“বলা বারণ ছিল। ছেলের লাশটা বেশিক্ষণ রাখতেও দেয়নি। থানা থেকে পুলিশ এসে বলে, দাফন করেন। ওকে রাতেই দাফন করা হয়। তারপর সবকিছু শেষ," বলেন ’পুলিশের গুলিতে নিহত’ বুয়েটের শিক্ষার্থী রেহানের মা।
Published : 24 Nov 2024, 12:27 AM
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী শাপলা চত্বরে হেফাজতের ইসলামের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন দাবি করে তার মা আক্ষেপ করে বলেন, ওই সময়টাই ছেলের মৃত্যু কীভাবে হল সেটাও কাউকে বলা যেত না।
শনিবার বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রকৌশল বিভাগের আইএসি সেমিনার রুমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করছিলেন এ বিভাগের শিক্ষার্থী রেহান আহসানের মা ইফাত আরা বেগম।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় সংর্ঘষের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন রেহান বলে অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন তার মা।
“আমার ছেলে যে কীভাবে মারা গেছে এই কথাটা কাউকে বলতে পারতাম না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বলা বারণ ছিল। ছেলের লাশটা বেশিক্ষণ রাখতেও দেয়নি। থানা থেকে পুলিশ এসে বলে, দাফন করেন। ওকে রাতেই দাফন করা হয়। তারপর সবকিছু শেষ।"
শনিবার কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রকৌশল বিভাগে রেহানের স্মরণে শোকসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
এতে স্মৃতিচারণ করে ইফাত আরা বেগম বলেন, "আমি কখনই ভাবি নাই, রেহানের কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ হবে। সে আমার বড় সন্তান ছিল। অনেক আদরের, অনেক আশার ধন, ওর বাবার কলিজার টুকরো, আমার তো বটেই।
“তানভীর, ফয়সাল সেদিন রেহানের পাশে ছিল। সন্ধ্যার সময় রেহানের সাথে কথা বলেছিলাম। ফোনে তাকে বললাম বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো। সে বলল, মা আমি মসজিদে। তখন লাইনটা কেটে গেল। পরে কল দিতে থাকলাম, কিন্তু কল আর যাচ্ছে না।"
পরের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, "রাত ১০টায় টিভির সামনে বসে আন্দোলনকারীদের উপর নিপীড়ন দেখছিলাম। মনের মধ্যে অশান্তি লাগছিল। অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার ছেলেটা আসবে এবং সারাদিনে যা ঘটেছে বলবে। ১০টায় হঠাৎ করে ফোন এল। রেহানের মাথায় গুলি লাগছে। রাতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পেলাম না। দেড়টায় বাসায় ব্যাক করলাম।
”সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছিল সকালে বের হয়ে খুঁজব। ফজরের আজান পর্যন্ত অপেক্ষা করে বের হয়ে যাই। নিজেকে সকাল পর্যন্ত আটকে রাখতে পারি নাই। খুঁজতে খুঁজতে ঢাকা মেডিকেল মর্গে পেলাম আমার ৫ ফিট ১০ ইঞ্চি ছেলেটা। শরীর বেয়ে রক্ত ঝরে যাচ্ছে। এভাবে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে তা চিন্তাও করি নাই।"
রেহানের মা বলেন, "গ্রামের বাড়ি নওগাঁয় নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে শুধু একবারই ছেলেকে দেখার সুযোগ পাই। থানা থেকে পুলিশ এসে তাড়াতাড়ি দাফন করতে বলে।
”ছেলে যে কীভাবে মারা গেছে এই কথাটা বলতে পারতাম না, বলতাম একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে।”
রেহানের নিহতের হওয়ার প্রভাব তার বাবার ওপর পড়েছিল তুলে ধরে ইফাত আরা বলেন, “তার বাবা তাকে অনেক ভালোবাসত। সেই কষ্টটা নিতে পারে নাই। আমার মত কথা বলতে পারত না। তার কথায় ছিল শূন্যতা। এক বছর তিন মাস পর রেহানের বাবাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।
”এক সাথে দুটো যন্ত্রণা বহন করতে হয়েছে। যেখানে ছেলের শোকই শেষ হয় নাই, সেখানে স্বামী হারানোর কষ্ট শুরু হয়। তীব্র সংগ্রাম করে এই পর্যন্ত টিকে আছি।"
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, "আমরা স্বাধীনতার জন্য, অধিকারের জন্য আন্দোলন করব কিন্তু এর জন্য একটা পরিবেশ দরকার।
"বাবারা, শেষ পর্যন্ত নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যেও। আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ চাই। যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন রেহান দেখেছে। তোমরা দেখেছো। পরবর্তী প্রজন্ম যেন একটা জঞ্জাল মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে পারে। আর যেন কোনো মাকে সন্তান হারাতে না হয়।"
শোকসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক আল আমিন সিদ্দিক, অধ্যাপক মো. ইউনূস আলী, রেহানের ছোট বোন ফারিয়া স্মরণী।