ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ অ্যালামনাই সোসাইটির পুনর্মিলনী এবার রীতি ভেঙে হল ক্যাম্পাসের বাইরে, অভিজাত হোটেলের আঙ্গিনায়।
Published : 19 Nov 2022, 12:18 AM
ফিরে এল সেই স্মৃতিভ্রমণের সন্ধ্যা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পুরনো বন্ধুদের দেখা হলো, হলো সেলফি। আড্ডা আর আনন্দ হল মন ভরে। শুধু টিএসসির সেই সবুজ চত্বরকে ‘মিস’ করলেন সবাই।
মহামারীর কারণে গেল দুই বছর ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট অ্যালামনাই সোসাইটির (ইডাস) পুনর্মিলনী হয়নি। এর মাঝেই পার হয়েছে বিভাগ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছরপূর্তি। অনেক অপেক্ষার সেই পুনর্মিলনীর শুভক্ষণ এল শুক্রবার; রীতি ভেঙে ক্যাম্পাস ছেড়ে এবার প্রাণের মেলা বসল অভিজাত হোটেলের আঙ্গিনায়।
সন্ধ্যা নামার আগেই সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েসিস প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যান ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নিয়াজ জামান। অন্যদের সঙ্গে গল্প জমানোর ফাঁকে শিক্ষার্থীদের ছবি তোলার আবদার একে একে মেটাচ্ছিলেন তিনি।
নিজের ছাত্র আর পরিচিতজনদের সাথে দেখা হওয়ায় সময় তার কাটল আনন্দেই। তবু পায়ের নিচে টিএসসির ঘাস নেই বলে একটুখানি অতৃপ্তি থেকে গেল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিয়াজ জামান বললেন, “খুবই ভালো লাগছে। পরিবেশটা উপভোগ করছি। খুবই ভালো লাগছে, কিন্তু টিএসসিকে মিস করছি।”
ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর করা নিয়াজ জামান এবারের পুনর্মিলনীতে কোনো সহপাঠীর দেখা পাননি। যারা এসেছিলেন, তাদের অনেককেই তিনি ক্যাম্পাসে পেয়েছেন ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে।
অধ্যাপক নিয়াজ জামান হাসতে হাসতে বলছিলেন, “অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী না এলে এখানে আমিই বোধহয় সবচেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ।”
১৯৫৫ সালের স্নাতক এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও পরে এলেন। শুক্রবার এ আয়োজনে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বয়স্ক প্রাক্তনী। অনুষ্ঠানে ইডাসের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হল সম্মাননা।
তিনি বললেন, “বয়সের কারণে আমি নানান রকম সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু আজকের সম্মাননাটা অন্য সম্মাননার থেকে একেবারে আলাদা। কেননা, এটা আমার অত্যন্ত আপনজনেরা দিচ্ছে, আমার ঘরের মানুষেরা দিচ্ছে।
“এই সম্মাননার সঙ্গে যে আন্তরিকতা এবং শুভেচ্ছা জড়িত, সেটা এই সম্মাননাকে অত্যন্ত মূল্যবান করে তুলেছে।”
সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েসিস প্রাঙ্গণকে দুই ভাগে বিভক্ত করে সাজানো হয় পুনর্মিলনীর আয়োজন। একদিকে খোলামেলা জায়গায় বিকাল থেকে চলে আড্ডা, গল্প আর উৎসবমুখর সময় কাটানো। সন্ধ্যার পর অন্য প্রান্তের তাঁবু খাটানো অংশে চলে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা আর নৈশভোজ।
অসুস্থতার মধ্যেই পুনর্মিলনীতে যোগ দেন লেখিকা গুলতেকিন খান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “সাথে ওষুধ পথ্য নিয়ে এসেছি।… এমনি আমার খুব ভালো লাগছে। সব বন্ধুদের পাইনি। যাদেরকে পেয়েছি, তাদেরকে দেখে খুব ভালো লাগছে। সবাইকে খুব প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।”
ইডাসের সাবেক সভাপতি, ১৯৭২-৭৩ সেশনের শিক্ষার্থী ওয়াজির সাত্তারও অসুস্থ। পুনর্মিলনীর আয়োজনে তিনি হাজির হয়েছিলেন ক্রাচে ভর দিয়ে।
পুরোনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এই সুযোগ হারাতে চাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “গত তিন বছরতো কিছু হয়নি, আবার হলো এখন। তার আগ অবধি আমি কমিটিতে ছিলাম, খুবই সম্পৃক্ত ছিলাম। এবার আমি খুবই অসুস্থ, তবুও চলে এসেছি। আমিতো মিস করতে পারি না!”
এত কষ্ট করে আসার পেছনে আরও একটি কারণ আছে ওয়াজির সাত্তারের। তিনি বললেন, “আমাদের বিভাগের জন্ম আর ইউনিভার্সিটির জন্ম একই সময়ে; এজন্য আমরা নিজেরা অনেক গর্ববোধ করি। এবারের অনুষ্ঠানটা একটু স্পেশাল। যেহেতু আসতেই হবে, সেজন্য এসেছি। খুব ভালো লাগছে।”
তবে টিএসসির কথা তুলতেই বললেন, “টিএসসিতে করতে পারছি না, এখানে করছি আমরা। একটু অন্য রকম লাগে, আবহটা নাই আর কি। তবুও বন্ধুবান্ধব, জুনিয়রদের সবাইকে নিয়ে ভালো লাগছে। সিনিয়রতো সেভাবে নেই। খুবই ভালো লাগছে।”
তিন বছর পর আবারও পুনর্মিলনীতে এসে ভালো লাগার কথা বললেন ইডাসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী। তাঁবুর নিচে বসে টিএসসির খোলা আকাশ আর খোলা মাঠ মিস করার কথা বললেন তিনিও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক খালিদী বলেন, “১০০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানতো… কাজেই একটু বিশেষভাবে করা হচ্ছে বা করা হয়েছে। কিন্তু আমি যেটা মিস করছি, সেটা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রাঙ্গণ এবং খোলা আকাশ, খোলা মাঠ, টিএসসি।
“টিএসসিতে হলে ভালো হত। তিন বছর পরে অনুষ্ঠান হচ্ছে। ভালো লাগছে, সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রতিবছর দেখা হত এর আগে, আজকে তিন বছর পর দেখা হল, ভালোই লাগছে। তবে টিএসসির মতো কিছু হয় না, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উপরে কিছু নেই আমার কাছে।”
পুরনোদের ভিড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন প্রাক্তনীও কম নয়। ২০১৫ সালে মাস্টার্স করা তাসনিয়া মিজান চৌধুরী পুনর্মিলনীতে এসেছেন এবারই প্রথম। সেই উচ্ছ্বাস ফুটে বেরোচ্ছিল তার কথায়, হাসিতে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক বললেন, “এতদিন আসিনি। তাই অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত। আমি জানতাম না, কী হবে। আসব কি আসব না, কিন্তু এসে খুবই ভালো লাগছে।
“এটা আমার প্রথমবার। যেহেতু প্রথমবার, কম্পেয়ার করার মত স্মৃতি নাই। এটা আমার প্রথমবার, সে কারণেই এটা স্পেশাল।”
মিলনমেলায় এসে শিক্ষার্থীদের ছবির আবদার মেটাতে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর ফুরসৎ পাচ্ছিলেন না বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ফকরুল আলম।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই এ লেখক-গবেষক বললেন, “দারুণ লাগছে। প্রত্যেক বছর আমার ছাত্র-ছাত্রী সবাই এটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এবার আমরা টিএসসিতে করতে পারছি না, সেটাতো একটা দুঃখের কথা, ঐতিহ্যের কথা যদি বলি…।”
এরপর হোটেলের ওয়েসিস প্রাঙ্গণের ঘাস দেখিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “এখানে একটু টিএসসি-টিএসসি ভাব আছে। সবুজটা আছে। কিছুটা ক্ষতিপূরণ হচ্ছে আর কি। ভালো লাগছে।”
অবসরের পর হঠাৎ ব্যস্ততাহীন এই সময়ে পুনর্মিলনীতে এসে বেশ উপভোগ্য সময় কাটানোর কথা বললেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ।
ইডাসের সাবেক এই যুগ্ম সম্পাদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “যখনই আমরা বন্ধু ও পরিচিতজনের সঙ্গে মিলিত হই, এটা সবসময় উৎসাহব্যঞ্জক, এটা সোনালী সময়। আনন্দঘন এই সময় সত্যিকার অর্থে আমি উপভোগ করছি।”
অবসর জীবন নিয়ে প্রশ্ন করতেই বেনজীর আহমেদ বললেন, “আমি বলব যে, জীবনের একটা ভিন্ন অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে আমাদের ভিন্ন বাস্তবতা, ভিন্ন চ্যালেঞ্জ, জীবন যাপনের ভিন্ন পরিধি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছি নতুন অধ্যায়ের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে।
“এই সময়টাকে প্রোডাকটিভ করার জন্য, নিজের জন্য, সমাজের জন্য দেশের জন্য, যত বেশি আমরা অবদান রাখতে পারি…।
ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শাহনাজ সুলতানার জীবনসঙ্গী হওয়ার সূত্রে নিয়মিত পুনর্মিলনীতে আসেন সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদ।
ক্যাম্পাস জীবনের অনেক স্মৃতি মনে পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বললেন, “এখানে এলে বিশেষ করে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। এ কারণে প্রতিবছরই আসা হয়। ভালোই লাগছে। সবাইকে আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
শাহনাজ সুলতানা বললেন, “প্রত্যেক বছর এমন একটা আয়োজন হয়, ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে যে সময়ে আমরা জ্ঞানের মহীরূহদের কাছে পড়তাম, উনাদেরকে এখনো দেখি, ওইভাবেই দেখি। উনাদের কাছে আমরা কিছুই না।”
এবারের আয়োজন টিএসসিতে না হলেও অতটা খারাপ লাগেনি শাহনাজ সুলতানার। তিনি বলেন, “এটা একটা নতুনত্ব হল। ভিন্ন রকম আয়োজন, ভালো লাগছে… এটাতো আমার কাছে মনে হয় উত্তরণ, আগেরটা সেভাবে মিস করছি না। আবার হয়ত ওইখানে হবে।”
তবে ইডাস সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বললেন, ‘চমৎকার গোছানো’ আয়োজন করতে পারলেও ক্যাম্পাসকে তিনি মিস করছেন।
“অনেক দিন পরে হচ্ছে তো, দুবছরের গ্যাপে। তাতে লোকজনের উৎসাহ দেখে খুব ভালো লাগছে। অনেকে আসতে চাইছে। আটশ জনের পরে আমরা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি যে স্পট রেজিস্ট্রেশন হবে না।
“বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টি সবার কাঙ্ক্ষিত। সামনের দিনে যদি আরেকটু খোলামেলা জায়গা করতে পারি, সেটার চেষ্টা করব। ক্যাম্পাসতো মিস করছিই। এবারে অনেক দিন পরে করা হল বলে এখানে করা হল। সবাই বলছিল যে… ১০০ বছরের ব্যাপারতো।”
ইডাস সভাপতি রামেন্দু মজুমদারের পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। নতুন কমিটি ঘোষণা এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় মঞ্চের আনুষ্ঠানিকতা।