যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে বর্ধিত সময়ের মধ্যেও প্রকল্প শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা।
Published : 16 Feb 2024, 12:38 AM
কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নে চলছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ। তবে ১১ দশমিক ৪০ একর ভূমির সুরাহা না হওয়া আর ভূমি উন্নয়নের কাজে দরপত্র বিষয়ক দীর্ঘসূত্রতায় কাজ চলছে শম্বুক গতিতে। পুরো বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক।
এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে নতুন ক্যাম্পাসের নকশাও দেখানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ওই বছরের জুলাইয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চেক পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে তেঘরিয়া গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ সীমানা প্রাচীরের কাজ এখনও বাকি আছে। লেক নির্মাণ শেষ হলেও তা এখনও বুঝে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেকের পাড়ে মাটি আটকে রাখার জন্য পাথর ব্যবহার করলেও বর্ষার বৃষ্টিতে এবং পাড়ে গবাদিপশু বিচরণের কারণে মাটি ধসে লেকের কিছু জায়গা আবার ভরাট হয়ে গেছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় আটকে আছে মাটি ভরাটের কাজ। তবে চলছে ঘাট নির্মাণের কাজ। এছাড়া আর কোনো কাজই শুরু হয়নি।
প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে তা সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে এ সময়ের মধ্যেও প্রকল্প শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা।
ভূমি নিয়ে জটিলতা কোথায়?
পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের উপ-পরিচালক এবং নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ আলী আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরুতে স্থানীয় জমির মালিকরা বেশি দাম পাওয়ার লোভে কালক্ষেপণ করেছেন। এখনও ১১ দশমিক ৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাকি আছে। আশা করি শিগগিরই এটুকুও অধিগ্রহণ হয়ে যাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে ক্যাম্পাসের কিছু ‘অসাধু কর্মকর্তা’ এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নতুন ক্যাম্পাসের কাজের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেকেই জমিতে চাষাবাদ করে, মাছ চাষ করে, যদি ভবন দ্রুত উঠে যায় তাহলে এগুলো তো আর হবে না।
মাটি ভরাটের কাজ আটকে দরপত্র প্রক্রিয়ায়
প্রাথমিকভাবে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি পাওয়া গেলেও গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ২০০ একর জমি ভরাটের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে ৫০ একর করে চার ভাগে কাজ দেওয়ার কথা আছে।
এরপর ৮টির বেশি ঠিকাদারি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। অক্টোবরে দরপত্রগুলো যাচাই-বাছাই শুরু হয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র বাছাইয়ে জন্য নির্ধারিত তিন সপ্তাহ হলেও ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় নেয় কর্তৃপক্ষ।
পরে ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর তা অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এরপর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তা অনুমোদন পায়নি।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আলী আহমেদ বলেন, “সাবেক উপাচার্য অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকায় তা চূড়ান্ত করতে সময় একটু বেশি লেগেছে। এখন আবার নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন হওয়ায় কার্যক্রম শেষ করতে সময় লাগছে। ফাইল এখনও মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
“আমি মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করছি। দ্রুত তা পাস হয়ে যাবে জানিয়েছেন তারা। অনুমোদন হয়ে গেলেই কাজ শুরু হবে।”
দুই বছরেও হয়নি সীমানা প্রাচীর
৩০ কোটি টাকায় নতুন ক্যাম্পাসের পৌনে পাঁচ হাজার মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করার সময় নির্ধারিত ছিল এক বছর। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি হওয়ায় এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। দুই বছরেও সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার কোম্পানি।
সীমানা প্রাচীরের কাজ শেষ না হওয়ায় মাটি ভরাট, প্রকৌশল ভবন নির্মাণসহ অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণের কাজও শুরু করা যাচ্ছে না।
এ কাজ পাওয়া কিংডম গ্রুপের ঠিকাদার আনোয়ার ব্যাপারী বলেন, “সীমানা প্রাচীরের প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ। মুজাহিদনগরের পাশে কিছু এবং রেললাইনের পাশে এক হাজার ফুটসহ আর মাত্র সাড়ে চার হাজার ফুট বাকি আছে।
“জমি অধিগ্রহণের কিছু সমস্যা থাকায় আমাদের কাজে দেরি হচ্ছে। অধিগ্রহণ শেষ হলেই মোটামুটি তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কাজে দেরি হওয়ায় আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি।”
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণ দেখালেও তা মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের দাবি, অধিগ্রহণ জটিলতায় আছে মাত্র ১১ একর জমি। কিন্তু ঠিকাদার দুই বছরে বাকি জায়গার কাজও শেষ করতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, “মাটি ভরাটের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। টেন্ডার পাস হলে কাজ শুরু হবে। দ্রুত টেন্ডার হয়ে গেলে জুনের আগেই কাজ শেষ করা যাবে বলে আশা করছি। আর সীমানা প্রাচীরের কাজ আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
বাংলা বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিদুয়ান ইসলাম বলেন, “সীমানা প্রাচীর আর লেক নির্মাণ বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত সবার আগে শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েকটি হল নির্মাণ করা। হল নির্মাণ হলে আবাসিক শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম।
“ভিসিদের আসা-যাওয়ার মধ্যেই আটকে আছে নতুন ক্যাম্পাস। আমাদের কথা ভাবার মত কেউ নাই, দ্রুত নতুন ক্যাম্পাসে হল নির্মাণের দাবি জানাই।”
ক্ষোভ প্রকাশ করে গণিত বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী চয়ন কৃষ্ণ দেব বলেন, “২০২০ সালে ক্যাম্পাসে ঢুকেই শুনেছিলাম নদীর ওপাড়ে আমাদের আরেকটি বড় ক্যাম্পাস হবে। ভেবেছিলাম আবাসিক হলের অভিজ্ঞতা এক বছরের জন্যে হলেও পাব। কিন্তু এখন যে অবস্থা, আগামী ১০ বছরেও মনে হয় না নতুন ক্যাম্পাসের মুখ দেখব।”
নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উপাচার্য হিসেবে আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। প্রকল্পগুলো সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছু জানা হয়নি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পরে বলতে পারব।
“এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। আমি খুব শিগগিরই নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শনে যাব।”
পুরনো খবর