“দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুনছি শুধুমাত্র ক্যাম্পাস হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না।“
Published : 04 Nov 2024, 03:57 PM
কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়াসহ তিন দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পৌঁছে সেখানে সড়ক অবরোধ করেন। ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থান করার পর সাড়ে ১২টার দিকে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যান।
অবরোধ চলাকালে 'দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের আবাসন, কবে দিবে প্রশাসন?’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘যত পারো রক্ত নাও, সেনাবাহিনীর হাতে ক্যাম্পাস দাও’, ‘জমি নিতেই ৬ বছর, হল হতে কয় বছর?’, ‘টেন্ডারবাজ প্রশাসন, চলবে না চলবে না’, ‘মুলা ঝুলানো প্রশাসন, চলবে না, চলবে না’, ‘বছরের পর বছর যায়, প্রশাসন শুধু মুলা ঝুলায়'– ইত্যাদি স্লোগান তোলেন শিক্ষার্থীরা।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ আবর্তনের শিক্ষার্থী তৌসিফ মাহমুদ সোহান বলেন, “আমাদের যে তিন দফা দাবির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, তা মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতদিন শিক্ষার্থীদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসছে।
"শিক্ষার্থীরা আসলে কী চায়, তাদের সমস্যা কোথায়, কিভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়– এসব বিষয়ে বর্তমান প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নাই। আমরা আজকের মধ্যে কোনো আশ্বাস না পেলে আবার কর্মসূচি দেব। কর্মসূচিগুলো অবশ্যই কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। আর প্রশাসন যদি লিখিতভাবে আমাদের তিন দফার বাস্তবায়ন করে, তবে আমরা কর্মসূচি থেকে সরে আসব।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, “দ্বিতীয় ক্যাম্পাস আমাদের নৈতিক অধিকার। আমাদের হল নাই, ক্যাম্পাস নাই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুনছি শুধুমাত্র ক্যাম্পাস হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না।“
শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি হল, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রকল্প পরিচালককে আইনের আওতায় আনা, সাত দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর দক্ষ অফিসারদের হাতে নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই ঘোষণা দিয়ে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার রূপরেখা স্পষ্ট করা।
দ্বিতীয় দাবি হল অবিলম্বে ক্যাম্পাসের জন্য অবশিষ্ট ১১ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া। আর পুরাতন ক্যাম্পাস নিয়ে বিগত সরকারে আমলে করা সব চুক্তি বাতিল করা তাদের তৃতীয় দাবি।
তাঁতীবাজারে সড়ক অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নূর নবী বলেন, “যেখানে এক থেকে দুই বছরে একটা পূর্ণাঙ্গ কাজ হয়ে যায় সেখানে বছরের পর বছর কাজ চলে, কিন্তু শেষ হয় না। প্রশাসনের গড়িমসি এখানে স্পষ্ট। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে কিন্তু কাজের অগ্রগতি থাকে না। সেনাবাহিনীর কাছে এই ক্যাম্পাসের কাজ অতিদ্রুত হস্তান্তর করতে হবে।“
তিনি বলেন, “আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমরা যে দাবি নিয়ে আসছিলাম বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে; তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। এর একটা ছোট উদাহরণ হল, আমাদের নতুন ক্যাম্পাসের কাজের কোনো অগ্রগতি নাই। আমাদের আন্দোলন ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ না নতুন ক্যাম্পাসের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।”
আটকা উপাচার্যের গাড়ি, হেঁটেই গেলেন ক্যাম্পাসে
তাঁতীবাজার মোড়ে রাস্তা অবরোধের সময় গুলিস্তান সড়কের বংশাল মোড়ে যানজট তৈরি হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিমের মাইক্রোবাস আটকে পড়ে। পরে বাধ্য হয়ে উপাচার্য পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাসে পৌঁছান।
উপাচার্য রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি, এর বিরোধিতা কেউ করছে না। তাহলে আবার আন্দোলন কেন? রাস্তা অবরোধ করে জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি না করে তারা আমাদের সাথে বসতে পারত।
“আর পিডির বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, তাকে তো সরানো কঠিন কিছু না। শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা আমাদের কাছে আসুক, আমরা কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।“
উপাচার্যের ভাষ্য, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করি। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস, আবাসিক হল এসব বিষয় সবসময়ই গুরুত্ব পায়। এমনকি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য অস্থায়ী ভবন খুঁজছি।”
শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের জানাশোনা কোনো ভবন থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানাতে বলেন উপাচার্য।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
জবির নতুন ক্যাম্পাস: ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়নে আর কতদিন?
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে নতুন ক্যাম্পাসের নকশাও দেখানো হয় ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ওই বছরের জুলাইয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চেক পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে তেঘরিয়া গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ সীমানা প্রাচীরের কাজ এখনও বাকি আছে। লেক নির্মাণ শেষ হলেও তা এখনও বুঝে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেকের পাড়ে মাটি আটকে রাখার জন্য পাথর ব্যবহার করলেও বর্ষার বৃষ্টিতে এবং পাড়ে গবাদিপশু বিচরণের কারণে মাটি ধসে লেকের কিছু জায়গা আবার ভরাট হয়ে গেছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় আটকে যায় মাটি ভরাটের কাজ। তবে ঘাট নির্মাণের কাজ হয়েছে। এছাড়া আর কোনো কাজই শুরু হয়নি।
প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে তা সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে এ সময়ের মধ্যেও প্রকল্প শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা।