বাজার ঘুরে দুই একটি বাদে সব সবজির দামই চড়া দেখা গেছে। মুরগির দামেও একই অবস্থা। তবে মাছের দাম কিছু স্থিতিশীল আছে।
Published : 04 Oct 2024, 07:58 PM
ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-খরা, শীত কিংবা তাপপ্রবাহ- এমন নানা অজুহাতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর চর্চা অনেকদিন ধরেই চলছে। এবার বিক্রেতাদের জন্য অজুহাত হয়ে এসেছে কয়েকদিন ধরে চলা বৃষ্টি।
ক্রেতাদের অভিযোগ, এটা বিক্রেতাদেরই তৈরি করা অজুহাত।
শুক্রবার রাজধানীর মহাখালী, নিকেতন কাঁচাবাজার ঘুরে দুই একটি বাদে সব সবজির দামই চড়া দেখা গেছে। মুরগির দামেও একই অবস্থা। তবে মাছের দাম কিছু স্থিতিশীল আছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ সবজির দাম ৮০ টাকা। কিছু কিছু আবার শতকের ঘরও ছাড়িয়েছে। বাজারে ঢেঁড়স ৮০ টাকা , ধুন্দল ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ৯০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, কচুর ছড়া ৮০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, শিম ২০০ টাকা এবং পাকা টমেটো ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, লাউ আকৃতিভেদে ৬০ থেকে ১৫০ টাকা, শসা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কচুর লতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, জলপাই ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অনেকদিন ধরেই কাঁচামরিচের দাম বাড়তি। প্রতিদিনের রান্নায় দরকারি মসলাটি বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৫০ টাকা কেজি দরে।
গত সপ্তাহের তুলনায় কাঁচামরিচ কেজিতে অন্তত ১০০ টাকার ওপরে দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
এসব বাজারে লেবুর হালি ২০ থেকে ৫০ টাকা, ধনে পাতা কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাঁচা কলা হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায় এবং মিষ্টি কুমড়া কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজরে লাল শাক ১৫ টাকা আঁটি, লাউ শাক ৪০ টাকা, মূলা শাক ১৫ টাকা, পালং শাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, কলমি শাক ১০টাকা, পুঁই শাক ৫০ টাকা এবং ডাটা শাক ২০ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০ টাকা, আদা ২৮০ টাকা, রসুন ২২০ টাকা এবং আলু কেজি ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এসব বাজারে ৫ কেজি বোতলজাত সয়াবিন তেল ৮১৮ টাকা, দেশি মশুর ডাল ১৪০ টাকা, ভারতীয় মশুর ডাল ১২০ টাকা, মুগ ডাল ১৮০ টাকা, মিনিকেট চাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, পাইজাম ৭০ টাকা এবং নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বৃষ্টির পুরনো ‘অজুহাত'
সবজির দামের উল্লম্ফন নিয়ে বিক্রেতাদের সাথে কথা হলে তারা বললেন, বৃষ্টি আর বন্যার কথা।
নিকেতন কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা নিজাম উদ্দিন বলেন, “কাঁচামরিচ আমরা পাইকারি কিনছি গত সপ্তাহ থেকে ১০০ টাকা বেশি কেজি দরে। তাইলে কম বিক্রি করমু কেমনে?
“পাইকারের দাম শুইনা আমিও অবাক হইছি। ভাবলাম কিনমু কি কিনমু না। পরে বান্ধা কাস্টমারগো কথা চিন্তা কই কিনলাম।”
এই বাজারের আরেক সবজি বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, “আমি কাঁচামরিচ আনি নাই। মানুষ কিনতে আইসা গালি দিব, খামাখা গালি শুইনা লাভ আছে? এরচেয়ে দাম কমুক, তারপর আনমু।
“আর, এই কয়দিনের বৃষ্টিতে সবজি ক্ষেতের অনেক ক্ষতি হইছে। এজন্য কৃষক পর্যায় থেকেই দাম বাড়ছে। আমরা তো লাস্ট হাত, আমরা অহেতুক দাম বাড়াই না।”
তিনি আরও বলেন, “পাইকারগো মরিচের দাম বেশি কেন জিগাইলে তারা কয়, মরিচের ক্ষেতে পানি, উৎপাদন নাই, এইজন্য দাম বেশি।”
মহাখালী কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা আনিস বলেন, “উত্তরবঙ্গে এখনও বন্যা। আমি ওইদিক থেইকা সবজি আনি। এখন কুড়িগ্রামের সাইডে পানি, সবজি ক্ষেত পানির নিচে। সাপ্লাই নাই, তাই সবজির দাম বেশি। আর, মরিচের দাম কইমা যাইব, হঠাৎ কইরাই বাড়ছে, যেমন বাড়ে আরকি।”
‘মূল্যস্ফীতি কমল, দাম তো কমে নাই’
মহাখালী এলাকায় বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকুরে শামসুদ্দিন দিদার আক্ষেপ করছিলেন পণ্যমূল্য নিয়ে।
আরজতপাড়ার এই বাসিন্দা বলেন, “বিবিএসের রিপোর্টে দেখলাম সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে। ইনফ্যাক্ট, খাদ্যেও মূল্যস্ফীতি কমেছে। কিন্তু, বাজারে এসে তো সে ধারণা পালটে যাচ্ছে। রিপোর্টের ডেটা নিয়েই তো আমার সংশয় আছে। কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতি কমল, জিনিসপত্রের দাম তো কমে নাই।”
পণ্যের উচ্চমূল্যে ‘হিমশিম’ অবস্থা হলেও আন্দোলন, সংঘাত, বন্যা ও ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট অস্থিরতার ধাক্কা কাটিয়ে জুলাই-অগাস্টের পর দুই অংকের নিচে নেমে এসেছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অর্থাৎ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা এ বছরের সেপ্টেম্বরে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা।
জুলাইয়ে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ যা অগাস্টে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে।
পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪০; যা অগাস্টে ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, মাসের ব্যবধানে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে
নিকেতন কাঁচাবাজারে মাছ কিনছিলেন মহাখালী দক্ষিণপাড়ার জিয়াউর রহমান। বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন তিনিও।
বেসরকারি এই চাকুরে বলেন, “বাজারে এলেই সত্যিই ঘাম ছুটে যায়। আয়ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। দুই-তিন হাজার টাকার বাজার করলেও চার-পাঁচদিনে শেষ হয়ে যায়। সরকার তো পালটে গেল। কিন্তু, বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হলো না। তাহলে, আসল পরিবর্তন তো আর হলো না।”
সরকারকে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে মনযোগী হওয়ার আহবানও জানালেন জিয়াউর।
রিনা বেগম নামে একজন গৃহিণী বিরক্ত হলেন ডিম কিনতে এসে।
নিকেতনের এই বাসিন্দা বলেন, “মুরগির লাল ডিমের ডজন ১৮০ টাকা। আমাদের গ্রামে ফার্ম আছে। হলফ করে বলতে পারি এটা হাত ঘুরে বেড়েছে। ডিমের এত দাম হওয়ার কথা না।”
বাজারগুলোতে এক ডজন হাঁসের ডিম ২৩০ টাকায়, দেশি মুরগির ডিম হালি ৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
মুরগির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা
সবজির মতো স্বস্তি নেই মুরগির দামেও। গত সপ্তাহের মতো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মুরগি। গত সপ্তাহের তুলনায় ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গত সপ্তাহেও ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৯০ টাকা।
বাজারে সোনালি মুরগি ২৬০-২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর সোনালি হাইব্রিড ২৫০, দেশি মুরগি ৪৫০ থেকে ৫০০, লাল লেয়ার মুরগি ৩০০ থেকে ৩১০ এবং সাদা লেয়ার ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গরুর মাংসের দাম কেজি প্রতি ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় স্থির হয়ে আছে। এছাড়া গরুর কলিজা ৮০০ টাকা, গরুর মাথার মাংস ৪৫০ টাকা, গরুর ভুঁড়ি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা এবং খাসির মাংস কেজি প্রতি ১১৫০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজার স্থিতিশীল
বাজারে মাছের দাম গত সপ্তাহের মতো স্থিতিশীল আছে। তবে, তুলনামূলক ইলিশ মাছের সরবরাহ বেশি দেখা গেলেও দাম সাধারণের নাগালে আসেনি।
১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজনের জাটকা কেজি ৩২০-৩৫৯, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১ হাজার থেকে ১২০০, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৬০০ থেকে ১৭০০ এবং দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া শিং মাছ (আকারভেদে) ৩২০ থেকে ৪৫০, রুই মাছ আকৃতি ভেদে ৩০০ থেকে ৪৫০, দেশি মাগুর মাছ ৮০০ থেকে ১১০০, মৃগেল ২৮০ থেকে ৩২০, চাষের পাঙাস ২০০ থেকে ২২০, চিংড়ি আকৃতি ভেদে ৭০০ থেকে ১৪০০, বোয়াল মাছ ৫০০ থেকে ৮০০, কাতল ৩৫০ থেকে ৪০০, পোয়া মাছ ৪০০ থেকে ৫০০, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০, তেলাপিয়া ২২০, কৈ ২২০ থেকে ২৩০, মলা ৫০০, টেংরা মাছ ৬০০ থেকে ৮০০, কাঁচকি ৫০০, পাঁচ মিশালি ২২০, রূপচাঁদা ১২০০, বাইম মাছ ১২০০ থেকে ১৪০০, দেশি কই ১০০০, শোল ৬০০ থেকে ৯০০, বেলে ৮০০ এবং কাকিলা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।