সেনাবাহিনীকে কাজ বুঝিয়ে দিতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সভা ডেকেছে বুধবার।
Published : 13 Jan 2025, 05:12 PM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর করা নিয়ে সভার আহ্বান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছে, সেটি বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সংশোধন না হওয়ায় সচিবালয়ে গেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনশনরত শিক্ষার্থীরা।
তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে সঙ্গে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি চিঠি পাঠিয়েছে; তাতে বলা হয়েছে সেনাবাহিনীকে কাজ বুঝিয়ে দিতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা ডাকা হয়েছে বুধবার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিকে 'অসম্পূর্ণ' বলে তা সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা; তারা বলেছিলেন বিকাল ৪টার মধ্যে চিঠি সংশোধন না করলে তারা সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা করবেন। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় সচিবালয়ের উদ্দেশে অনশনকারী শিক্ষার্থীরা রিকশায় করে রওনা হন বিকাল ৪টার পরপর।
দুপুর ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শারমিন মন্ত্রণালয়ের সভার বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে আন্তরিক, সহমর্মিতা প্রকাশ করেছি। বাংলাদেশের যে কোনো প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা থাকে। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আজকে উপাচার্য সকাল থেকেই মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। আগামী বুধবার সাড়ে ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অংশগ্রহণে সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে।"
শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙার অনুরোধ জানিয়ে সাবিনা শারমিন বলেন, “এই পর্যন্ত একটু সময় দাও। ইনশাআল্লাহ তোমাদের সঙ্গে মিলে তোমরা যেভাবে চাও সেভাবে বাস্তবায়ন করবো। আমরা সেনাবাহিনীকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর।"
এরপর অনশনরত শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে বিকাল ৩টার দিকে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন যে তারা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠির নবায়ন চান।
সংবাদ সম্মেলনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও জাস্টিস ফর জুলাইয়ের আহ্বায়ক সজিবুর রহমান বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে আমাদেরকে সভার একটি চিঠি পাঠিয়েছে সেটা অস্পষ্ট, আমরা সুস্পষ্ট রূপরেখার মাধ্যমে কীভাবে চিঠি করতে হবে সেটার ড্রাফট আমরা রেডি করেছি। আপনাদের মাধ্যমে জানাতে চাই। আগামী বুধবারের বৈঠকে সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী ইউনিট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বসার জন্য যে তারিখ নির্ধারণ করেছে ৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের শর্তে বৈঠকে বসবে। এই বলে অঙ্গীকার প্রদান করে লিখিত দিতে হবে।"
শাটডাউন কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে সজিবুল বলেন, 'আগামী বুধবারের বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ লিখিত আকারে না আসা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম শাটডাউনের আওতাভুক্ত থাকবে।"
শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি একেএম রাকিব ৩টাএ বলেন, “চিঠি নবায়নের সুযোগের জন্য আমরা এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছি। এর ভেতরে নতুন চিঠি না আসলে আমরা সচিবালয়ে অভিমুখে পদযাত্রা করবো। চিঠি নবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অনশন কার্যক্রমও চলমান থাকবে।"
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, সেনা কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাদের সঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে করেন অনশনরত শিক্ষার্থীরা। ওই বৈঠকের জন্য তারা সব পক্ষকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।
ওই সময়ের মধ্যে কারো দিক থেকে কোনো সাড়া মেলেনি, বরং অধ্যাপক ড. সাবিনা শারমিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার ঘোষণা দিলে, পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে অনশনরতরা সেই চিঠি সংশোধনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মন্ত্রণালয়কে সময় দেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর ছাড়া আরো দুই দাবি হল পুরান ঢাকার বাণী ভবন ও ড. হাবিবুর রহমান হলের স্টিল বেইজড ভবনের কাজ দ্রুত শুরু ও শেষ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আবাসনের ব্যবস্থা না হয়, ততদিন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
নিজেদের দাবি আদায়ে রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনশন শুরু করেন তিন শিক্ষার্থী, যে কর্মসূচিতে দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ জনে।
বিকালে শিক্ষক সমিতির অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে তা প্রত্যাখান করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘একাত্মতা’ পোষণ করে অনশনে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম। তার সঙ্গে যোগ দেন প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ কয়েকজন শিক্ষক।
আধা ঘণ্টার মতো অবস্থান করার পর তারা অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন, এরপর উপাচার্যসহ শিক্ষকরা চলে যান।
পরে রাতে আন্দোলনকারীদের ১৪ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন, যাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে দেখতে যান উপাচার্য রেজাউল করিম। তখন তিনি অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে ফের তা নাকচ করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গভীররাতে সংহতি জানাতে অনশনস্থলে আসেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের অর্ধশতাধিক ছাত্রী। এরপর সকালে শিক্ষার্থীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে নামেন।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়াসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত ৫ নভেম্বর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন।
এরপর ১১ নভেম্বর ইউজিসি প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পে জগন্নাথের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিসহ ৫ দাবিতে সচিবালয় ‘ঘোরাও করেন’ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সেদিন শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তারা সচিবালয়ের বাইরে অবস্থান নেন। এরপর তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের তিন দিন সময় চাইলে সচিবালয়ের সামনের অবস্থান থেকে সরে যান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে পরদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরে সায় দেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
এরপর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় অনশনের ডাক গত সপ্তাহে দিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন
জবিতে 'কমপ্লিট শাটডাউনে' অনশনরতরা
জবির দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: মধ্যরাতে অনশনস্থলে ছাত্রীরা, অসুস্থ ১৪
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: উপাচার্যের অনুরোধও প্রত্যাখান অনশনরত জবি শিক্ষার্থীদের
সেনাবাহিনী কবে কাজ পাবে, নির্দিষ্ট করে বলা 'সম্ভব নয়': জবি উপাচার্য
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: জগন্নাথের অনশনে আরও শিক্ষার্থী
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: অনশনে বসেছেন জগন্নাথের ১২ শিক্ষার্থী
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: জগন্নাথে গণ অনশনের ডাক
জগন্নাথের নতুন ক্যাম্পাসের 'কাজ পাচ্ছে' সেনাবাহিনী
সচিবালয় 'ঘেরাওয়ে' জগন্নাথ শিক্ষার্থীরা, দেখা চান উপদেষ্টার
প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে জগন্নাথ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
জবির নতুন ক্যাম্পাস: ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়নে আর কতদিন?
জগন্নাথের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের দাবি