আইপিএল ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি খেলে জস বাটলার বললেন, ধোনি-কোহলিদের ব্যাটিং থেকে প্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন তিনি।
Published : 17 Apr 2024, 12:07 PM
শেষ ওভারের প্রথম বলেই দারুণ শটে ছক্কায় শতরান ছুঁয়ে ফেললেন জস বাটলার। জয়ের সমীকরণও তখন হাতের মুঠোয়। পাঁচ বলে লাগে কেবল তিন রান। কিন্তু বাটলারের মুখে হাসি নেই। মাইলফলক উদযাপনের কোনো ব্যাপারও নেই। চোয়াল শক্ত করে দ্রুতই দাঁড়িয়ে গেলেন পরের বলটি খেলতে। বুঝিয়ে দিলেন, ম্যাচ জয়ের আগে কোনো উৎসব নয়।
সেই ম্যাচ একটু পর পৌঁছে গেল শেষ বলের নাটকীয়তায়। সেখানে স্নায়ুর চাপ জয় করে শেষ পর্যন্ত দলকে জেতালেন বাটলার। মুখে বিজয়ের চওড়া হাসি ফুটে উঠল এবার। শূন্যে লাফিয়েও উঠলেন একবার।
তবে চোট আর শ্রান্তি মিলিয়ে তখন আর সেভাবে উদযাপন করার অবস্থায় নেই তিনি। সেটির প্রয়োজনও অবশ্য পড়ল না। ডাগআউট থেকে সতীর্থরা ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে মেতে উঠলেন উদযাপনে। তিনিই সেখানে মধ্যমণি। ধারাভাষ্যে তখন স্যামুয়েল বাদ্রি দারুণভাবে বললেন, ‘জস দা বস…।’
ম্যাচটিকে ছোট্ট করে এর চেয়ে ভালোভাবে হয়তো আর বোঝানো যেত না। যদিও এই ম্যাচে তার আগেই বিধ্বংসী একটি সেঞ্চুরি করেছেন সুনিল নারাইন। কলকাতা নাইট রাইডার্সের ক্যারবিয়ান এই অলরাউন্ডার পরে বল হাতেও চার ওভারে ৩০ রান দিয়ে নিয়েছেন দুই উইকেট। তার এমন অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পরও ম্যাচের ‘বস’ আসলে জসই। জস বাটলার।
নিজের ক্যারিয়ারের তো বটেই, আইপিএল ইতিহাসেরই সেরা ইনিংসগুলোর একটি উপহার দিয়েছেন তিনি। আইপিএলে রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে জিতেছে রাজস্থান রয়্যালস। ইডেন গার্ডেন্সে মঙ্গলবার কলকাতার ২২৩ রান টপকে শেষ বলে দলকে দুই উইকেটের জয় এনে দেন বাটলার। ৯ চার ও ৬ ছক্কায় অপরাজিত থাকেন তিনি ৬০ বলে ১০৭ রান করে।
চলতি আইপিএলে তার দ্বিতীয় শতরান এটি, আইপিএল ক্যারিয়ারে সপ্তম সেঞ্চুরি। ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে ক্রিস গেইলের ছয় সেঞ্চুরি পেরিয়ে গেলেন ইংলিশ এই ব্যাটসম্যান। আট সেঞ্চুরিতে তার ওপরে আছেন কেবল ভিরাট কোহলি।
বলতে গেলে একাই এ দিন দলকে টেনে নেন বাটলার। সঙ্গী সেভাবে কাউকে পাননি। ১৪ বলে ৩৪ রান করা রিয়ান পারাগ দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার। ২০ রান করতে পারেন আর কেবল আটে নামা রভম্যান পাওয়েল (১৩ বলে ২৬)। বাটলার ইনিংস শুরু করতে নেমে এক প্রান্ত থেকে সব পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে দলকে জিতিয়ে তবেই ফেরেন।
আরেক প্রান্তে শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান পাওয়েল যখন আউট হন, তখনও ৩.১ ওভারে ৪৬ রান লাগে রাজস্থানের। সেখানে ৪০ রান একাই করেন বাটলার। লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় স্ট্রাইক ধরে রেখে রান তলে দলকে জিতিয়ে দেন।
অবিচ্ছিন্ন নবম জুটিতে ১৫ বলে ৩৮ রান তোলেন তিনি আভেশ খানকে নিয়ে। অবিশ্বাস্যভাবে, জুটিতে একটি বলও খেলতে হয়নি আভেশকে!
শেষ দুই ওভারে যখন ২৮ রান প্রয়োজন, হার্শিত রানাকে দুই ছক্কা এক চারে ওভার থেকে ১৯ রান নিয়ে সমীকরণ নাগালে নিয়ে আসেন বাটলার। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৯ রানের। বারুন চক্রবর্তীর করা শেষ ওভারের প্রথম বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে তিনি শতরানে পৌঁছে যান ৫৫ বলে।
পরের দুই বলে সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নেননি বাটলার। আভেশকে স্ট্রাইকে পাঠিয়ে কোনো ঝুঁকি তিনি নিতে চাননি।
ওভারের চতুর্থ বলে তিনি খেলেন রিভার্স সুইপ। বল সরাসরি ফিল্ডারের হাতে যাওয়ায় রান পাননি আবার। টানা তিন বলে রান না হওয়ায় ম্যাচে কিছুটা নাটকীয়তা ফেরে আবার। পঞ্চম বলে ফুল টসে দুটি রান নেন তিনি।
দৌড়াতে যদিও ধুঁকছিলেন তিনি। চোট ছিল, সঙ্গে প্রচণ্ড গরম আর ক্লান্তি মিলিয়ে জোরে ছুটতে পারছিলেন না। দুটি রান তবু নিয়ে ফেলেন। এরপর শেষ বলে প্রত্যাশিত রানটিও পেয়ে দলকে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছে দেন।
শেষের নায়ক তিনি হলেও ইনিংসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে খুব সাবলিল মনে হয়নি তাকে। প্রথম ২৫ রান করতে বল খেলেন ১৮টি। স্কোরকার্ড দেখে বোঝা কঠিন, ফিফটি করতে তারা লেগে যায় পঞ্চদশ ওভার পর্যন্ত!
১৪ ওভার শেষে তার রান ছিল ৩৩ বলে ৪২। জয়ের জন্য তখন ৬ ওভারে ৯৬ রান লাগে রাজস্থানের। পরের ২৭ বলে তিনি করেন ৬৫ রান।
ম্যাচ শেষে বাটলার বললেন, লম্বা সময় পর্যন্ত টাইমিং করতে ভুগতে থাকলেও নিজের ওপর ভরসা হারাননি তিনি।
“একটা সময় মনে হচ্ছিল ছন্দ পাচ্ছি না। তবে হাল ছাড়িনি। যখনই নেতিবাচক ভাবনা এসেছে, আমি উল্টোটা ভেবেছি এবং স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছি। এটাই আমার জ্বালানি হয়ে কাজ করেছে।”
“কখনও কখনও হতাশা এসেছে এবং নিজেকে নিয়ে সংশয় জেগেছে। তখন নিজেকে বলার চেষ্টা করেছি, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, চেষ্টা করে যাও, ধীরস্থির থাকে, ছন্দ ফিরে আসবে।’ আইপিএল অনেক সময়ই দেখা গেছে, পাগলাটে সব ব্যাপার ঘটে যায়। তাই ভরসা হারাইনি।”
ক্রিজে লড়াই করার সময়টায় মাহেন্দ্র সিং ধোনি, ভিরাট কোহলির মতো ব্যাটসম্যানদের কথা মনে করেও প্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন তিনি।
“ধোনি ও কোহলির মতো ব্যাটসম্যানরা, যেভাবে তারা শেষ পর্যন্ত লড়ে যায়, বিশ্বাস রাখে নিজের ওপর, আইপিএল কতবারই তো এরকম দেখা গেছে। আমি সেরকমই কিছু চেষ্টা করে গেছি।”
এবারই প্রথম নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অনেকবারই অবশ্য এরকম ইনিংস দেখা গেছে বাটলারের ব্যাটে। অনেকবারই দেখা গেছে, শুরুতে হয়তো খুব ছন্দ পাচ্ছেন না, দ্রুত রান তুলতে পারছেন না। কিন্তু লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা পর্যায়ে ঠিকই বিধ্বংসী হয়ে উঠে ম্যাচ জিতিয়েছেন দলকে।
রাজস্থানের ঘরের ছেলে হয়ে ওঠা বাটলার জানালেন, দলের মেন্টর ও ডিরেক্টর অব ক্রিকেট কুমার সাঙ্গাকারার পরামর্শ এক্ষত্রে সবসময় মাথায় রাখেন তিনি।
“যখন কেউ ভালো অনুভব করছে না, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও করলেও যেটা সবচেয়ে ভালো করা যায়, তা হলো চেষ্টা করে যাওয়া। জোর করে কিছু করার চেষ্টা করতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে না আসা। কুমার সাঙ্গাকারা আমাকে সবসময় বলেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে যেন উইকেটে টিকে থাকি, কোনো একটা পর্যায়ে মোমেন্টাম বদলাবেই। একটা মুহূর্তে বা একটা শটেই ছন্দ ফিরে আসবে।”
“গত কয়েক বছরে আমার খেলার সবচেয়ে বড় অংশ এটিই- যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রক্রিয়ায় থাকার চেষ্টা করা এবং নিজের পথে বাধা হয় না দাঁড়ানো।”