ময়-বালক পূর্ণাঙ্গ সিনেমা দেখালেন যেন সোমবার। গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে ১১ ছক্কায় ৩৮ বলে ১০১ রানের ইনিংস খেলে তিনি আলোড়ন তুলেছেন আইপিএলে। তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই।
৩৫ বলে ছুঁয়েছেন সেঞ্চুরি। আইপিএলে যা দ্বিতীয় দ্রুততম, ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্রুততম। ১৪ বছর ৩২ দিন বয়সে খেলেছেন ইনিংসটি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো ক্রিকেটারের প্রথম সেঞ্চুরি এটি।
শিশুসুলভ চেহারা দেখে অনুমান করা কঠিন, ব্যাট হাতে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন। কিন্তু তার ব্যাটের দাপটের স্বাক্ষী এখন সবাই। ৯০ মিটার লম্বা ছক্কা থেকে শুরু করে বিশাল সব ছক্কা মেরেছেন একের পর এক। ধারাভাষ্যকারা তার নাম দিয়েছেন ‘বস বেবি।’ স্টেডিয়ামের বড় পর্দায়ও ভেসে উঠল সেই নাম।
২১০ রান তাড়ায় রাজস্থানকে ৮ উইকেটে জিতিয়ে ম্যাচের সেরা হয়ে তিনি। ব্যাট হাতে যতটা বিধ্বংসী, মাইক্রোফেনের সামনে ততটাই নরমসরম। প্রতিক্রিয়া প্রকাশে খুব উচ্ছ্বাসের ছোঁয়াও নেই।
“খুব ভালো লাগছে। আইপিএলে আমার প্রথম শতক তৃতীয় ইনিংসেই। খুব ভালো লাগছে। এত দিন ধরে, গত তিন-চার মাস ধরে আইপিএলের জন্য যে অনুশীলন করে আসছি, সেটির ফল দেখা যাচ্ছে মাঠে। আইপিএলে সেঞ্চুরি করা স্বপ্নের মতোই।”
তাকে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে আলোচনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। ২০২৩ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেটে ৪০টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। গত বছর ভারতর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে যুব টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ৫৮ বলে। পরে তো আইপিএলের নিলামেও বশ ঝড় তুলেছিলেন।
তাকে নিয়ে আলোচনায় তার বাবার প্রসঙ্গও এসেছে বারবার। ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর লড়াইয়ে অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে বাবাকে। প্রভাব পড়েছে গোটা পরিবারেও। রেকর্ড গড়া ম্যাচের পর সেই গল্প শোনালেন সুরিয়াভানশি।
“আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি বাবা-মায়ের জন্য। ভোরে আমার অনুশীলনে যেতে হবে, এজন্য মা রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে যেতেন। স্রেফ ঘণ্টা তিনেক ঘুমাতেন। উঠে আমার জন্য খাবার বানাতেন। বাবা কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার জন্য। বড় ভাই সেটা সামলাতেন। অনেক কষ্টে চলছিল সংসার। কিন্তু বাবা আমার পেছনে লেগেই ছিল, ‘তুমি পারবে, তুমি করবে।’
“ভগবান এসব দেখেন। পরিশ্রম যারা করেন, তারা কখনও অসফল হন না। আজকে যতটুকু ফল মিলছে, যতটা সফল হচ্ছি, সব বাবা-মায়ের জন্যই। অনেক দিন থেকেই তৈরি হচ্ছিলাম। আজকে ফল পেয়ে ভালো লাগছে। সামনে আরও ভালো করতে চাই, দলের জন্য অবদান রাখতে চাই।”
নিলামে তাকে নিয়ে বেশ কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১ কোটি ১০ লাখ রুপিতে তাকে নেয় রাজস্থান। আইপিএলের অর্থের বাজারে এটা বড় অঙ্ক নয়। তবে সেই সময়ের ১৩ বছর বয়সী ক্রিকেটারকে এই অঙ্কে দলে নেওয়া মানে বিশেষ কিছুই।
রাজস্থানে জায়গা পাওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরলেন সুরিয়াভানশি।
“ট্রায়ালে গিয়েছিলাম। সেখানে বিক্রাম (রাঠোর, রাজস্থানের ব্যাটিং কোচ) স্যার ছিলেন, ম্যানেজার রোমি স্যার ছিলেন। ট্রায়ালে আমি ভালো করেছিলাম। পরে ম্যানেজার রোমি স্যার বলেছিলেন, “তোমাকে আমাদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করব (নিলাম থেকে)।”
“দলে আসার পর তার কাছ থেকেই প্রথম ফোনকল পাই। তিনি অভিনন্দন জানান। পরে রাহুল (কোচ দ্রাবিড়) স্যারের সঙ্গে তিনি কথা বলিয়ে দেন। খুব ভালো লাগছিল তখন। কারণ, রাহুল স্যারের সঙ্গে ট্রেনিং করা, ম্যাচ খেলা, টুর্নামেন্ট খেলা, তার সঙ্গে কাজ করা, অনুশীলন করা, একজন সাধারণ ক্রিকেটারের জন্য এসব স্বপ্নের চেয়ে কম নয়।”
আইপিএল অভিষেকটাও তার ছিল চমকপ্রদ। বিশ্বের শীর্ষ ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে নেমে প্রথম বলটিই উড়িয়ে দেন ছক্কায়! শার্দুল ঠাকুরের বলে জায়গা বানিয়ে উড়িয়ে দেন এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে। সেদিন আউট হয়ে যান দুই চার তিন ছক্কায় ২০ বলে ৩৪ রান করে। পরের ম্যাচে ১২ বলে ১৬ রানের ইনিংসে ছক্কা মারেন দুটি। তৃতীয় ইনিংসে তো তাণ্ডব চালালেন।
অভিষেকে প্রথম বলে সেই ছক্কা নিয়েও ‘বস বেবি’ বেশ নির্লিপ্ত।
“আমার জন্য এটা নরম্যালই ছিল। কারণ, ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ ম্যাচে, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচে প্রথম বলে ছক্কা আগেই মেরেছি। আমার ওপর তাই এরকম চাপ ছিল না যে ১০ বল খেলতে হবে। আমার ভাবনা পরিষ্কার ছিল যে, নিজের রাডারে বল পেলে আমি মারবই।”
“এত বেশি কিছু ভাবিনি। হ্যাঁ, বড় মঞ্চ ছিল, আইপিএলের ম্যাচ, আন্তর্জাতিক বোলার ছিল। তবে ওসব আমি ভাবিনি। আমার ভাবনা ছিল, নিজের যা খেলা, তা খেলার চেষ্টা করব। ব্যস, এইটুকুই।”
তার সত্যিকারের বয়স নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে। ২০২৩ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই যা বলেছিলেন, তাতে তার জন্ম ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেই হিসাবে এখন তার বয়স সাড়ে ১৫ বছর। রেকর্ড তাতেও হচ্ছে। কৃতিত্ব কমছে না একটুও।
চিন্তাভাবনায় তিনি বয়সকে ছাপিয়ে অনেক পরিণত, সেটির প্রমাণও ফুটে উঠল সেঞ্চুরির পর তার কথায়।
“আগে আরও যা করতে হবে, দেশের জন্য ভারতের জন্য অবদান রাখতে হবে। ওভাবেই পরিশ্রম করতে হবে। ঘাম ঝরিয়ে যেতেই হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারছি ও আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি, ততক্ষণ পরিশ্রম করে যাব। দেশের জন্য ভালে কিছু করার চেষ্টা করব।”