পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছেই, সরকারের ‘পর্যবেক্ষণ’ শেষ হচ্ছে না

১০ দিন আগে সরকার আমদানির কথা প্রথম বলার পর এই সময়ে দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা। এখনও পর্যবেক্ষণের কথাই বলা হচ্ছে।

ফয়সাল আতিকজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2023, 07:35 PM
Updated : 19 May 2023, 07:35 PM

ঈদের আগে থেকে পেঁয়াজের হঠাৎ বাড়তি দর ঈদ শেষে ছুটছে ‘রকেট গতিতে’। মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা ভোক্তাদের ওপর তৈরি করছে নতুন চাপ।

সরকার বলছে, বাজার ঠাণ্ডা করতে দরকারে আমদানির দুয়ার খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ১০ দিনেও বসতে পারেনি। তাতে থেমে থাকেনি দাম বাড়ার গতি।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিবিসির হিসাবে এক মাস আগে খুচরায় দেশি পেঁয়াজের দর ছিল ৩০ টাকা। সরকার প্রথম যখন আমদানির কথা বলেছিল, তখন দাম ছিল ৫০ টাকার ঘরে। এখন তা বড় বাজারে ছুঁয়েছে ৮০ টাকা, এলাকার দোকানে ৯০।

দেশের বাজারে শুধু এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২৫ টাকা। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এই টাকায় মিলছে ৫ কেজিরও বেশি।

দেশটির বিভিন্ন বাণিজ্যিক পোর্টালে দেখা যাচ্ছে, সেখানে মান ও জাতভেদে কেজিপ্রতি দাম ৫ থেকে ১২ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় তা ৭ থেকে ১৫ টাকা।

আমদানি করলে ৩০ টাকার মধ্যে এসব পেঁয়াজ ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

পেঁয়াজের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি-এই তিন বিষয়ে সরকারের যে পরিসংখ্যান, তার সঙ্গে বাজারের আচরণের যুক্তি মেলে না।

সরকারি হিসাবে দেশে উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। তবে উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যায়। যে কারণে আমদানি করতেই হয়। তবে আমদানি পণ্যের দামের ওপরই নির্ভর করে দেশের বাজার।

২০১৯-২০ সালে ভারতে পেঁয়াজ সংকটের পর মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছিল। সে সময় দেশে কেজিপ্রতি দাম ওঠে ‍দুইশ টাকার বেশি।

সেই অভিজ্ঞতার পর দেশে চাষ বাড়ানোয় নজর দিয়েছে সরকার। দুই বছরে ১০ লাখ টন বাড়তি উৎপাদনের কথাও জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

ভরা মৌসুমে ভারতীয় পেঁয়াজ এলে যেন দাম পড়ে না যায়, সেজন্য আমদানি বন্ধ রাখা হয়। এই ‘সুযোগে’ বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন বাড়তে শুরু করে দর।

অবশ্য শহরে দাম বেড়ে গেলেও আমদানির আলোচনার পর মফস্বলে পাইকাররা কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে কৃষক ও মজুতদাররা বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ নিয়ে আসছেন। সেখানে চাহিদার চেয়ে যোগান বেড়ে যাওয়ায় কমছে দাম।

‘এই সময়ে দাম বাড়ার কারণই নেই’

রাজধানীর মৌলভীবাজারে পেঁয়াজের আড়ৎদার আব্দুল মাজেদ মনে করেন, মজুতদারির কারণেই বছরের এ সময়ে বাজার এভাবে চড়েছে। তার মতে, বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে কারণে দাম বেড়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মজুদ সংকটের কারণে দাম বাড়লে সেটা মৌসুমের শেষ দিকে হওয়ার কথা; এই সময়ে নয়।

“এক শ্রেণির মহাজন বা মজুতদার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের মত করে দাম বাড়াচ্ছে। যেসব বড় বড় চাষি সংরক্ষণের পদ্ধতি নির্মাণ করেছেন, তারাও এখন বাজারের সুবিধাটি পাচ্ছেন।”

আমদানি উন্মুক্ত করে দিলে কয়েকদিনের মধ্যে দাম পড়ে যাবে বলেই তার বিশ্বাস।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের মুখপাত্র ভোক্তাকণ্ঠের অবৈতনিক সম্পাদক মো. আব্দুল হান্নান বলেন, “এ বছর পেঁয়াজের ফলন ভালো হলেও বাজারে কিছু নতুন পাইকারি ক্রেতা ঢুকে পড়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। উত্তোলন মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বড় ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে পেঁয়াজ কেনা শুরু করেছে। এর ফলে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়ে দাম গেছে বেড়ে।

“এই বাড়তি দামের কারণে কৃষকরাও পেঁয়াজ হাতছাড়া করে দিচ্ছে। এতে আগামী জুন জুলাইয়ের দিকে যখন কৃষকের হাতে কোনো পেঁয়াজ থাকবে না। তখন বাজার কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটাই এখন শঙ্কার বিষয়।”

এখনও বাজার পর্যবেক্ষণ

দাম না কমলে আমদানি হবে, এই ঘোষণার পর দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলেও সরকার বাজার পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছে।

আমদানির অনুমোদন কবে মিলবে, জানতে চাইলে কৃষি সচিব ওয়াহিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও বাজারটা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। আমরাও দেখছি পেঁয়াজের দামটা বাড়ছে। আমরা বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”

Also Read: আমদানির ‘হুঁশিয়ারিতেও’ এক মাসে পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৮০

Also Read: দাম না কমলে শিগগির পেঁয়াজ আমদানি করা হবে: বাণিজ্যমন্ত্রী

সরকার ‘পর্যবেক্ষণ করতে করতে’ দাম বেড়ে যাওয়ার চিত্র দেখা যায় টিসিবির প্রতিবেদনেই। গত ১০ এপ্রিল খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে।

এক মাসের ব্যবধানে গত ১০ মে প্রতিকেজি দর উঠে ৬০ টাকায়। সেদিনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “পেঁয়াজের দাম এখন যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ বাড়ানো হবে।”

চার দিন পর পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সভা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কৃষি মন্ত্রণালয়। সভা শেষে সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, “দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যদি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে তাহলে আমদানি করা হবে।”

আরও পাঁচ দিন পর শুক্রবার ঢাকার বড় বাজারে ৮০ আর গলিতে ৯০ টাকা দরে রান্নার উপকরণটি  বিক্রির দিন নিজ জেলা রংপুরে গিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নে আবার বলেন, “পেঁয়াজের দাম বেড়েছে; বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। দু-একদিনের মধ্যে দাম না কমলে আমদানির ব্যবস্থা করা হবে এবং দ্রুতই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কত আমদানি প্রয়োজন

সরকারি হিসাবে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি এবার উৎপাদন ৩৪ লাখ টনের কাছাকাছি, যা বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি।

অবশ্য পেঁয়াজ পচনশীল এবং সংরক্ষণকালে ৩৫ শতাংশের মতো নষ্ট হয়, আবার ওজনও কমে। তাই কয়েক লাখ টন আমদানি করতেই হবে।

কিন্তু পেঁয়াজ উঠতে না উঠতে আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তে এমন দর বৃদ্ধি এর আগে দেখা যায়নি। কৃষক, ব্যবসায়ী, কৃষি কর্মকর্তা, সবাই এর পেছনে মজুদদারিকে দায়ী করেছেন।

কৃষি বিভাগের হিসাবে এবার কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ২৮ টাকার মত। ভারতে উৎপাদন খরচ হয় আরও কম। এ কারণে দাম ধরে রাখতে চেয়েছিল সরকার।

শহরে ঊর্ধ্বগতি, জেলার মোকামে দামে পতন

ঢাকায় ঊর্ধ্বগতি থাকলেও পেঁয়াজের জন্য বিখ্যাত পাবনার হাটে শুক্রবার দাম আগের সপ্তাহের তুলনায় কমেছে। এই জেলায় ৭ থেকে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, যা দেশের মোট উৎপাদনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

শুক্রবার ধানুয়াঘাটা ও হাজিরহাটে প্রকারভেদে মণ প্রতি দাম ছিল ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা। তিন-চার দিন আগেও মণ প্রতি ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি কমেছে ১৫ টাকার মত।

বালুঘাটা গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, “দাম বেশি দেখে পাঁচ মণ পেঁয়াজ নিয়ে আসছি। কী করব বুঝতে পারছি না। যেহেতু গাড়িভাড়া করে নিয়ে আসছি; তাই বিক্রি তো করতেই হবে।”

শরৎগঞ্জ বাজারের মারুফ অ্যান্ড সবুজ নামে আড়তের মালিক সাইফুল সরকার বলেন, “হঠাৎ করে ঢাকার পার্টির চাহিদা কম, বুঝতে পারলাম না। এ কারণে দাম কমে গেছে।”

আরিফপুর হাজিরহাটের কৃষক আব্দুল হক বলেন, ভারত থেকে আমদানির কথা শুনেই পাইকররা কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তবে বর্তমান যে দর, সেটা থাকলেও তাদের বেশ লাভ হবে।

ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বলেন, “যারা বাড়তি দামের আশায় মজুদ করেছিলেন, তারা এখন বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন। যার কারণে মোকামে সরবরাহ বেড়ে গেছে।”

মৌসুমের শুরুতে পাচনায় প্রতিমণ পেঁয়াজ ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আকারে বড় ও ভালো মানের কিছু পেঁয়াজ ১২০০ টাকা মণ ছিল।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক জামাল উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৌসুমের শুরুতে মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ বিক্রি হয়েছে। এখনো কৃষকের ঘরে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। তবে দাম বাড়ার ক্ষেত্রে মজুদদারের কারসাজি রয়েছে।”

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার কৃষক হুমায়ন কবীর বলেন, “পেঁয়াজ কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর এখন দাম হু হু করে বাড়ছে। সব পেঁয়াজ চলে গেছে ব‍্যবসায়ীদের হাতে।”

Also Read: পেঁয়াজের দাম ‘বাড়তে থাকলে’ আমদানি করা হবে: বাণিজ্যমন্ত্রী

Also Read: দাম বাড়লে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি ‘শিগগিরই’: কৃষিসচিব

তিনি জানান, এক মাস আগে ছিল মৌসুমে মণ প্রতি দাম ছিল ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা। কিন্তু উৎপাদন খরচ আছে ৭৫০ টাকার বেশি। ফলে কৃষকের লাভ হয়েছে কম। 

একই জেলার পাংশা উপজেলার চাষি সবুজ হোসেন বলেন, “আমরা কৃষক বিক্রি করলাম ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা দরে। অথচ অল্প সময়ের ব্যবধানে দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেল। কৃষকের লাভ না হলেও কেউ না কেউ লাভ তুলে নিচ্ছে।”

পেঁয়াজ চাষে প্রসিদ্ধ ফরিদপুরের বোয়ালমারীর উপজেলার ঘোষপুর এলাকার চাষি আশুতোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার ‘ভালোই’ লাভ হয়েছে তার।

আর জেলার কানাইপুর হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী বেলাল মাতব্বর বলেন, “চাষিরা এখনও ভালোই লাভ পাচ্ছে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন পাবনা প্রতিনিধি সৈকত আফরোজ আসাদ ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি শামিম রেজা ও ফরিদপুর প্রতিনিধি মফিজুর রহমান শিপন]