মোটরগাড়ির ডেন্টিং মিস্ত্রি মো. সোহাগ প্রায় সাত বছর ওমানে থেকে চলতি বছর দেশে এসেছেন। এবার তিনি কর্মী ভিসায় সৌদি আরবে যাবেন। তবে বাদ সেধেছে টিকেটের দাম।
Published : 12 Dec 2021, 11:36 PM
সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে যে টিকেটের দাম ওঠানামা করত তা এখন ৯০ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। টিকেট কিনতে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে ঘুরছেন সোহাগ।
ট্রাভেল এজেন্টদের দাবি, ঢাকা থেকে রিয়াদ, দুবাই, আবুধাবি, দাম্মাম, মাস্কাট, দোহাসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব রুটেই টিকেটের দাম বেড়েছে। প্রায় সব এয়ারলাইন্সের টিকিটের দামই আগের চেয়ে অনেক বেশি।
কোভিড পরিস্থিতি নিম্নমুখী হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির বাজারগুলোতে প্রবাসী কর্মীদের ডাক পড়া শুরু হলে যাত্রী বেড়েছে; টিকিটের এ বাড়তি চাহিদার কারণেই মূলত দাম বাড়ানো হয়েছে।
রোববার টিকেটের মূল্য অনেক বাড়ানোর বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, “আমরা চাই না আমাদের প্রবাসীরা বাড়তি অর্থ খরচ করে ফ্লাইটের টিকেট কাটুক। বিষয়টি নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডির সঙ্গে কথা বলেছি।
“অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছি। চেষ্টা করছি টিকেটের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে।“
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিডের কারণে লকডাউন পরবর্তী ফ্লাইটের টিকেটের দাম বাড়ার এ সংকট শুধু বাংলাদেশেই। আশেপাশের ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা কোথাও এমন পরিস্থিতি হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের টিকিটের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন টিকিটের ঊর্ধ্বমুখী দামের বিষয়ে এই চিঠি পাঠানোর কথা সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
টিকিটের বাড়তি দামের এ পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের সংগঠন আটাব এর সভাপতি মনছুর আহমেদ কালাম এয়ারলাইন্সগুলোর ‘এক ধরনের কারসাজি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে; না হলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েই যেতে হবে।
ক্ষুব্ধ এই ট্রাভেল এজেন্ট এয়ারলাইন্সগুলোকে দায়ী করে বলেন, “টিকিটের রেট হচ্ছে ৪০ হাজার। যে কয়টা আছে আপনারা বেচবেন। এরপরে শেষ হয়ে গেলে বলবেন আর নাই। কিন্তু তাদের কাছে গেলে তারা বলছেন টিকিট আছে, তাৎক্ষনিকভাবেই দিতে পারবেন। কিন্তু দাম লাগবে ৮০ হাজার টাকা। এটা হলো ‘ঠেকাইয়া’ টাকা নেওয়া।“
টিকেট বিক্রির ওয়েবসাইট ফ্লাইট এক্সপার্টে ২৮ ডিসেম্বর সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ইকোনমি ক্লাসে ঢাকা থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার টিকিটের মূল্য দেখাচ্ছে ৮৮ হাজার ৪৮ টাকা। জেদ্দার দ্বিগুণেরও বেশি দূরত্বের নিউ ইয়র্কের (জেএফকে) একই দিনে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ভাড়া দেখাচ্ছে ৬২ হাজার ৬২২ টাকা।
এয়ারলাইন্সগুলোর ওয়েবসাইটে ঢাকা থেকে জেদ্দা যেতে সাত ঘণ্টা ৫০ মিনিট এবং নিউ ইয়র্কে যেতে ৩১ ঘণ্টা পাঁচ মিনিট (একটি বিরতিসহ) লাগার কথা বলা হয়েছে। তবে ট্রাভেল এজেন্টরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ফ্লাইটগুলোতেও এখন একই সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোভিডের পর থেকেই বাড়তি ভাড়া নেওয়ার এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। বাড়তি উড়োজাহাজ ভাড়ার পাশাপাশি প্রবাসী কর্মীদের কোভিড টেস্টের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। কোথাও গিয়ে তাদের নিজ খরচে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে।
“এসব কারণে অভিবাসন ব্যয় এমনিতেই বাড়ছে। বিমানের বাড়তি ভাড়া মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এতে অভিবাসন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।“
তার ভাষ্য, বাড়তি ভাড়া নেওয়ার এ প্রবণতা শুধু বাংলাদেশেই। আশপাশের ভারত, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কাতে এত পরিমাণে ভাড়া বাড়েনি।
অভিবাসন বিষয়ক আঞ্চলিক কয়েকটি বৈঠকে অংশ নিতে বর্তমানে ভারতের দিল্লিতে অবস্থানরত শরীফুল মোবাইল ফোনে বলেন, দিল্লি থেকে এয়ার এরাবিয়ায় জেদ্দার ভাড়া দেখাচ্ছে ৩১ হাজার ৯০০ রুপি। একই দিনে কলকাতা থেকে (ইন্ডিগো ও এয়ার এরাবিয়া) জেদ্দার ভাড়া ৪২ হাজার রুপি। একই দিনে আসাম থেকে জেদ্দার ভাড়া (স্পাইস জেট ও এয়ার এরাবিয়া) ৩৮ হাজার ৪১২ রুপি। সেই সময়ে বিমানে ঢাকা থেকে জেদ্দার ভাড়া দেখাচ্ছে ৮৯ হাজার ৩৪৭ টাকা।
“প্রবাসে বাংলাদেশের যে এক কোটি কর্মী রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭৫ লাখই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিমান সবারই এগিয়ে আসা উচিত।“
টিকেটের চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে আটাব সভাপতি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিদিন নিয়মিত যাত্রীদেরই টিকিটের চাহিদা পাঁচ হাজার। সেখানে সবগুলো এয়ারলাইন্স মিলে সাড়ে তিন হাজার যাত্রী বহন করতে পারছে। এখন বাকি দেড় হাজার যাত্রী সঙ্কটে পড়ছেন।
“এর ওপর ওমরার যাত্রী রয়েছেন। এ আসন সঙ্কটকে পুঁজি করেই এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসা করে নিচ্ছে। এটার জন্য আমরা সরকারকে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছি।“
তার মতে, প্রত্যেকটা এয়ারলাইন্সের যথেষ্ট উড়োজাহাজ আছে। বিমান বাংলাদেশ, সৌদি এরাবিয়ান, এমিরেটস সবগুলোর যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। আমরা তাদের অনুরোধ করি এভাবে যাত্রীদের জিম্মি না করে বাড়তি ফ্লাইট দিয়ে সঙ্কটের সমাধান করা হোক। বেশি ফ্লাইট দিয়ে যাত্রী টানতে হবে।“
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল মাহমুদ বাবলু মনে করেন, এভাবে রীতিমতো জিম্মি করে প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা নেওয়া খুবই অনৈতিক। “আমরা মানছি কোভিড মহামারীর কারণে এভিয়েশন সেক্টর বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রবাসী শ্রমিকদের এভাবে জিম্মি করে টাকা নিয়ে যেতে পারে না এয়ারলাইন্সগুলো।“
মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের অনেক শ্রম-ঘামে উপার্জন করা অর্থ একটা সংকট সৃষ্টি করে বের করে নেওয়া মোটেও ‘নৈতিক ব্যবসা’ নয় বলে তার ভাষ্য। বাড়তি ফ্লাইট দিয়ে সঙ্কটের সমাধান করা উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।