কারখানা পরিদর্শনের পাশাপাশি দেশজুড়ে অভিযানে নেমে ডিলার ও দোকানিদের জরিমানাও করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
Published : 22 Oct 2022, 10:25 PM
উৎপাদন অর্ধেকে নামার দাবি করে চিনি পরিশোধনকারী দুই শিল্পগ্রুপ সিটি ও ফ্রেশ এর জন্য গ্যাস সংকটকে দায়ী করছে।
চিনির দাম চড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এর কারণ খতিয়ে দেখার অংশ হিসেবে শনিবার নারায়ণগঞ্জের মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত চিনি পরিশোধনকারী তিন কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সিটি ও ফ্রেশ গ্রুপ এবং আবদুল মোনেম লিমিটেডের কারখানা পরির্দশন করে।
এসময় কারখানাগুলোর উৎপাদন ও বিপণনের তথ্য সংগ্রহ করে দলটি। এতে তারা উৎপাদন কমার তথ্য পেলেও মিল গেইটে সরকার নির্ধারিত দামের বেশি নেওয়ার তথ্য পায়নি বলে জানিয়েছেন পরিদর্শন দলের সদস্য জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাগফুর রহমান।
তিনি বলেন, “সিটি ও ফ্রেশ রিফাইনারির কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, সক্ষমতার অর্ধেকে নেমেছে তাদের উৎপাদন। কোম্পানির লোকজন জানিয়েছেন, গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমেছে।“
পরিদর্শনে যাওয়া আরেক কোম্পানি আবদুল মোনেমের উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।
ঢাকার মিরপুরে ৭ চিনি বিক্রেতাকে জরিমানা
বেশি দামে চিনি বিক্রি: বরিশালে ৬ ব্যবসায়ীকে জরিমানা
বেশ কিছুদিন থেকে বাড়তে থাকা চিনির দর হঠাৎ করে একশ টাকা ছাড়িয়ে যায় গত সপ্তাহের শুরুতে। পরে বাজারে চিনি কমে যাওয়ার অজুহাতে খোলা চিনির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে কেজিপ্রতি ১১০ টাকা।
অথচ গত ৬ অক্টোবর বাজারে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির মধ্যেই চিনির দাম কেজিতে আরও ৬ টাকা বাড়ানো হয়।
ওই দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের এক সভা শেষে মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ নতুন দর ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী কেজিপ্রতি খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ৯৫ টাকা।
এরপর কিছুদিন এ দরে কেনাবেচা হলেও গত সপ্তাহের শুরু থেকে দাম বাড়তে শুরু করে। সরবরাহ সংকটের অজুহাত তুলে বাজারে চিনির সংকট দেখা যায়। অনেক বাজারের দোকানে চিনি নেই বলে ক্রেতাদের জানানোর মধ্যে দাম আরও বাড়ানো হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে বাজার পর্যবেক্ষণে জোরদার করতে দেশজুড়ে অভিযানও শুরু করে ভোক্তা অধিদপ্তর। কেনাবেচার চালান না থাকাসহ বেশি দাম নেওয়ায় জরিমানাও করা হয় অনেক ডিলার ও দোকানিকে। পাশাপাশি চিনি পরিশোধনকারী কারখানা পরিদর্শনে প্রতিনিধি দল পাঠায়।
শনিবার নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত তিনটি কারখানায় গিয়ে পরিদর্শনকারী দলটি দুটি কারখানায় উৎপাদন সংকটের তথ্য জানতে পারে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাগফুর জানান, পরিদর্শনকালে তারা উৎপাদন ও মিল গেইটে বিক্রির তথ্যসহ বিপণনের কাগজপত্র যাচাই করেছেন। কিছু কাগজপত্র সঙ্গেও নিয়ে এসেছেন। সেগুলো আরও খতিয়ে দেখার কথা জানান তিনি।
পরিদর্শনের বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্যাস সংকটে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৩ হাজার ২০০ টন থেকে ১০০০-১২০০ টনে নেমেছে। আমরা বিষয়টি বিভিন্ন মহলে জানিয়েছি।”
গত এক-দেড় মাস ধরে গ্যাস সরবরাহে এই সংকট দেখা দিয়েছে বলে দাবি তার।
ইউক্রেইন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়াসহ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খোলায় ঋণ দেওয়া সীমিত করার প্রভাব চিনি উৎপাদন ও দাম নির্ধারণে পড়ছে বলে জানান আমদানিকারক ও পরিশোধন খাতের ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে গ্যাস সংকটের মধ্যে উৎপাদন কমার কথাও বলেন তারা।
এর মধ্যেই সরকার কেজিতে ছয় টাকা দাম বাড়ানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে তা আরও বেড়ে একশ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
হঠাৎ করে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে রাজধানীর মিরপুর, কারওয়ান বাজার, সেগুনবাগিচা ও যাত্রাবাড়ীর খুচরা পর্যয়ের দোকানিরা জানিয়েছেন, বাজারে চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো চিনি দিচ্ছে না।
চিনির বাজারে অস্থিরতার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দেশবন্ধু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সমস্যার সমাধান পাচ্ছি না। বাজারে চিনির সরবরাহ কিছুটা কম আছে। তবে সরকার নির্ধারিত দামেই চিনি দেওয়ার চেষ্টা করছি। এতে আমাদের লোকসান হচ্ছে।”
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) শনিবারের ঢাকা মহানগরীর বাজার দরের তথ্য বলছে, রাজধানীতে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, যেখানে এক সপ্তাহ আগে এই দর ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে পরিশোধিত চিনির চাহিদা হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশি চিনিকলগুলো এক লাখ টনের মত চিনি উৎপাদন করতে পারে, বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কেবল অগাস্টেই ১ লাখ ৩৩ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ডলারের বেশি।
আর ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে মিল মালিকরা তা পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করেন।