উন্নতির তাড়নার কথা বারবারই বলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে সেটির প্রতিফলন পড়ছে না একটুও।
Published : 31 Oct 2024, 08:12 PM
লেগ স্টাম্পে ফুল লেংথ ডেলিভারি ফ্লিক করে স্কয়ার লেগে আলতো ক্যাচ তুলে দিলেন মুশফিকুর রহিম। ঘণ্টা দুয়েকের পর আবার ব্যাটিংয়ে নেমে সুইপ করার চেষ্টায় এলবিডব্লিউ হলেন তিনি। দুই ইনিংস মিলিয়ে মোটে চার বল খেলতে পারেন ৯৪তম টেস্ট খেলতে নামা ব্যাটসম্যান। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের আউটের এসব ধরন দেখে যে কারও কপালই কুঁচকে যেতে পারে। মনে জাগতে পারে অনেক প্রশ্ন।
বাজে ব্যাটিংয়ে উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার মিছিলে দলের বাকিরাও যেন ‘কেউ কারো নাহি ছাড়ে সমানে সমান।’
প্রথম ইনিংসে দারুণ ইনিংস খেলেও একই সেশনে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাখ্যাতীত শটে আউট মুমিনুল হক। মুশফিকের পর তিনিই খেলেছেন সবচেয়ে বেশি ম্যাচ। দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের এমন ব্যাটিংয়ের পর পুরোনো প্রশ্নই ফিরে আসে আবার, আর কবে শিখবে বাংলাদেশ? কবে হবে উন্নতি!
মিরপুর টেস্টে অনিবার্য পরাজয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বিশ্বাসের বার্তায় অবিশ্বাস্য কিছুর আশার কথা বলেছিলেন স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদ। চট্টগ্রামেও বাজে ব্যাটিং-বোলিংয়ে পিছিয়ে পড়ার পর পুরোনো কথাই বলেন তিনি। কিন্তু বিশ্বাসের ভিত্তি আসবে কোথা থেকে, সেটিই যেন হয়ে গেছে বড় প্রশ্ন।
চট্টগ্রামের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের হতাশায় ডুবিয়ে টনি ডি জর্জি, ট্রিস্টান স্টাবস, ভিয়ান মুল্ডারের সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ৫৭৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা দেয় সফরকারীরা। দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামার সময়ও উইকেটের আচরণে আসেনি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
ম্যাচের তৃতীয় দিনও উইকেটের আচরণ ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক ছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং। মুশফিক, মুমিনুলের পাশাপাশি ব্যাটিং স্বর্গে আউট হওয়ার অদ্ভুত সব পথ খুঁজে নেন সাদমান ইসলাম, মাহমুদুল হাসান জয়, নাজমুল হোসেন শান্তরা। দুইবার মিলিয়েও এক দিন (৯০ ওভার) ব্যাটিং করতে না পারার মাশুল দিতে হয় ইনিংস ও ২৭৩ রানের পরাজয়ে।
প্রথম টেস্টেও বাংলাদেশের পরাজয়ের বড় কারণ ছিল ব্যাটিং। এর আগে ভারত সফর কিংবা ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও হতাশ করেন ব্যাটসম্যানরা। যে কারণে তিন সিরিজের ছয় ম্যাচের একটিতেও পরাজয় এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ।
মাঝে ব্যতিক্রম ছিল শুধু পাকিস্তান সফর। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং মিলিয়ে তিন বিভাগেই স্বাগতিকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বাংলাদেশ। রাওয়ালপিন্ডিতে দুই ম্যাচই জিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে দেশে ফেরে শান্তর দল।
তবে ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি দল। ভারতে গিয়ে দুই টেস্টেই স্বাগতিকদের একবারের রান দুই ইনিংস মিলিয়ে কোনোমতে করতে পারে তারা। তবে এড়াতে পারেনি বড় পরাজয়। কানপুরে তো বলের হিসেবে মাত্র দুই দিনেই জিতে যায় ভারত।
শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে তাদের মাঠে প্রত্যাশা অতটা ছিলও না। কিন্তু ঘরের মাঠে তুলনামূলক তরুণ ও অনভিজ্ঞ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ফেভারিট হিসেবেই সিরিজটি শুরু করেছিল বাংলাদেশ। যার ছাপ দেখা যায়নি মাঠের পারফরম্যান্সে।
মিরপুরে বোলিং সহায়ক উইকেটে প্রথম ইনিংসে কাইল ভেরেইনা দারুণ সেঞ্চুরি করলেও, পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানররা। দ্বিতীয় দফায় মিরাজের লড়াইয়ে কোনোমতে এড়ায় ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়।
আর চট্টগ্রামে এসে কল্পনাতীত বাজে ব্যাটিংয়ে মাত্র তিন দিনেই ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে শান্তও ব্যাটিং নিয়ে দুর্ভাবনার কথা বলেন।।
“এটা (ধারাবাহিক ব্যর্থতা) তো অবশ্যই খুবই হতাশাজনক। তবে আমার মনে হয়, এগুলো থেকে বোঝা যায় আমাদের কত উন্নতির জায়গা আছে। অবশ্যই পাকিস্তানে ভালো ক্রিকেট খেলে জিতেছি। তবে মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেকগুলো জায়গা আছে যেখানে আমাদের উন্নতি করতে হবে।”
“শুধু এই দুই ইনিংস বলব না। যদি খেয়াল করে দেখেন, লম্বা সময় ধরেই এরকম হচ্ছে। টেস্টে টপ অর্ডার থেকে যদি জুটি না হয়, তাহলে পরের ব্যাটারদের জন্য খুবই কঠিন। আমি জানি না, ওপরের দিকে যারা ব্যাটিং করে, তারা কী চিন্তা করে বা কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়। তবে এভাবে যদি চলতে থাকে, এরকম ফলাফলই হবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ক্রিকেটে মাঠের বাইরের বিষয় মানেই নানান আলোচিত ও বিতর্কিত ঘটনা। তবে শান্ত পরিষ্কার করলেন, অক্রিকেটীয় কিছুর ইঙ্গিত করেননি তিনি।
“মাঠের বাইরের বিষয় বলতে ক্রিকেটারদের স্কিল উন্নতির কথা বলেছি। অন্য কিছু বুঝাইনি। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাটিং এরকম হচ্ছে। যখন আমরা অনুশীলন করি বা সিরিজের আগে প্রস্তুতি নেই, ঐ জায়গায় ঘাটতি আছে কিনা খেয়াল রাখা দরকার।”
তবে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখনও পর্যন্ত তিন সিরিজেই মাঠের বাইরের নানা ঘটনা জাপটে ধরেছে বাংলাদেশ দলকে।
এসব ঘটনা ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব যদি ফেলেও থাকে, সেটি ব্যাটিংয়ে এত খারাপ হওয়ার কারণ হতে পারে না মনে করেন শান্ত।
“(বাইরের ঘটনায় প্রভাব) থাকতে পারে, আমি জানি না। তার মানে এই নয় যে, এত খারাপ খেলব। একশ-দেড়শ রানে অলআউট হয়ে যাব। (বাইরের ঘটনা) না হলে ভালো। যত কম হয় ততই ভালো। তবে খেলোয়াড়দের এই জিনিসগুলোও মানিয়ে নিতে হবে। জানি এটা কঠিন। তবে এত খারাপ তো হওয়ার কথা না।”
অধিনায়কের কথায় পরিষ্কার, ব্যাটিংয়ের এই হতশ্রী অবস্থা তাদের কাছেও অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়, সেটিই যেন বড় প্রশ্ন।
“স্কিল ও চিন্তাভাবনা- দুটোই। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, স্কিলের অনেক জায়গা আছে যেখানে আমাদের উন্নতি করতে হবে। পাশাপাশি চিন্তাভাবনাতেও পরিবর্তন আনতে হবে। উন্নতি করতে হবে এটা তো অনেক দিন ধরেই বলছি। তবে সুনির্দিষ্ট করে খুঁজে বের করা জরুরি যে আসলে হচ্ছেটা কী!”
এই প্রশ্ন তো আসলে অন্যদের। উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে শান্তদের।