“প্রয়োজনে এখানে আমাদের সকলের গণকবর হবে তাতেও আমাদের আপত্তি নাই। আমাদের মানাতে না এসে, আপনারা কোথায় গেলে আমাদের এখান থেকে উঠাতে পারবেন আপনারা সেখানে যান।"
Published : 12 Jan 2025, 04:39 PM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের অবশিষ্ট কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী আবাসনের দাবিতে ডাকা অনশনে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে।
রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তিনজন শিক্ষার্থী অনশন শুরু করেন। পরে বেলা ১০টার মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আরও নয়জন, পরে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আরো কিছু শিক্ষার্থী এসে অনশনে বসেন। সবশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন্য শিক্ষার্থী দাবি আদায়ে অনশন কর্মসূচি পালন করছেন।
শিক্ষার্থীরা মূলত তিনটি দাবি নিয়ে অনশনে বসেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
১.সেনাবাহিনীর কাছে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ হস্তান্তরের চুক্তি অবিলম্বে স্বাক্ষর করতে হবে।
২. পুরান ঢাকার বাণী ভবন ও ড. হাবিবুর রহমান হলের স্টিল বেইজড ভবনের কাজ দ্রুত শুরু এবং শেষ করতে হবে।
৩. যতদিন পর্যন্ত আবাসনের ব্যবস্থা না হয় ততদিন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
অনশনে বসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের ‘পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে’ শিক্ষক সমিতি। দুপুর ১টার দিকে শহীদ মিনারের সামনে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষকরা। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার খাওয়ার অনুরোধ জানালেও তাতে সাড়া মেলেনি।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন শিক্ষার্থীদের বলেন, “তোমরা আমাদের সন্তান। তোমাদের এভাবে অনশনে রেখে আমরা শিক্ষক সমিতি বসে থাকতে পারি না। আমরা তোমাদের সব দাবির সাথে একমত। তোমরা যে কর্মসূচি দাও, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমরা চাই, এখন তোমরা শিক্ষক সমিতির সঙ্গে দুপুরের খাবার খাও। আমরা প্রশাসন থেকে আসিনি। আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে এসেছি।"
আহবান প্রত্যাখ্যান করে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি এ কে এম রাকিব বলেছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ ছাড়বেন না।
শিক্ষকদের উদ্দেশে রাকিব বলেন, “আমরা না খেয়ে থাকার কারণে যদি আপনারা খাইতে না পারেন তাহলে আপনারা মন্ত্রণালয়ে যান, ইউনিজিসি কিংবা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চলে যান। প্রয়োজনে এখানে আমাদের সকলের গণকবর হবে তাতেও আমাদের আপত্তি নাই। আমাদের মানাতে না এসে, আপনারা কোথায় গেলে আমাদের এখান থেকে উঠাতে পারবেন আপনারা সেখানে যান।“
রাতেও অনশন কর্মনূচি চলমান থাকবে কী না প্রশ্নে রাকিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের অনশন রাত্রেও চলমান থাকবে।"
অনশনরত শিক্ষার্থী ফেরদৌস শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সরকার থাকাকালে যদি আমরা আমাদের মৌলিক দাবি দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও আবাসন সংকটের সমাধান করতে না পারি, আর কখনোই তা সম্ভব হবে না। কারণ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ১৮/১৯ বছরেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যাকাডেমিক সুযোগ সুবিধা, আবাসন ব্যবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশ গড়তে পারেনি।
“এই সরকার জনগণের সরকার, বিপ্লবীদের সরকার, আমরা আশা রাখি তারা আমাদের দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে অতিদ্রুত দাবিগুলো বাস্তবায়ন করবে। তাই আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, ২০ হাজার শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত আমরা অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাব।"
আরেক শিক্ষার্থী তানজিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যে তিন দফা দাবিতে অনশন কর্মসূচি পালন করছি, তা আদায়ের লক্ষ্যে জবিয়ানরা জবির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ আন্দোলনও করেছে। জবি প্রশাসনের আশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন বন্ধ করে আল্টিমেটাম দিয়ে রাখলেও প্রশাসন দৃশ্যমান কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
“তাই আমাদের প্রশাসন আমাদেরই আস্থা হারিয়েছে।প্রশাসনের সাথে আর লিয়াজোঁ নয়। আন্দোলন সংগ্রাম করেই আমাদের অধিকার আদায় করে নেব ইনশাআল্লাহ।"
কেন আন্দোলন
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়াসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত ৫ নভেম্বর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন।
এরপর ১১ নভেম্বর ইউজিসি প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পে জগন্নাথের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিসহ ৫ দাবিতে সচিবালয় ‘ঘোরাও করেন’ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সেদিন শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তারা সচিবালয়ের বাইরে অবস্থান নেন। এরপর তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের তিন দিন সময় চাইলে সচিবালয়ের সামনের অবস্থান থেকে সরে যান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে পরদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরে সায় দেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সচিবালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, “তারা (শিক্ষার্থীরা) চাচ্ছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হোক। তাতে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো স্বায়ত্তশাসিত অনেকাংশে, তারা যদি সেটা চায় তাহলে ইউজিসির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের এতে কোনো আপত্তি নেই।
“বরং আমরা সহায়তা করব, কী করে তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া যায়। মন্ত্রণালয় এতে সহায়তা করবে।”
এরপর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গড়ত সপ্তাহে অনশনের ডাক দেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রাইটস সোসাইটির সভাপতি মাসুদ রানা অভিযোগ করেন, দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ দ্রুত শেষ হচ্ছে না ‘প্রশাসনের গাফিলতির কারণে’।
শিক্ষার্থীদের দাবি ও অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম গত ১০ জানুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৯ বছরে যা হয়নি সেই কাজগুলো এখন করতে গেলে খানিকটা সময় লাগবে।
“দুর্নীতিতে জর্জরিত দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের প্রকল্পকে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে সেনাবাহিনী। কোনো নেতিবাচক প্রকল্প তারা সাধারণত নেয় না। আমরা তাদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
উপাচার্য বলেন, “ইউজিসি এখন সাত কলেজের কাজে ব্যস্ত, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তারা জানিয়েছে, আমাদের ফাইল রেডি আছে।”
শিক্ষার্থীদের অনশনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আমরা নির্দিষ্ট করে কোনো সময় বলতে পারব না। এখানে সব কাজ আমাদের হাতে বিষয়টা এমন না। অনেক কাজ ইউজিসির হাতে, তারা কত সময় নেবে তা আমরা বলতে পারি না।
“আমরা চেষ্টা করে যেতে পারি। আমরা একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও অস্থায়ী আবাসনের আপডেট জানাব এবং শিক্ষার্থীদের বোঝাব। তাদের কাছ থেকে যদি কোনো ভালো ধারণা আসে, তাহলে আমরা সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে আগাব।”
সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক কোন বাধা আছে নাকি জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “এরকম কোনো বাধার প্রশ্ন ওঠে না। কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে চাইলে আমরা সেটা হতে দেব না।”
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: অনশনে বসেছেন জগন্নাথের ১২ শিক্ষার্থী
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: জগন্নাথে গণ অনশনের ডাক
জগন্নাথের নতুন ক্যাম্পাসের 'কাজ পাচ্ছে' সেনাবাহিনী
সচিবালয় 'ঘেরাওয়ে' জগন্নাথ শিক্ষার্থীরা, দেখা চান উপদেষ্টার
প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে জগন্নাথ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
জবির নতুন ক্যাম্পাস: ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়নে আর কতদিন?
জগন্নাথের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের দাবি