আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন: বাফেদার দর নির্ধারণের অপেক্ষা

তিন মাসের বেশি সময় পরও বাফেদা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা গতিশীল হচ্ছে না বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2022, 05:57 PM
Updated : 6 Sept 2022, 05:57 PM

মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত মেনে একই দরে ডলার কেনাবেচায় সম্মত হলেও সেই দরটি এখনও নির্ধারণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা।

ব্যাংকাররা মনে করছেন, তিন মাসের বেশি সময় পরও বাফেদা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা গতিশীল হচ্ছে না।

এদিকে দেশে ডলার কেনাবেচা করা ডিলার ব্যাংকগুলোর এ সংগঠনের নেতৃত্বেও পরিবর্তন এসেছে গত ২৮ অগাস্ট। ফলে আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনে একক হার নির্ধারণে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকে নতুন এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন মো. আফজাল হোসেন; এখন তিনি সংগঠনের নেতৃত্বেও আসবেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘আরজেএসসিতে আবেদন করা হয়েছে (কমিটির সদস্যদের) নাম পরিবর্তনের জন্য। আশা করি এ সপ্তাহে আমরা বাফেদার বৈঠক করতে পারব।”

শিগগিরই আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর নির্ধারণ এবং বাজার সক্রিয় হওয়ার আশার কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘আগামী সপ্তাহে বাফেদা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যাচ্ছে।”

সরবরাহে টান পড়ে চাহিদা বাড়লে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ডলারের দর বাড়তে থাকে। আর চলতি বছরের মার্চের পর থেকে সংকট তীব্র হলে ক্রমে আকাশচুম্বী হতে থাকে প্রধান এ বিদেশি মুদ্রার দর। এরপর অস্থিরতা কমাতে নীতি সিদ্ধান্তসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ধারাবাহিক এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত ২৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে বাফেদা ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সঙ্গে। ওই বৈঠকে নির্দিষ্ট একটি ‘সিলিংয়ের’ মধ্যে আন্তঃব্যাংকে লেনদেনে ডলারের একক দর নির্ধারণের সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছিল বাফেদা।

বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। নিয়মিত টাকার মান কমানোর পাশাপাশি চাহিদা মেটাতে বড় অঙ্কের ডলারও বিক্রি করে আসছিল।

তখনই আলোচনা শুরু হয়েছিল, একক দর নির্ধারণ করবে বাফেদা। ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ডলারের বিনিময় হার কেমন হবে সেটির প্রস্তাব দেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই দর বাস্তবায়নে তদারকি করবে।

ওই বৈঠকের পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে বাফেদা একটি প্রস্তাবও জমা দেয়। সে অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্ত এলেও পরের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে।

এর মধ্যে ডলারের সংকট আরও বাড়লে এবং আন্তঃব্যাংকে কোনো নির্দিষ্ট দর না থাকায় বাড়তি মুনাফা করতে কিছু ব্যাংক ডলার লেনদেন একেবারে কমিয়ে দেয়। এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে।

সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো দেশের অন্য ব্যাংকে ডলার না পেয়ে আমদানি দায় মেটাতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে বা অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে উচ্চ দরে ডলার কিনতে বাধ্য হয়। কখনও কখনও গ্রাহককেও ডলার সংগ্রহ করতে হয়।

এ সময়ে ব্যাংকে নগদ ডলারের দর ওঠে ১০৭ টাকা, আর খোলা বাজারে এক পর্যায়ে তা রেকর্ড ১২১ টাকায় ওঠে। এখন খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৩-১০৪ টাকায়, যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে ৯৫ টাকা দরে।

এমন প্রেক্ষাপটে বাফেদার কার্যক্রমে গতি না আসায় আবারও সংগঠনটির সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গত ১৪ অগাস্টের বৈঠকে ব্যাংকের নগদ ডলার কেনা ও বেচার ব্যবধান সর্বোচ্চ এক টাকার করার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকে আন্তঃব্যাংক লেনদেন বাজার সক্রিয় করতে আবারও সংগঠনটি প্রস্তাব দেবে বলে জানায়। তবে তিন সপ্তাহ পার হলেও সেই প্রস্তাব এখনও জমা পড়েনি।

যা বলছে বাফেদা

আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন বাজার উন্নয়নে ১৯৯৩ সালে অগাস্টে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী ও প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয় বাফেদা। এখন এর সদস্য ৪৪টি ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই বাফেদার চেয়ারম্যান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বদল আসে। গত ২৮ আগস্ট যোগ দেওয়া নতুন এমডি আফজাল করিম পদাধিকার বলে বাফেদার নেতৃত্বে আসবেন। ফলে আগের এমডি আতাউর রহমানের জায়গায় তার নাম আরজেএসসি (রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ) থেকে অনুমোদন নিতে হবে।

একইভাবে এমডি পদে বদল আসা বাফেদার সদস্য অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

সোনালী ব্যাংক ইতোমধ্যে আরজেএসসিতে আবেদন করেছে জানিয়ে এমডি আফজাল বলেন, চলতি সপ্তাহে তারা বাফেদার বৈঠক করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

সদস্য ব্যাংকগুলোর এমডিরা বলছেন, ডলারের দর নির্ধারণ ও আন্তঃব্যাংকে লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে যে প্রস্তাব দেওয়ার কথা, তা নিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেছেন।

ব্যাংকগুলো এখন বিদেশি উৎসগুলো থেকে বিভিন্ন দরে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করছে। দর নির্ধারণ করা হলে ডলার সংগ্রহ কমে যাবে কি না- তা নিয়েও আলোচনা চলছে। আবার দর নির্ধারণ করা হলে তা সদস্য ব্যাংকগুলো মানবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

পাশের দেশ ভারতে ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (ফেদাই) বিদেশি মুদ্রা সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে।

কিন্তু বাংলাদেশের বাফেদার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাফেদা এটা নিয়েও আলোচনা করছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছে। বাফেদার কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার আকারে জানিয়ে দিতে পারে।”