বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ
ক্যারিবিয়ানে নিজেদের সর্বোচ্চ পুঁজির রেকর্ড গড়েও জিততে পারল না বাংলাদেশ, অভিষিক্ত আমির জাঙ্গুর সেঞ্চুরিতে রান তাড়ার নতুন রেকর্ড গড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
Published : 13 Dec 2024, 08:26 AM
এক সিরিজ দিয়ে যেন বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতের সব হিসেব মিটিয়ে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ম্যাচ ও সিরিজ জেতার পর এবার বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশের তেতো স্বাদও উপহার দিল ক্যারিবিয়ানরা।
হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর অভিযানে ব্যাট হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে নিজেদের রেকর্ড ৩২১ রান করে বাংলাদেশ। কিন্তু অভিষিক্ত আমির জাঙ্গুর সেঞ্চুরি এবং কেসি কার্টি ও গুডাকেশ মোটিদের ঝড়ে যথেষ্ট হয়নি তা।
সেন্ট কিটসে রান তাড়ার নতুন রেকর্ড গড়ে ২৫ বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতে নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২৯৫ রানের লক্ষ্য সফলভাবে তাড়া করে রেকর্ড গড়েছিল তারা। এবার সেটিই নতুন করে লিখেছে স্বাগতিকরা।
শেষ ম্যাচে ৪ উইকেটের জয়ে দশ বছর পর ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগের দুই সিরিজেই ক্যারিবিয়ানদের কোনো ম্যাচ জিততে দেয়নি বাংলাদেশ।
এর আগে ২০২১ সালের মার্চে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশড হয়েছিল বাংলাদেশ। সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ও ১৫ সিরিজ পর আবার এই তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো তাদের।
অভিষেকেই স্বাগতিকদের রেকর্ডগড়া জয়ের নায়ক জাঙ্গু। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। দল জেতানো ১০৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে তার হাতেই ওঠে ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
বিশাল লক্ষ্য তাড়ায় শুরুটা ভুলে যাওয়ার মতো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দ্বিতীয় ওভারে নাসুম আহমেদের বলে দুই চার ও এক ছক্কায় ১৪ রান নেওয়ার পর আলিক আথানেজের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন ব্র্যান্ডন কিং।
নাসুমের পরের ওভারে সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হন আথানেজ। পঞ্চম ওভারে শেই হোপকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেন হাসান মাহমুদ। মাত্র ৩১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন বিপদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
শুরুর ধাক্কা সামলে চতুর্থ উইকেটে ৫৫ রানের জুটি গড়েন কার্টি ও শেরফেইন রাদারফোর্ড। দলকে একশর কাছে নিয়ে ড্রেসিং রুমে ফেরেন ৩৩ বলে ৩০ রান করা রাদারফোর্ড। তিন ম্যাচে ১৬৭ রান করে তিনিই পরে পান সিরিজ সেরার পুরস্কার।
এরপর অভিষিক্ত জাঙ্গুকে নিয়ে এগোতে থাকেন কার্টি। দুজনের জুটি পঞ্চাশ পূর্ণ করার পর নাসুমের বলে আম্পায়ার্স কলের সৌজন্যে বেঁচে যান তিনি। এর বাইরে বাংলাদেশের বোলারদের তেমন কোনো সুযোগই দেননি দুই ব্যাটসম্যান।
কার্টি ফিফটি করেন ৪৮ বলে। আর অভিষেকে পঞ্চাশ ছুঁতে জাঙ্গু খেলেন ৪৫ বল।
৩৪তম ওভারে রিশাদ হোসেনের বলে মিড অফ ও লং অফের মাঝামাঝি জায়গায় ৬১ রানে থাকা জাঙ্গুর ক্যাচ ছেড়ে দেন বদলি ফিল্ডার পারভেজ হোসেন।
তবে পরের বলেই সৌম্য সরকারের দারুণ ক্যাচে বিদায় নেন ৯৫ রান করা কার্টি। তাই তখন জাঙ্গুর ওই ক্যাচ মিস তেমন বড় মনে হচ্ছিল না।
কার্টির বিদায়ে ভাঙে ১১৫ বলে ১৩২ রানের জুটি।
ক্রিজে গিয়ে রোস্টন চেইস ঠিক ছন্দ খুঁজে নিতে পারেননি। ১২ রান করতে তিনি খেলেন ১৯ বল। অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারকেও ফেরান রিশাদ। চার ওভারের মধ্যে দুই উইকেট নিয়ে তখন ম্যাচে ফেরার আশায় বাংলাদেশ।
কিন্তু পেস অলরাউন্ডার রোমারিও শেফার্ডের আগে গুডাকেশ মোটিকে নামিয়ে বাজিমাত করে স্বাগতিকরা। জাঙ্গুর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন জুটিতে মাত্র ৫৩ বলে ৯১ রান যোগ করে দলের সহজ জয় নিশ্চিত করে দেন মোটি।
আফিফ হোসেনের বলে লং দিয়ে ছক্কা মেরে মাত্র ৭৯ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন জাঙ্গু। পরের ওভারে রিশাদের বল জোড়া ছক্কায় উড়িয়ে ম্যাচ শেষ করেন মোটি।
৮৩ বলের ইনিংসে ৬ চারের সঙ্গে ৪টি ছক্কা মারেন জাঙ্গু। ৩টি করে চার-ছক্কায় ৩১ বলে ৪৪ রানে অপরাজিত থাকেন মোটি।
ম্যাচের প্রথমভাগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারেই জীবন পান সৌম্য। আলজারি জোসেফের বলে স্লিপে ক্যাচ ছেড়ে দেন ব্র্যান্ডন কিং। তবে ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না তানজিদ হাসান, লিটন কুমার দাসের।
জোসেফের পরের ওভারে তিন বলের মধ্যে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন দুজন। বাউন্সারে পুল করার চেষ্টায় মিড অনে ধরা পড়েন তানজিদ। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল ড্রাইভ খেলতে গিয়ে স্লিপে কিংয়ের হাতে ধরা পড়েন লিটন।
ওয়ানডেতে এ নিয়ে সবশেষ পাঁচ ইনিংসে তৃতীয়বার শূন্য রানে আউট হন লিটন। সবশেষ সাত ইনিংসে তার সংগ্রহ মাত্র ১৩ রান। সবশেষ ১৩ ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের।
চাপ সামাল দিতে পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটেন মিরাজ। তার কাজ সহজ করে দেন জেডিয়া ব্লেডস। এলোমেলো বোলিংয়ে প্রতি ওভারে বাউন্ডারি হজম করতে থাকেন অভিষিক্ত পেসার। সুযোগ কাজে লাগিয়ে রানের চাকা ঠিক রাখেন মিরাজ।
শুরুতে নিজেকে গুটিয়ে রাখা সৌম্য ১২তম ওভারে রোমারিও শেফার্ডের বলে আপার কাট করে মারেন ম্যাচের প্রথম ছক্কা। ওই শটেই কেটে যায় বাঁহাতি ওপেনারের জড়তা। এরপর বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলতে থাকেন তিনি।
শেফার্ডের পরের ওভারে ছক্কা মারেন মিরাজও। পরে রোস্টন চেইস ও গুডাকেশ মোটির বল ছক্কায় ওড়ান সৌম্য। পরে ৪৫ রানে আবার জীবন পান সৌম্য। দুই জীবন পেয়ে ফিফটি করতে ভুল হয়নি তার।
৩টি করে চার-ছক্কায় ৫৮ বলে মাইলফলক স্পর্শ করেন সৌম্য। একই ওভারে পঞ্চাশে পা রাখা মিরাজের লাগে ৫৬ বল।
২১তম ওভারে ব্লেডস আক্রমণে ফিরলে আবার চড়াও হন দুই ব্যাটসম্যান। মিরাজ ডিপ থার্ড ম্যান দিয়ে ছক্কার পর মারেন চার। শেষ বলে বাউন্ডারি মেরে ওভার থেকে ১৬ রান যোগ করেন সৌম্য।
দলকে দেড়শর কাছে রেখে বিদায় নেন বাঁহাতি ওপেনার। রিভিউ নিয়েও কোনো ফায়দা হয়নি তার। তার বিদায়ে ভাঙে ১২৭ বলে ১৩৬ রানের তৃতীয় উইকেট জুটি। ৭৩ বলে ৬ চারের সঙ্গে ৪টি ছক্কায় ৭৩ রান করেন বাঁহাতি সৌম্য।
এরপর কিছুটা কমে রানের গতি। পাঁচ নম্বরে নেমে সাবলীল ব্যাটিং করতে পারেননি আফিফ হোসেন। ১৫ রান করতে ২৯ বল খেলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তার বিদায়ের আগের ওভারে রান আউটে কাটা পড়েন মিরাজ।
চলতি সিরিজে দ্বিতীয় ও ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংসে ৭৭ রান করেন মিরাজ। ৬ চার ও ২ ছক্কায় ৭৩ বলের ইনিংস সাজান বাংলাদেশ অধিনায়ক।
দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ছন্দ খুঁজে পেতে কিছুটা সময় নেন ষষ্ঠ উইকেটে রেকর্ড জুটি গড়া মাহমুদউল্লাহ ও জাকের। তবে শেষ দশ ওভারে ঝড় তুলে ১০৪ রান যোগ করেন তারা।
মোটির বলে ছক্কা মেরে বাংলাদেশের দুইশ পূর্ণ করার পাশাপাশি ওয়ানডেতে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক হয়ে যান মাহমুদউল্লাহ। ২৪০ ইনিংসে তামিম ইকবালের করা ১০৩ ছক্কার রেকর্ড টপকে যেতে তার লাগে ২০৮ ইনিংস।
ইনিংসের শেষ ৪ ওভারে মাহমুদউল্লাহ ও জাকের মিলে নেন ৫৯ রান। রাদারফোর্ডের বলে চার মেরে চলতি সিরিজে তৃতীয় ও সব মিলিয়ে টানা চতুর্থ ফিফটি করেন মাহমুদউল্লাহ। ওয়ানডেতে টানা ৪টি পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলা বাংলাদেশের চতুর্থ ব্যাটসম্যান তিনি।
মাইলফলক উদযাপনে পরের বল মিড উইকেট দিয়ে ছক্কায় ওড়ান অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
শেফার্ডের পরের ওভারে চার মেরে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি করেন জাকের। মাহমুদউল্লাহর মতো তিনিও পরের বলে মারেন ছক্কা। পরে চার মেরে ওভার শেষ করেন মাহমুদউল্লাহ। ব্লেডসের পরের ওভারে ছক্কা মেরে দলের তিনশ পূর্ণ করেন তিনি।
শেষ ওভারে জোসেফের বলে দুটি চার মারেন মাহমুদউল্লাহ। শেষ দুই বলে কোনো রান নিতে পারেননি তিনি। তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে নিজেদের আগের সর্বোচ্চ ৩০১ রান টপকে নতুন রেকর্ড ঠিকই গড়ে বাংলাদেশ। তবে হোয়াইটওয়াশ এড়াতে যথেষ্ট হয়নি তা।
সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশ সময় আগামী সোমবার ভোরে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে দুই দল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২১/৫ (তানজিদ ০, সৌম্য ৭৩, লিটন ০, মিরাজ ৭৭, আফিফ ১৫, মাহমুদউল্লাহ ৮৪*, জাকের ৬২*; জোসেফ ১০-১-৪৩-২, ব্লেডস ৬-০-৭৩-০, শেফার্ড ১০-১-৬৫-০, চেইস ৮-১-৩৮-০, মোটি ১০-০-৬৪-১, রাদারফোর্ড ৬-১-৩৭-১)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৪৫.৫ ওভারে ৩২৫/৬ (কিং ১৫, আথানেজ ৭, কার্টি ৯৫, হোপ ৩, রাদারফোর্ড ৩০, জাঙ্গু ১০৪*, চেইস ১২, মোটি ৪৪*; হাসান ৮-০-৫২-১, নাসুম ৭-০-৫৬-১, মিরাজ মিরাজ ১০-০-৬৭-০, তাসকিন ৯-০-৪৯-১, রিশাদ ৮.৫-০-৬৯-২, আফিফ ২-০-১৯-০, সৌম্য ১-০-৬-০)
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩-০তে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: আমির জাঙ্গু
ম্যান অব দা সিরিজ: শেরফেইন রাদারফোর্ড