নরওয়ের টেলিকম কোম্পানিটির গ্রুপ সিইও সিগভে ব্রেক্কে সম্প্রতি দুদিনের জন্য ঢাকা আসেন। সফরকালে বিনিয়োগ, মার্জার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ভয়েস-ডেটাসহ বাংলাদেশের বাজার নিয়ে সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সবিস্তারে।
Published : 15 Apr 2024, 01:31 AM
গ্রামীণফোন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়া বা অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হওয়ার কথা আপাতত ভাবছে না টেলিনর। বরং আরও ২৭ বছরের কাজের পরিকল্পনা করে বাংলাদেশে এগিয়ে যাওয়া চিন্তাভাবনা নরওয়ের কোম্পানিটির। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমেই ব্যবসা করে যেতে চায় তারা।
বাংলাদেশে গ্রাহক ও আয়ের বিচারে বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোণের মূল কোম্পানি নরওয়েভিত্তিক টেলিনরের গ্রুপ সিইও ও প্রেসিডেন্ট সিগভে ব্রেক্কে তাদের এমন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন।
দুদিনের সফরে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেছেন তিনি। সফরকালে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে টেলিনরের সিইও এর আলাপকালে গ্রামীণফোন ও টেলিনর নিয়ে উঠে এসেছে আরও অনেক কথা।
এতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে টেলিনরের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া, অন্য অপারেটরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রসঙ্গের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমের ‘দখল’ নিয়ে টানাটানির প্রসঙ্গও ছিল।
১৯৯৭ সালে বেসরকারি অপারেটর হিসেবে কার্যক্রম শুরু করা গ্রামীণফোনের ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশের মালিকানা টেলিনরের হাতে, ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ গ্রামীণ টেলিকমের হাতে এবং বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। বাংলাদেশের বড় বিদেশি বিনিয়োগের একটি গ্রামীণফোন। টেলিনরের হিসাবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৬ বছরে কোম্পানিটি ৪৯৯ বিলিয়ন টাকা এদেশে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম করপোরেট করদাতা গ্রামীণফোন।
নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারে মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে বিনিয়োগ করেছিল। পরে ভারতে এয়ারটেলের সঙ্গে একীভূত হয়। মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২২ সালে মার্চে প্রতিষ্ঠার আট বছর পর নিজেদের গুটিয়ে নেয়। গত ডিসেম্বরে পাকিস্তানে বিক্রির ঘোষণা এসেছে।
সিগভে ব্রেক্কের নেতৃত্বাধীন টেলিনর বর্তমানে আট দেশে সেবা দিচ্ছে; যেখানে তাদের গ্রাহক প্রায় ২১ কোটি, কর্মী সংখ্যা ১১ হাজার। ২০২৩ সালে আয়ের পরিমাণ ছিল ৮১ বিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনার।
এশিয়ায় দীর্ঘদিন টেলিনরের নেতৃত্ব দেওয়া ব্রেক্কে এ অঞ্চলের টেলিযোগাযোগ খাত নিয়ে অভিজ্ঞ। প্রতিবেশী তিন দেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে তিনি বলছেন, বাংলাদেশের গ্রামীণফোন থেকে বিনিয়োগ গুটিয়ে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই টেলিনরের। বরং অপারেটরটির নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, ফাইভ জিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ধারাবাহিক বিনিয়োগ চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাদের।
শুধু তাই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এর মতো উন্নতর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার আগ্রহের কথা বলেছেন টেলিনর প্রধান। বলছেন, আগামীতে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এআই বৈপ্লবিক একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে যাচ্ছে; যেটিকে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘পারফেক্ট স্টর্ম’ হিসেবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ঘুরে এমন আভাস পাওয়ার কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশের সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসা করে যাওয়ার পরিকল্পনার ইঙ্গিতও মিলেছে তার কথায়।
৬৫ বছর বয়সী সিগভে ১৯৯৮ সালে টেলিনরে যোগ দেওয়ার পর টেলিনর এশিয়ার এমডি, এশিয়া অঞ্চলের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৫ সাল থেকে মূল কোম্পানির সিইও। এ অপারেটরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে ১৯৯৩ সালে তিনি নরওয়ের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপমন্ত্রী ছিলেন।
প্রশ্ন: কতদিন পর ঢাকায় এলেন? ঢাকায় নতুন কী পরিবর্তন দেখছেন?
উত্তর: গত ছয় মাসে এটা আমার তৃতীয়বার ঢাকায় আসা। প্রথমবার যখন আসি তখন ১৯৯৯ সাল। আমি টেলিনর ও গ্রামীণফোনের সঙ্গে আছি বহু বছর ধরে। এই ২৫ বছরে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে যেটা না বললেই নয়, এখন বাংলাদেশের রাস্তাগুলো দেখুন, নতুন নতুন স্থাপনাগুলো-এগুলো দারুণ। মানুষের হাতে হাতে ফোন হয়েছে, তারা যোগাযোগ করতে পারছে। এটা কিন্তু তখন ছিল না।
২৭ বছর আগে আমরা একটা বাজি ধরেছিলাম। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি এই বাজি ছিল ‘বাংলাদেশে কত মানুষের হাতে মোবাইল ফোন থাকবে’। এ প্রশ্নে আমাদের পর্ষরে কেউ একজন বলেছিলেন, ‘না, এটা কেবল ধনী লোকেদের হাতেই যাবে।’ আরেকজন বলেছিলেন, ‘না, এটা সবার হাতেই থাকতে হবে’ এবং ‘এটা আমাদের ওপরই নির্ভর করবে আমরা এটা সবার জন্য দিতে পারব কী না’।
এরপরই আমরা ডিস্ট্রিবিউটর, খরচ আর বাজার সম্পর্কে স্টাডি শুরু করি। আমি মনে করি সেটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। এখন আমি এই টিমকে আরেকটি নতুন বাজি ধরতে বলি, সেটা হচ্ছে-‘আমরা কি বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজড করতে পারব?’ এখানকার সব মানুষ কি ডেটা ব্যবহার করতে পারবেন? এটা শুধু ডেটা দিয়ে ফেইসবুক বা ব্রাউজিং করার বিষয় নয়। এটা জীবনের প্রয়োজনে ডেটা সার্ভিসগুলো ব্যবহার করা।
আমি মনে করি বাংলাদেশে ডেটার একটা বড় উল্লম্ফনের সুযোগ আছে, যেটা অন্য অনেক দেশে হতে বহু বছর লেগে গেছে। মানুষ এখানে ‘ডেটা হাংরি’। এখন এটা আমাদের ওপর নির্ভর করবে আমরা তাদের সেই প্রয়োজনীয় সেবাগুলো দিয়ে যেতে পারবো কি না। এটা সাধারণ গ্রাহক এবং ব্যবসার জন্য এবং সরকারি খাতের জন্যও। আমি মনে করি আগামী ২৭ বছরের জন্য ডেটা এবং ডিজিটাল সেবাগুলো নিশ্চিত করতে আমাদের এখনি প্রস্তুত হতে হবে। সমাজকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। সুতরাং আমি খুবই আশাবাদী।
প্রশ্ন: এশিয়ায় কয়েকটি দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে টেলিনর। অন্য অপারেটরের সঙ্গে একীভূতও হয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে টেলিনর কতখানি দায়বদ্ধ?
উত্তর: আমরা এখানে আগামী বছরগুলোতে সেবা দিতে ভীষণভাবে দায়বদ্ধ। এজন্য আমি আমাদের প্রথম ২৭ বছরের লক্ষ্য পূরণ শেষে এখন আগামী ২৭ বছরের প্রস্তুতির কথা বলছি। আগামী এক বা দুই দশকের জন্য আমরা খুবই দায়বদ্ধ।
কিছু মার্কেট থেকে আমাদের বের হয়ে যাওয়া এবং কিছু মার্কেটে একীভূত করার সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। আমরা দেখেছি এসব বাজারে তিনটির বেশি অপারেটর হলে যথেষ্ট ব্যবসা করা সম্ভব নয়। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় আমরা অন্য অপারেটরের সঙ্গে একীভূত হয়ে এখন মার্কেটে নাম্বার ওয়ান অবস্থানে আছি।
কিন্তু পাকিস্তানে এটা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা চিন্তা করেছি এখান থেকে গুটিয়ে নিয়ে সম্ভাবনাময় মার্কেটগুলোতে মনোযোগ দেওয়া বেশি ভালো হবে। বাংলাদেশে আমরা শীর্ষ অবস্থানে এজন্য আমি গর্বিত।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের টেলিকম খাতে নিয়ন্ত্রকদের ভূমিকা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী? ২০২২ সালে গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল সে বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
উত্তর: নিয়ন্ত্রণ সব দেশেই আছে। আমি বলব না যে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এটা বেশি কঠোর বা সহজ। তবে সিম বিক্রিতে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল সেটা ভালো নয়। আমি এটা পছন্দ করিনি কারণ এটা উচিৎ হয়নি। এছাড়া সব দেশেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কম-বেশি এক রকম। আমরা এ বিষয়ে মনোযোগী হতে চাই কী করে সরকার ও টেলিকম খাত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আমরা তো পরস্পরের শত্রু নই, আমরা বন্ধু। আমরা তো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের কথা বলি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যে ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির কথা বলছেন, তাদের সেটা করতে হলে মোবাইল অপারেটরগুলোকে নিয়ে করতে হবে। এবং আমাদের দিক থেকে আমরা সবাইকে ডেটা সেবার আওতায় আনতে চাই। সবার কাছে ডিজিটাল সেবাগুলো পৌঁছে দিতে চাই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সঙ্গে নিয়েই এ লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই আমি আরও বেশি করে আশা করি আমরা অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে কাজ করে নিজ নিজ লক্ষ্য অর্জন করব।
প্রশ্ন: গ্রামীণফোনের ৩৪ শতাংশ এখনও গ্রামীণ টেলিকমের হাতে। গ্রামীণ টেলিকমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। টেলিনর ব্যবসার যে মানসম্মত পরিবেশ চায় সেটা কী এ মুহূর্তে বিরাজ করছে এখানে?
উত্তর: হ্যাঁ, আমরা আমাদের পুরনো অংশীদার ড. ইউনুস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিষয়ে সংবাদগুলো পড়ছি। কিন্তু আমরা এটার অংশ নই। আমরা শুধু আমাদের ব্যবসায় মনোযোগী হতে চাই। আসলে সংবাদমাধ্যমে যা দেখছি এর বাইরে আমরা কিছু জানি না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন?
উত্তর: বাংলাদেশে ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপ হলে তো আমরা এখানে থাকতাম না। যেমন পাকিস্তানে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে আমরা সেখান থেকে গুটিয়ে নিতে চাইছি। এটা ভালো এই অর্থে যে আমরা এখান থেকে আয় করতে পারছি। আমরা যখন কোনো দেশে যাই, দুটো বিষয় দেখি: প্রথমত হচ্ছে অবশ্যই আমাদের অর্থ আয় করতে হবে, কারণ আমাদের শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা মানুষকে কানেক্টিভিটি দিয়ে সমাজে একটা পরিবর্তন আনতে চাই। যেটা আমরা বাংলাদেশে করতে পারছি।
প্রশ্ন: ফাইভ জি প্রযুক্তি এখন নতুন বাস্তবতা। এটা নিয়ে টেলিনর বাংলাদেশে কী করার পরিকল্পনা করছে এবং অন্য দেশের বাজারগুলোতে কী করছে?
উত্তর: কিছু নর্ডিক মার্কেটে গত ৪-৫ বছর ধরে আমরা ফাইভ জি সেবা দিচ্ছি। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা হল-সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে এটা ফোর জি থেকে খুব বেশি পার্থক্য তৈরি করে না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আপনি ফোর জি দিয়ে যা করতে পারছেন, ফাইভ জিতে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবেন না। ফাইভ জি শুধু গতি দেয় না।
এখানে কয়েকটা বিষয় আছে- যেমন লেটেন্সি বাড়িয়ে দেয় (লেটেন্সি হচ্ছে সাড়া দেওয়ার সময়, লেটেন্সি বাড়ানো মানে সাড়া দেওয়ার সময় কমে যায়)। সাধারণ গ্রাহকের জন্য এটা কোন পার্থক্য তৈরি করে না। ফাইভ জির উপযোগিতা আছে একটি সমুদ্রবন্দর কিংবা বিমানবন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে।
মালয়েশিয়ায় এভাবে সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করা হচ্ছে। নরওয়েতেও বিমানবন্দরে সেটা ব্যবহার করা হয়। যখন তুষারপাত শুরু হয় তখন বিমানবন্দর পরিষ্কার রাখার জন্য যে ট্রাকগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে কোনো চালক থাকে না। ফাইভ জি প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলো পরিচালনা করা হয়। হাসপাতাল, শিল্প উৎপাদনে ফাইভ জি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেকটা পৃথক যন্ত্রে একটা সিমকার্ড থাকে। যেগুলো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়।
আমি বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ে যেটা আলোচনা করেছি এখানে ফাইভ জি চালু করতে হলে এর উপযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো কারখানা, সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দরে এটা ব্যবহার হতে পারে। আমাদের ইউজ কেস দেন, আমরা ডেমো দেখাব।
প্রশ্ন: ফাইভ জি চালু হলে টুজি, থ্রিজি, স্পেক্ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: অনেক দেশেই এটা টুজি, থ্রিজি স্পেক্ট্রাম সাট ডাউন করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। কারণ এখানে এখনও আমাদের অনেক গ্রাহক শুধু ভয়েস কল ব্যবহার করছেন। সবাই ডেটা ব্যবহার শুরু করলে এটা করা সম্ভব।
প্রশ্ন: সরকার সম্প্রতি একটি ইউনিফাইড লাইসেন্সের মাধ্যমে অনেকগুলো ডিজিটাল সেবা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা বাস্তবায়নে গ্রামীণফোন কী করছে?
উত্তর: আমরা খুবই খুশি যে সরকার ইউনিফাইড লাইসেন্স দিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা বহু বছর ধরে কথা বলছিলাম। এই ধরনের লাইসেন্স বৈশ্বিক অন্যান্য বাজারগুলোতে কাজের সুবিধা করে দিয়েছে। তাই আমরা এটা পেয়ে খুবই খুশি। আমরা এর মধ্যেই ফিক্সড ওয়্যারলেস সেবা দেওয়া শুরু করে দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হল আমরা দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে ডেটা সংযুক্ত করতে চাই। এখন আমরা ফোরজির মাধ্যমে দেশের বেশির ভাগ জায়গায় মানুষকে সংযুক্ত করতে পেরেছি।
প্রশ্ন: গ্রামীণফোন বাংলাদেশে বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়েছে এরকম কথা রয়েছে। আপনি কী তাই মনে করেন?
উত্তর: একদমই না। আমি এটাকে বৈরী (হোস্টাইল) বলব না। গ্রামীণফোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে যেরকমটা টেলিনর যেসব দেশে কাজ করছে সব জায়গাতেই হচ্ছে। এটাই তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ, অপারেটররা আইন মেনে চলছে কী না তা নিশ্চিত করা। যেমন সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাসহ আরও কিছু বিষয়ে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে একমত নেই। কিন্তু এখানে তারা তাদের কাজ করছে, আমরা আমাদেরটা। এটা বৈরী কোনো পরিবেশ নয়, এটা আলোচনা হওয়ার মতো। তবে এটা দ্বিপাক্ষিক হতে হবে।
রেগুলেটর কী চায় এটা নিয়ে আমাদের কথা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন: আজকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে মিটিংয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কী প্রয়োজন। আমি পাল্টা জানতে চাইলাম, আপনাদের কী প্রয়োজন। আলোচনায় আমরা বলেছি আমাদের আরও স্পেক্ট্রাম দরকার, আর ফাইভ জি চালুর জন্য দরকার ‘ইউজ কেসেস’। তিনি বলেছেন, ’আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বানাতে চাই’। এটাই হচ্ছে ডায়লগ।
প্রশ্ন: আপনি নরওয়ের সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এরপরে টেলিনর এশিয়ায় কাজ করেছেন। এখন টেলিনরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থেকে আমি মানুষের চাহিদাগুলো সম্পর্কে কৌতুহলী হতে শিখেছি, কীভাবে সেগুলো পূরণ করা যায় সেগুলো জানতে শিখেছি।
আমি বড় হওয়ার পর আমার বাবা গল্প বলেছিলেন, ইউরোপের একটি জুতা কোম্পানির গল্প এটি। তারা দুজন কর্মীকে আফ্রিকা পাঠাল। তাদের একজন ফিরে এসে জানাল, আফ্রিকায় জুতার কোনো বাজার নেই, কারণ তারা জুতা পরেই না। আরেকজন ফিরে এসে জানাল, আফ্রিকায় বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ তাদের কারই জুতা নেই। এটা হচ্ছে চিন্তা।
বাংলাদেশে আমাদের চিন্তাগুলো এমন ছিল, কারণ এখানে কারও মোবাইল ফোন ছিল না। এশিয়ায় বাংলাদেশে আমাদের প্রথম বিনিয়োগ ছিল। এখান থেকে উৎসাহিত হয়ে আমরা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, মিয়ানমারে বিনিয়োগ করি। টেলিনরের অনেক উদ্ভাবন এসেছে গ্রামীণফোন থেকে, যেই অভিজ্ঞতা আমরা পরে অন্য বাজারগুলোতে ব্যবহার করেছি।
আমি এটাও শিখেছি যে প্রযুক্তি কীভাবে কীভাবে দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। আমি দুই মাস আগে আমেরিকায় গুগল, ফেইসবুক, আমাজনের অফিস ঘুরে এসেছি। সেখানে দেখে এসেছি যে এআই প্রযুক্তি কীভাবে দ্রুতগতিতে তাদের ‘বিজনেস মডেলে’ পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। আমি এটাকে বলছে ‘পারফেক্ট স্টর্ম’।
এখানে শুধু মানুষ নয় জিনিসগুলোও সংযুক্ত থাকছে ফোরজি ও ফাইভ জি প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই এআই এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এআই, মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে কানেক্টিভিটি এবং ডেটা নেটওয়ার্ক এই তিনটা বিষয় যখনি একত্রে ঘটবে তখন আপনি একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এবং এটা খুব দ্রুত ঘটছে। তাই বাংলাদেশ ও এরকম অন্য দেশগুলোর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন: ভয়েস কল কমছে। এখানে উচ্চ করের কথাও বলে আসছে অপারেটররা। আবার দাম বেড়ে গেলে গ্রাহকদের সমস্যা। এ বাজারে শুধু ডেটা বিক্রির ব্যবসা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
উত্তর: আমাদের অর্ধেক গ্রাহকের স্মার্টফোন আছে, বাকি অর্ধেক ফিচার ফোন ব্যবহার করছেন এবং তারা শুধু ভয়েস কলের ওপর নির্ভর করছেন। কিন্তু এখন ভয়েস কল গ্রাহকের সংখ্যা এক জায়গায় থমকে আছে। এখন আমরা ডেটা ব্যবহারকারী বাড়ানোর উপায় খুঁজছি। তাদের শুধু ফেইসবুক ব্যবহারের জন্য ডেটা দেওয়ার বিষয় না, আমরা তাদের ডিজিটাল সেবার আওতায় আনার চেষ্টায় আছি। আমি খুবই গর্বিত যে এখন জিপি অ্যাপ দেশের এক নম্বর অ্যাপ, যা প্রায় আট কোটি মানুষ ব্যবহার করছে। এটা একটা উদাহরণ ডেটার বাইরে আরও কিছু দেওয়ার।
এরপর আমাদের এটাও ভাবতে হয় এটা গ্রাহকদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে কি না। চালের দাম বাড়ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে… জীবন এটাই। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের ভাবতে হয় আমাদের গ্রাহকদের জন্য কী করে আরও সহায়ক হতে পারি। এটা আমাদের কাজ। আমরা তো শুধু বসে বসে অভিযোগ করতে পারি না। তাহলে তো ব্যবসা করতে পারবে না। আমরা প্রত্যেকটা অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে পারি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের টেলিকম খাতের কর কাঠামো সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
উত্তর: নিয়ম-কানুন ও কর কাঠামো বিষয়ে আমাদের অনেক রকম বক্তব্য থাকতে পারে। তবে সরকার যা চায় সেটাকেও তো আমাদের সম্মান জানাতে হবে। আমরা আমাদের মতামতগুলো জানাচ্ছি। যেমন- অনেকদিন থেকেই আমরা ইউনিফাইড লাইসেন্সের কথা বলে আসছিলাম। সেটা এখন সরকার শুনেছে। আমরা অনেকদিন থেকেই স্পেক্ট্রামের কথা বলছিলাম, প্রতিমন্ত্রী বলেছেন তারা বিষয়টি দেখছেন। আমরা কর কমানোর কথা বলে আসছি, তারা শুনছে না।
এ সময় পাশে বসা গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, বাংলাদেশে টেলিকম সেবা শুরু করার সময় এটি বিলাসী পণ্য হিসেবে ৪০ শতাংশ কর ধার্য করা হয়। এটা কিন্তু এখন আর বিলাসদ্রব্যের মধ্যে পড়ে না। আমাদের আশপাশের দেশ ভারত, নেপার এমনকি পাকিস্তানে এই করহার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে। আমরা কথা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করি এটারও সুরাহা হবে।
প্রশ্ন: এশিয়ার অন্য বাজারগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কর এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে আপনি কিভাবে তুলনা করছেন?
উত্তর: এখানে উচ্চ করহার। তবে রেগুলেটরের বিষয়টি নিয়ে তুলনা করা কঠিন, এটা নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমি বলতে চাই করহার অনেক বেশি।
প্রশ্ন: স্মার্টফোন এখনও সবার হাতে যায়নি, ফোরজির বিস্তারও ধীর। দাম সাধ্যের বাইরে এমন অভিযোগও রয়েছে। এসবের সমাধান কী বলে মনে করছেন?
উত্তর: মূল সমস্যা হচ্ছে হ্যান্ডসেটের দাম। আমরা দেখেছি কোভিডের আগে অনেক মানুষ স্মার্টফোন নিয়েছেন, পরে যেটা কমে গেছে। স্মার্টফোনের দাম কমানোর ক্ষেত্রে কী করা যায় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সমস্যা হচ্ছে স্মার্টফোন আমদানি করতে উচ্চ শুল্ক দিতে হয়। আপনাকে হয় শুল্ক কমাতে হবে, না হলে স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন: এখানে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
উত্তর: আমাদের ফোর জি নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করব, যাতে গ্রামেও মানুষ যুক্ত হতে পারে। আমরা ইনডোর ইন্টারনেট দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে স্পেক্ট্রাম বরাদ্দ চেয়েছি। এটার জন্য কমদামে স্পেক্ট্রাম প্রয়োজন। আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং আমরা এটা চালিয়ে যাব। কারণ আমরা দেখছি আমাদের নেটওয়ার্ক সবসময় আপগ্রেড করার প্রয়োজন হচ্ছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে অপারেটরগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সার্বিক পরিবেশকে কিভাবে দেখছেন?
উত্তর: ভালো। রবি ও বাংলালিংক ভালো প্রতিযোগী। এটা একটা খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসা। এখানে গ্রাহক চাহিদা মেটানোর প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রতিদিনই জিততে হয়। এটা না পারলে আপনি হেরে যাবেন।
মোবাইল অপারেটরগুলোর আরও প্রতিযোগিতা চান জিপি সিইও
প্রশ্ন : নয় বছর আগে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা, বীমা, শিক্ষা ও আর্থিক সেবা দেওয়ার কথা বলেছিলেন আপনি। সেগুলোর এখন কী অবস্থা?
উত্তর: আমরা অনেকদিন চেষ্টা করেছি একটা লাইসেন্স পেতে। কিন্তু সেটাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের কিছু বিনোদন সেবা আছে।
এ সময় ইয়াসির আজমান বলেন, আমরা নিজেরা স্বাস্থ্যসেবাসহ কিছু সেবা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এখন সেটা অংশীদারদের মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের উন্নয়নে কিভাবে অবদান রাখার পরিকল্পনা আপনাদের?
উত্তর: আমরা মনে করি ফাইভজির মাধ্যমে সুযোগ আছে, বড় ব্যবসার বিকাশে অবদান রাখার। এখানকার বিজনেস কাস্টমারদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। আমি মনে করি সব ধরনের ব্যবসায় সেই ‘পারফেক্ট স্টর্মে’র আঘাত আসবে।
আমরা তরুণদের ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করছি, যার আওতায় ১০ লাখ তরুণকে সুযোগ দেওয়া হবে। আমরা ২৩ লাখ প্রান্তিক নারীর সঙ্গে কাজ করছি। এর বাইরে প্রায় এক কোটি শিশুর জন্য অনলাইন নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি আছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও আমরা কাজ করছি।