বেলা গড়িয়ে যায়, তবু অপেক্ষা টিসিবির পণ্যের

দীর্ঘ অপেক্ষা আর ভোগান্তি পোহালেও কাউকেই খালি হাতে ফিরতে দেখা যায়নি।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2023, 05:50 PM
Updated : 26 March 2023, 05:50 PM

“তৃতীয় রোজায় চিনি, তেল-ডাল দিবে জানছি। তাই সেহরি খাইয়া ফজরের আজান দেওনের পরপরই নামাজ পড়ছি। ঘর ঝাড়ু না দিয়াই বাইরাইয়া পড়ি। অন্ধকার থাকতেই আইস্যা পড়ছি দোকানের সামনে। কার্ড জমা নিছে সকাল ৮টায়। এহনও রাস্তার পাশে রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়ায়, কহনো বইসা আছি। কিন্তু ডাহে না।“

রোববার দুপুরে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় টিসিবির ডিলার পটুয়াখালী এন্টারপ্রাইজের সামনে অসহায়ত্বের কথা এভাবেই বলছিলেন রিনা আক্তার। 

পঞ্চাশোর্ধ এ নারী যখন ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় ভর্তুকি মূল্যের চিনি, মশুর ডাল, সয়াবিন তেল, ছোলা ও খেজুর হাতে পান, তখন ঘড়ির কাঁটায় ২টা বাজে; অপেক্ষা করতে হয়েছে ৮ ঘণ্টার বেশি।

সেখানেই ফাতেমা বিবি কার্ড জমা দিয়েছিলেন সকাল ৭টায়। বিকাল ৪টার সময়ও পণ্য পাননি বলে জানালেন তিনি।

আর ফজরের নামাজ শেষ করেই ডিলারের দোকানের সামনে এসেছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। বললেন, “পুরুষদের লাইনে আমি দাঁড়াই তৃতীয় নম্বারে। কার্ড জমা নিছে ৭টায়। বেলা ৯টায় বউরে লাইনে রাইখা গেছি কামে। এহন বিকাল তিনটা বাজলেও ডাক দেয় নাই। পরে কার্ড দিলেও অনেকরে আগে দিছে।”

ভিড়ের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়া সালমা আক্তার বললেন, “পুরা একটা বেলা চইলা গেল। বাসায় পোলাপান আছে-রোজা রাইখ্যা আবার বিকালে ইফতারি ও রাতের খাওন রানতে হইব। সরকার আমাগো দিকে তাকাইয়া অল্প টাকায় মাল দিতাছে। ডিলারের কারণে সেই মাল পাইতে জান বাইরাই যাইতাছে।”

টিসিবির পণ্য পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা আর ভোগান্তির কথা এভাবেই বলছিলেন সীমিত আয়ের এসব মানুষ। রোজা রেখে দিনমান দাঁড়িয়ে শরীর যে কুলায় না, তবুও অপেক্ষায় ছিলেন শেষ পর্যন্ত। বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অবশ্য সেখানে কাউকে খালি হাতে ফিরতে দেখা যায়নি।

পণ্য সরবরাহ যথেষ্ট থাকার কথা জানিয়ে কার্ড লিপিবদ্ধকারী মো. আল-মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কার্ড জমা দিয়ে পরেও মাল (পণ্য) নিতে পারবে।’’

পণ্য পেতে এত দীর্ঘ অপেক্ষার কারণ জানতে চাইলে ডিলারের এ প্রতিনিধি বললেন, ‘‘কয়েকজন অনুরোধ করায় তাদের পণ্য আগে দিতে হয়েছে।’’

লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের অভিযোগ, প্রভাবশালীদের পরিচয় ব্যবহার করে অনেকেই পরে এসে কার্ড জমা দেওয়া মাত্রই পণ্য পেয়েছেন। আর অপেক্ষা করতে হয়েছে আগেভাগে আসা ব্যক্তিদের।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আল-মামুন কোনো জবাব দিলেন না। তবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জনকে পণ্য দেওয়া গেছে বলে জানালেন তিনি।

রোজার মাসে সারা দেশে এক কোটি পরিবারকে ‘ফ্যামেলি কার্ড’র মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পাঁচটি পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে এক কেজি চিনি ৬০ টাকায়, ৭০ টাকা দরে দুই কেজি মশুর ডাল, লিটার প্রতি ১১০ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৫০ টাকায় এক কেজি ছোলা ও ১০০ টাকায় এক কেজি খেজুর বিক্রি করা হচ্ছে।

পাঁচটি পণ্যের মধ্যে খেজুর শুধু ঢাকা সিটির জন্য; এখানে প্যাকেজ মূল্য ধরা ৫৭০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৭০ টাকা।

তবে ঢাকার সবখানে একসঙ্গে পণ্য দিতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

দৈনিক সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৭৫ হাজার উপকারভোগীকে পণ্য বিতরণ করার সামর্থ্য রয়েছে জানিয়ে টিসিবির ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়োগ করা ডিলারদের মাধ্যমে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ওয়ার্ড ও ডিলারদের পণ্য দেওয়া হবে।’’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কুতুবখালী, দক্ষিণ কাজলা, দক্ষিণ কাজলা (নয়ানগন), ছনটেক, শেখদী, গোবিন্দপুর, উত্তর রায়েরবাগ মিলিয়ে টিসিবির ডিলার রয়েছেন পাঁচজন। রোববার তাদের মধ্যে শেখদী, গোবিন্দপুর, উত্তর রায়েরবাগ এলাকার জন্য অনুমোদিত ডিলার পটুয়াখালী এন্টারপ্রাইজ টিসিবির পণ্য বিক্রি করে।

এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দায়িত্ব পেয়ে ১২ হাজার ১৫২ জনকে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড দিয়েছি।’’

একজন ডিলারের মাধ্যমে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার উপকারভোগীকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে টিসিবি।

সংস্থাটির কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, “বেলা ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করবেন ডিলাররা। এরপরও কোনো ক্রেতা থাকলে পণ্য থাকা সাপেক্ষে বিক্রি করবেন। পণ্য না থাকলে পরের পর্যায়ে তিনি পণ্য পাবেন।”

রাত ৯টার সময়ও যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ৫০ নম্বর ওয়ার্ড অফিস থেকে টিসিবির পণ্য বিক্রি করছিলেন মেসার্স আশরাফুল স্টোরের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ২০০ জন পণ্য নিয়ে গিয়েছে। যে পণ্য আছে তা শেষ করতে রাত ১১টা বাজবে।”

পণ্য বিক্রিতে এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তেল ছাড়া বাকি চারটা পণ্য মাপতে হয়। কর্মীরা তা মাপার পর পণ্য দিতে একজনকে অন্তত ৫ মিনিট সময় দিতে হয়।

“আবার কেউ কেউ দুইটা কার্ড নিয়ে আসছেন। তাদের ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। এ কারণেই দেরি হচ্ছে। কিন্তু মাল (পণ্য) পায় নাই এমন কেউ নাই।’’

আবার পণ্য পেয়েও বিক্রি শুরু করেনি যাত্রবাড়ীর আরেক ডিলার। টিসিবির কাছ থেকে শনিবার ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ টাকার পণ্য উত্তোলন করেছে যাত্রাবাড়ীর ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের মীরহাজীরবাগ এলাকার ডিলার মেসার্স মমতাজ এন্টারপ্রাইজ।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মমতাজ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার সব কিছু ওজন করে প্যাকেট করছি। সোমবার বেলা ১০টা থেকে বিক্রি করব। বিক্রির সময়ে প্যাকেট করলে সময় বেশি লাগে।’’

তদারকি কমিটির দেখা নেই

পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম তদারকি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরকে প্রধান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কমিটি করেছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন টিসিবির যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন কবির।

তবে জনদুর্ভোগ কমিয়ে আনতে এমন কোনো কমিটির কার্যক্রম দেখা যায়নি। জানতে চাইলে ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোস্তাক আহমেদ বললেন, এমন কমিটি গঠন সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।