আটকেপড়া প্রবাসী কর্মীরা দিশাহীন

রেস্তোরাঁর পেছন অংশের রান্নাঘরে খাবার তৈরি, অতিথিদের পরিবেশন, প্লেট-বাটি পরিষ্কার করে যে টাকা পাওয়া যায় তার সামান্য দিয়ে নিজে চলে বাকিটা দেশে পরিবারের কাছে পাঠান; সেই অর্থ দিয়ে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের জীবন চলে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2020, 05:02 PM
Updated : 15 Oct 2020, 05:02 PM

এভাবে জীবনের ‘ঘানি টেনে’ চলা প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের একটি বড় অংশের সামনে এখন সেই আয়ের সুযোগটুকুও হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা। ছুটিতে বা করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশে এসে আটকেপড়া এই প্রবাসী কর্মীরা আবার কবে ফিরতে পারবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আর কাটছে না।

বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ধর্না দিয়েও কোনো আশ্বাস ছাড়াই ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককে। ভিসা ও ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কী হবে, সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। 

এদেরই একজন মালয়েশিয়ায় একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক শাহ রাসেল আহমেদ মার্চে ছুটি নিয়ে দেশে আসার পর এপ্রিলে তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। মহামারীর মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ায় আর ফিরতে পারেননি তিনি। এখন বিভিন্ন দেশে বিমান চলাচল শুরু হওয়ায় তিনিও নিজের কর্মস্থলে ফিরে যেতে চান।

রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ভিসার মেয়াদ সেপ্টেম্বরে শেষ হয়েছিল। কর্মস্থলে ফিরে যেতে চাই বলে সেটা নবায়ন করে বাড়িয়েছি। তবে কবে কীভাবে ফিরে যাব সেই তথ্য কোথাও পাচ্ছি না। দূতাবাসে গেলে তারা কোনো তথ্য দেয় না, এমনকি তাদের কারও সঙ্গে দেখা করে কথাও বলা যায় না।”

আরেকজন শরীয়তপুরের খালেক মুন্সী প্রায় এক যুগ ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন,  সেখানকার একটি রেস্তোরাঁর পাচক তিনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত মার্চে দুই মাসের ছুটিতে দেশে আসার পর এখন আর ফিরতে পারছেন না। তার ভিসার মেয়াদ আছে আর এক মাস। এই ৬-৭ মাসে দেশে থেকে অনেক ধার দেনা হয়ে গেছে।

শরীয়তপুর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে বনানীতে মালয়েশিয়া দূতাবাসে এসে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে অনেকটা হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরে যান খালেক।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মালয়েশিয়া দূতাবাসে বার বার যোগাযোগ করলেও তারা কোনো কথাই বলছে না। আমাদের মানুষই মনে করছে না। আমার মতো প্রবাসীরা এখন তাই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। আমরা কবে ফিরে যেতে পারব, সেই তথ্যটা জানতে চাই।”

মহামারীর মধ্যে ইতালিতে প্রবাসীদের যাওয়া শুরু হওয়ার পর সেখানে পরীক্ষায় বেশ কয়েকজনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর বাংলাদেশিদের যাওয়া বন্ধ করে দেয় ইউরোপের দেশটি। পরে এক ঘোষণায় এ বছর আর বাংলাদেশিদের সেদেশে ঢুকতে দেবে না বলে জানানো হয়েছে।

এই ঘোষণায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন আটকেপড়া ইতালিপ্রবাসীরা। এরইমধ্যে দলবেঁধে ঢাকায় ইতালি দূতাবাসে গিয়ে ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

দ্রুত ইতালি ফিরে যাওয়ার সুযোগ চেয়ে গত রোববার ঢাকায় দেশটির দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেন মহামারীতে আটকেপড়া প্রবাসীরা।

১০ বছর ধরে ইতালি প্রবাসী মুন্সীগঞ্জের হৃদয় আহমেদ সেখানকার একটি রেস্তোরাঁর রাঁধুনী। সেখানকার আয়ের একটি বড় অংশ দেশে পাঠান হৃদয়, তাই দিয়ে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যরা চলেন। বছরের শুরুতে দেশে এসে মার্চে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও আর যেতে পারেননি।

তিনি সোমবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মহামারীর মধ্যে দুই মাসের ছুটিতে দেশে আসলেও এখন প্রায় ৯ মাসেও ইতালি ফিরে যেতে পারছি না। দ্রুত সেখানে ফিরে যেতে এরইমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইতালি দূতাবাসের সঙ্গে আমরা ইতালি প্রবাসীরা সাক্ষাৎ করেছি। আমরা চাই, আমাদের ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হোক এবং বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে ফ্লাইট চালু হোক ।”

হৃদয় বলেন, “এই পরিস্থিতির মধ্যে আমরা একদিকে যেমন অর্থকষ্টে আছি অন্যদিকে চরম উৎকন্ঠার মধ্যে আমাদের সময় পার করতে হচ্ছে। আমরা যেন দ্রুত ইতালি ফিরে যেতে পারি সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চাই।”

বাংলাদেশি যাদের ইতালিতে বসবাসের অনুমতিপত্র রয়েছে, তাদের উপর থেকে ফ্লাইটের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার কথা বৃহস্পতিবারই জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তবে অন্যদের পথ এখনও খোলেনি।

আর মালয়েশিয়া সরকার বলেছেন, মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি হলেই তারা পুনরায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে।

তবে এই উন্নতির মানদণ্ড কী, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি বিজ্ঞপ্তিতে; ফলে কবে নাগাদ আবার শ্রমিকরা যেতে পারবেন, তাও স্পষ্ট নয়।

এনিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এদিকে মহামারীর মধ্যে সৌদি আরব সরকার বিমান চলাচল পুনরায় শুরু করলেও বাংলাদেশ থেকে যাওয়ায় দেখা দেয় বিপত্তি।

সৌদি আরবের অনুমতি না মেলায় সেদেশে নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করতে পারছিল না বিমান। ফলে সৌদিতে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি বিমানের টিকেট কেটে রেখেও যেতে পারছিলেন না। অন্যদিকে ফ্লাইট কম থাকায় সৌদিয়া এয়ারলাইন্সও এত যাত্রীর চাপ নিতে পারছিল না।

এই পরিস্থিতিতে সৌদি প্রবাসী কর্মীরা বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স অফিসের সামনে টানা বিক্ষোভ শুরু করেন।

পরবর্তীতে আটকেপড়াদের ভিসার মেয়াদ এবং ২৪ দিনের জন্য ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা আসে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে।

শুধু এই তিন দেশ নয়, বিশ্বের নানা দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রবাসী কর্মীরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৯৮ জন প্রবাসীকর্মী দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন, নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৫২ হাজার ৫৬৫ জন।

এই সময়ে সৌদি আরব থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউট পাশে, অনেকে কাজ হারিয়ে ও ছুটিতে দেশে ফিরেছেন ৪৮ হাজার ৫৯৭ জন, কাতার থেকে ১৯ হাজার ৭৫৯ জন, কাজ নেই বলে মালদ্বীপ থেকে ফিরেছেন ১১ হাজার ৩৮৫ জন, ওমান থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউট পাশ নিয়ে ১২ হাজার ৫ জন, ইকামা বা ভিসার মেয়াদ না থাকায় বা অবৈধ হওয়ায় সাধারণ ক্ষমার আওতায় কুয়েত থেকে ১০ হাজার ৪৫৬ জন, কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সিঙ্গাপুর থেকে ৩ হাজার ৩১৫ জন, কাজ নেই বলে মালয়েশিয়ায় থেকে ৯ হাজার ৩৩২ জন, একই কারণে ইরাক থেকে ৮ হাজার ২৮২ জন এবং তুরস্ক থেকে ৭ হাজার ৭০৬ জন, লেবানন থেকে ৬ হাজার ৪৫১ জন  এবং কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষে জর্ডান থেকে ২ হাজার ১৯৭ জন কর্মী দেশে ফিরেছেন।

এছাড়া এই সময়ের মধ্যে বাহরাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, রাশিয়া, নেপাল, হংকং, জাপান, লন্ডন, লিবিয়াসহ বিশ্বের ২৮টি দেশ থেকে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন।

কুয়েত থেকে ফেরা এই ব্যক্তির মতো অনেকেই বিদেশের পাট গুটিয়ে দেশে ফিরেছেন। (ফাইল ছবি)

এই প্রবাসীকর্মীদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রবাসী কর্মীরা যেন ফিরে যেতে পারেন সেজন্য আমরা এরইমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। কিন্তু প্রবাসীকর্মীরা যেভাবে বিদেশে ফিরে যেতে আন্দোলন করছেন তাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। “কারণ কোনো দেশ যদি মনে করে এই সব কর্মীরা তাদের দেশে গিয়ে কাজ না পেলে আবারও আন্দোলন করতে পারেন তাহলে তারা তো তাদের কখনোই নিতে চাইবেন না।

“একটা সমস্যা যখন শুরু হয় তখন সবাই মিলে কাজ করতে হয়। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কোনো দেশে যখন কাজের পরিবেশ তৈরি হবে তখনই সেই দেশ অন্য দেশ থেকে কর্মী নেবে। সেই সঠিক সময়টার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। অযোক্তিক কোনো দাবিতে আন্দোলন করলে তার ফলাফলটা বরং খারাপই হবে।”

প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, “করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আটকেপড়া প্রবাসীরা ফিরে যেতে চাইবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। তারা যেন ফিরে যেতে পারেন সেজন্য সরকার বলছেন, তারা কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন। সেটা আরও বাড়ানো যেতে পারে।”

তার মতে, প্রবাসী কর্মীদের ফিরে যাওয়া প্রধানত নির্ভর করবে তাদের নিয়োগকর্তার উপর।

“কর্মী ও নিয়োগকর্তার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সুন্দর হলে এবং নিয়োগকর্তার অবস্থান থেকেও উদ্যোগ দেখা দিলে প্রবাসীকর্মীদের ফিরে যাওয়াটা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।” 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে আসা কর্মীদের অনেকেই কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সময়মতো গন্তব্য দেশের কর্মস্থলে ফেরত যেতে পারেননি। ইতোমধ্যে অনেক কর্মীর ভিসা/ইকামা/ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদেশ প্রত্যাগমনেচ্ছু কর্মীদের ভিসা/ইকামার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ভবিষ্যতে এই সব বিষয়ে কার্যকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টাসহ বিদেশফেরত ও আটকেপড়া কর্মীদের সহযোগিতার লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই ধরনের সব কর্মীর নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে।