চোখধাঁধানো বোলিংয়ে তরুণ স্পিনারের শিকার ৬ উইকেট, ভয়াবহ ব্যাটিং ধসে ২৩ রানের মধ্যে ৮ উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তানের কাছে বড় পরাজয় বাংলাদেশের।
Published : 06 Nov 2024, 11:56 PM
রহস্য, ধাঁধা কিংবা ঘোর। বলা যায় যে কোনো কিছু। কিংবা সবকিছুই! দুই দিকেই টার্ন, ক্যারম বল আর নানা বৈচিত্রের জাদু মেলে ধরলেন আল্লাহ মোহাম্মাদ গাজানফার। তাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের হতবুদ্ধিকর ব্যাটিং। চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন যেন সবাই। তরুণ স্পিনারের স্মরণীয় বোলিং পারফরম্যান্সে মরুতে আরও একবার ফুটে উঠল আফগানদের জয়ের ফুল।
ক্যারিয়ারের আগের পাঁচ ওয়ানডেতে গাজানফারের উইকেট ছিল মোট চারটি। বাংলাদেশকে গুঁড়িয়ে এই ম্যাচে তার বোলিং ফিগার ৬.৩-১-২৬-৬। তাতেই ধ্বংস বাংলাদেশের ব্যাটিং। ৯২ রানের জয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল আফগানিস্তান।
তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতে বুধবার তরুণ স্পিনারের অসাধারণ বোলিংয়ের আগে আফগানিস্তানকে ভরসা জোগায় অভিজ্ঞ একজনের ব্যাট। বিপর্যয়ের মধ্যে দারুণ ইনিংস উপহার দেন মোহাম্মাদ নাবি। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা আফগানরা রান তোলে ২৩৫।
সাতে নেমে ৭৯ বলে ৮৪ রান করেন নাবি। ৩৯ বছর ৩১০ দিন বয়সে ইনিংসটি খেলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি বয়সে ফিফটির রেকর্ড এখন তার।
চারটি করে উইকেট নেন তাসকিন আহমেদ ও মুস্তাফিজুর রহমান। ওয়ানডেতে এই প্রথম এক ম্যাচে চার উইকেট নিলেন বাংলাদেশের একাধিক পেসার।
সেই রান তাড়ায় এক সময় জয়ের ভালো ভিত গড়েছিল বাংলাদেশ। তিনটি ক্যাচ হাতছাড়া করে পিছিয়ে পড়েছিল আফগানিস্তান। তবে নুইয়ে পড়েনি তারা। গাজানফারের সঙ্গে রাশিদ খানের যুগলবন্দিতে ভয়াবহ ব্যাটিং ধসে ৩৪.৩ ওভারেই ১৪৩ রানে শেষ বাংলাদেশের ইনিংস।
এক পর্যায়ে বাংলাদেশের রান ছিল ২ উইকেটে ১২০। সেখান থেকে ২৩ রানের মধ্যে বাকি ৮ উইকেট হারায় তারা।
এই ম্যাচ দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেন্যু হিসেবে ৩০০ আন্তর্জাতিক ম্যাচের মাইলফলক স্পর্শ করল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ এখানে ওয়ানডে খেলল ২৯ বছর পর। কিন্তু উপলক্ষ রাঙালেন ষষ্ঠ ম্যাচ খেলতে নামা গাজানফার। চোটের কারণে খেলতে না পারা মুজিব উর রাহমানের অভাব বুঝতেই দিলেন না ‘নতুন মুজিব; নামে পরিচিতি পাওয়া স্পিনার।
প্রথম ছোবল দেন তিনি বাংলাদেশের রান তাড়ার শুরুর দিকেই। স্কিড করা বলের জবাব না পেয়ে বোল্ড হন তানজিদ হাসান। সেই ধাক্কা সামাল দিয়ে পরপর দুই জুটিতে গড়ে ওঠে অর্ধশত রানের বন্ধন।
দ্বিতীয় উইকেটে ৫৩ রান যোগ করেন সৌম্য সরকার ও নাজমুল হোসেন শান্ত। সৌম্যকে (৪৫ বলে ৩৩) যখন মনে হচ্ছিল বড় কিছুর জন্য প্রস্তুত, তখনই উইকেট হারান তিনি আজমাতউল্লাহ ওমারজাইয়ের শর্ট বলে।
বাংলাদেশের বিপদ বোঝা যায়নি তখনও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রায় ৬০ গড়ের মেহেদী হাসান মিরাজকে নামানো হয় চার নম্বর। শান্তর সঙ্গে কার্যকর জুটিও গড়ে তোলেন তিনি।
দুহাত বাড়িয়ে সহায়তা করেন সেখানে আফগান ফিল্ডাররাও। ১ ও ৪ রানে ক্যাচ দিয়েও রক্ষা পান মিরাজ, ২১ রানে শান্ত।
জীবন পেয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন দুজন। রান তাড়ার চাপ ছিল না। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা গাজানফারকে দারুণ শটে ছক্কা মেরে আত্মবিশ্বাসের ছাপ রাখেন শান্ত। নাবিকে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কায় ওড়ান মিরাজ।
মিরাজের ওই ছক্কার পর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বাউন্ডারি আটকে রাখে আফগানরা। লক্ষ্য বড় নয় বলে তবু রান রেটের চাপ কিছু ছিল না। কিন্তু নাবিকে সুইপ করার চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে দেন শান্ত (৬৮ বলে ৪৭)। জুটি থামে ৫৫ রানে।
সেখান থেকেই শুরু চমকপ্রদ ধসের। ৫১ বলে ২৮ রান করে মিরাজও থামেন সুইপ খেলে। দুর্দান্ত ক্যাচ নেন ওমারজাই। এরপর স্রেফ একের পর এক ব্যাটসম্যানের আসা-যাওয়ার মিছিল।
রাশিদ খানের গুগলিতে কিছুই না বুঝে বোল্ড হন মাহমুদউল্লাহ। গাজানফারের ক্যারম বলে বিভ্রান্ত হন সাড়ে ৯ বছর পর সাত নম্বরে নামা মুশফিকুর রহিম। একই পথের পথিক রিশাদ হোসেনও। কিছুক্ষণ এক প্রান্তে পড়ে থাকা তাওহিদ হৃদয় বোল্ড রাশিদের গুগলিতে।
২৬তম ওভারে ২ উইকেটে ১২০ রানে থাকা দল ৩৫তম ওভারে অলআউট ১৪৩ রানে।
এই স্পেলে ৩.৩ ওভার স্রেফ ৪ রান দিয়ে গাজানফারের প্রাপ্তি ৫ উইকেট।
সব মিলিয়ে তার ২৬ রানে ৬ উইকেট ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় সেরা বোলিং। ১৮ রানে ৭ উইকেটের রেকর্ড যার, সেই রাশিদ যথারীতি দারুণ বোলিংয়ে এই ম্যাচে নেন দুই উইকেট।
শেষটা দুঃস্বপ্নের মতো হলেও ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের জন্য ছিল ভালো। আফগান টপ অর্ডারে মূল ভরসা রাহমানউল্লাহ গুরবাজকে দ্রুত ফিরিয়ে দলকে কাঙ্ক্ষিত ব্রেক থ্রু এনে দেন তাসকিন। আরেক প্রান্তে আঁটসাঁট বোলিংয়ে আফগানদের চাপে রাখেন শরিফুল ইসলাম।
অষ্টম ওভারে আক্রমণে এসে আফগান ব্যাটিং অর্ডারের মাথা মুড়িয়ে দেন মুস্তাফিজুর রহমান। দুই ওভারেই তিন উইকেট আদায় করে নেন অভিজ্ঞ পেসার।
তার প্রথম শিকার রেহমাত শাহ। পরের ওভারে বিদায় করেন তিনি সেদিকউল্লাহ আটাল ও আজমাতউল্লাহ ওমার জাইকে। সম্প্রতি ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপে অসাধারণ পারফর্ম করে আলোচনায় আসা আটাল ওয়ানডে অভিষেকে প্রতিভার কিছু ঝলক দেখিয়ে আউট হন ২১ রানে। ওমারজাই পাননি রানের দেখা।
৩৫ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন হাশমাতউল্লাহ শাহিদি ও গুলবাদিন নাইব। তাসকিন দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে নাইবকে (২২) ফিরিয়ে এই জুটি থামান ৩৬ রানে।
বিপদে থাকা দল এরপর ভরসা পায় শাহিদি ও মোহাম্মাদ নাবির ব্যাটে। উইকেট আঁকড়ে রাখায় মনোযোগ দেন শাহিদি। নাবির ব্যাটিং দেখে অবশ্য দলের বিপর্যয় বোঝা যায়নি। সহজাত ব্যাটিংয়ে রান বাড়ান অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার।
স্পিন তিনি বরাবরই ভালো খেলেন। এই ম্যাচেও সেটির ছাপ রাখেন যথেষ্ট। রিশাদ হোসেনকে বিশাল দুটি ছক্কায় বুঝিয়ে দেন, পেশির জোর তার অটুট এখনও। বাংলাদেশের পেসও তিনি সামাল দেন দারুণ দক্ষতায়।
এই জুটি থামে ১০৪ রানে। শাহিদিকে ফিরিয়ে চার উইকেট পূর্ণ করেন মুস্তাফিজ। ৯২ বলে ৫২ করে আউট হওয়া আফগান অধিনায়ক স্লোয়ার ডেলিভারি স্টাম্পে টেনে আনেন ক্লান্ত শটে।
রাশিদ খান ঝড় তুলতে না পারলেও নাবি যতক্ষণ টিকে ছিলেন, আফগানদের আড়াইশর আশাও জিইয়ে ছিল। সেটি মিইয়ে দেন তাসকিন। নাবি সীমানায় ধরা পড়েন শর্ট বলে। পরের বলেই আল্লাহ মোহাম্মাদ গাজানফার বোল্ড ফুল লেংথ ডেলিভারিতে।
নানগেলিয়া খারোটে অবশ্য লড়াই চালিয়ে যান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বার ব্যাট করতে নামা ২০ বছর বয়সী ক্রিকেটার অপরাজিত ২৭ রানের মূল্যবান এক ইনিংস খেলেন। মুস্তাফিজের শেষ ওভারে ছক্কা ও চার মারেন তিনি দারুণ শটে। ২৩৫ রানে পৌঁছে যায় আফগানরা।
মাঝবিরতিতে ওই স্কোরকে যথেষ্টই চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছিল। কিন্তু চ্যালেঞ্জ জানাতেও পারল না বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৪৯.৪ ওভারে ২৩৫ (গুরবাজ ৫, আটাল ২১, রেহমাত ২, শাহিদি ৫২, ওমারজাই ০, নাইব ২২, নাবি ৮৪, রাশিদ ১০, খারোটে ২৭*, গাজানফার ০, ফারুকি ০; শরিফুল ৯.৪-০-৩২-১, তাসকিন ১০-০-৫৩-৪, মুস্তাফিজ ১০-০-৫৮-৪, মিরাজ ১০-০-৩০-০, রিশাদ ৮-০-৪৬-০, মাহমুদউল্লাহ ২-০-১১-০)
বাংলাদেশ: ৩৪.২ ওভারে ১৪৩ (তানজিদ ৩, সৌম্য ৩৩, শান্ত ৪৭, মিরাজ ২৮, হৃদয় ১১, মাহমুদউল্লাহ ২, মুশফিক ১, রিশাদ ১, তাসকিন ০, শরিফুল ১, মুস্তাফিজ ৩*; ফারুকি ৪-০-২২-০, গাজানফার ৬.৩-১-২৬-৬, নাবি ৪.২-০-২৩-১, ওমারজাই ৪.৪-১-১৬-১, নাইব ১-০-৯-০, রাশিদ ৮-০-২৮-২, খারোটে ৬-০-১৬-০)
ফল: আফগানিস্তান ৯২ রানে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজে আফগানিস্তান ১-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: আল্লাহ মোহাম্মাদ গাজানফার