২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের (অদক্ষ কর্মী) নেওয়া বন্ধ রেখেছে মালদ্বীপ। এরপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই এখানে চাকরি-ব্যবসা করে, গায়ে খেটে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন বাংলাদেশিরা; নানা বঞ্চনা সয়েই।
শিগগিরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরের কথা রয়েছে। সেই সফরে শ্রমিকদের সমস্যাগুলোর সমাধান আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মালদ্বীপে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ভাষ্য, অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় এখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া হয়। অনিয়মিত কর্মীদের পাশাপাশি নিয়মিত কর্মীরাও বঞ্চনার শিকার হন।
তারা চান শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দর-কষাকষি করা হয়।
শ্রমিকেরা বলছেন, কোম্পানিগুলো চায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসতে। কিন্তু মালদ্বীপ সরকারের নীতির কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনতে পারছে না।
ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার এডমিরাল নাজমুল হাসান বলছেন, বাংলাদেশিদের ছাড়া মালদ্বীপের ‘চলবে না’।
ঢাকা থেকে আসা সংবাদকর্মীদের সঙ্গে শনিবার এক মতবিনিময়ে তিনি সমস্যা সমাধানে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন।
নিষেধাজ্ঞা, মুদ্রা নিয়ে সমস্যা
একটি ক্লিনিং কোম্পানির পরিচালক মালদ্বীপের নাগরিক রাশিদ আহমেদ, তার কোম্পানিতে ২৩ জন বাংলাদেশি কাজ করতেন। কোভিড মহামারীর কারণে তাদের অনেককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এখন আবার বাজার চাঙা হওয়ায় পুরনো কর্মীদেরও ফিরিয়ে আনছেন রাশিদ। নতুন বাংলাদেশি কর্মীও নিতে চান। কিন্তু সরকারের নীতির কারণে বাংলাদেশিদের আনতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
শিক্ষক হিসেবে ১৯৮৪ সালে মালদ্বীপে এসেছিলেন ঢাকার মীর সাইফুল ইসলাম। মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি।
সাইফুল মনে করেন, বাংলাদেশিদের ছাড়া মালদ্বীপের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। পরিশ্রমী, দায়িত্ববোধ সম্পন্ন এবং কম মজুরির কারণে এখানে বাংলাদেশিদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
তবে মুদ্রার মূল্যমানের কারণে এক ধরনের সমস্যার কথা জানান তিনি।
সাইফুল বলেন, এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে কর্মীদের বেতন ধরা হয় ডলারে। কিন্তু পরিশোধের সময় দেওয়া হয় স্থানীয় মুদ্রায় (রুপিয়া)। এখানে একটা বড় ফাঁকি রয়েছে। সরকারিভাবে ১ ডলারে ১৫ রুপিয়া। কোম্পানিগুলো সরকারি দরেই রুপিয়া দিয়ে কর্মীদের বেতন পরিশোধ করে। দেশে পাঠানোর জন্য তাদের আবার ডলার কিনতে হয়। কিন্তু কেনার সময় ১৯ রুপিয়া দিয়ে এক ডলার কিনতে হয়। এতে প্রতি ডলারে তিন থেকে চার রুপিয়া বঞ্চিত হন বাংলাদেশি কর্মীরা।
টাকায় হিসেব করলে প্রতি ডলারে কর্মীরা বঞ্চিত হন ১৬ থেকে ২০ টাকা। বছর শেষে এই বঞ্চনার অঙ্কটা বিশাল আকারে দাঁড়িয়ে যায় বলে জানান সাইফুল।
তিনি বলেন, “আমাদের এখানে বাংলাদেশি ব্যাংক দরকার। যাতে শ্রমিকেরা সরাসরি ব্যাংকে বেতন পেতে পারেন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে পারেন।”
অপরাধে বাংলাদেশিরা
বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, সার্করাষ্ট্র মালদ্বীপের কারাগারে মোট ৭০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। বন্দি শিবিরে (ডিটেনশন সেন্টারে)রয়েছেন আরও ৩০ জন। এদের বেশিরভাগই মাদক অপরাধে যুক্ত ছিলেন। মাদকসহ বিমানবন্দরে ধরা পড়েছেন কেউ কেউ। এছাড়া শিশু নিপীড়নের অভিযোগে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন।
রাষ্ট্রদূত নাজমুল বলেন, “ডিটেনশন সেন্টারে থাকা ব্যক্তিদের দেশে ফেরত পাঠাবে মালদ্বীপ। বাকিদের এই দেশীয় আইনে সাজা পেতে হতে পারে। এ বিষয়ে দূতাবাস নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।”
প্রবাসীদের অভিযোগ ও দূতাবাসের সীমাবদ্ধতা
দূতাবাসের সহায়তা না পাওয়ার বিষয়ে অন্য আরও কয়েকটি দেশের মতো মালদ্বীপের প্রবাসী শ্রমিকদেরও নানা অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত নাজমুল বলেন, “আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে আমাদের সাধারণ জনগণের অভিযোগ থাকবে, এটা মেনে নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়।
“কারণ আমাদের হাতে বেশি সমস্যা ও চাহিদা থাকে, বাংলাদেশ হাই কমিশনের মতো ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এক লক্ষ লোকের সবাইকে খুশি করা সম্ভব না।”
তিনি বলেন, “একজন অনিয়মিত কর্মী যখন মালিকের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে দূতাবাসে আসেন তখন তিনি কেবল তার মালিকের নম্বরটি দিতে পারেন। ওই নম্বরে ফোন করলে মালিক প্রথমেই বলেন, ওই লোকটা তার কর্মী নন। কারণ তাদের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তাই তিনি অস্বীকার করার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে অনুরোধ করা ছাড়া দূতাবাসের আর কিছু করার থাকে না।
“আবার অনেক প্রবাসী ভাবেন দূতাবাসে এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা তাদের বারবার বোঝাতে ব্যর্থ হই যে দূতাবাস এদেশের সরকার নয়।”
ব্যাংক নিয়ে নাজমুল হাসান বলেন, দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলা ও দেশীয় বিমান চলাচলের বিষয়ে তারা কাজ করছেন। আশা করা যাচ্ছে তা হবে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট চালুর পর বিমানের ফ্লাইটও মালদ্বীপের সঙ্গে চালু হবে বলে তিনি আশাবাদী।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে আশা
রাষ্ট্রদূত নাজমুল বলেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক নেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করেছিল মালদ্বীপ সরকার। তবে সময়সীমা পার হলেও এখনও বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হচ্ছে না।
তবে চিকিৎসক, নার্সসহ কারিগরি দিক থেকে দক্ষ কিছু জনশক্তি মালদ্বীপে গেছে।
নতুন শ্রমিক আনা ও অনিয়মিত কর্মীদের নিয়মিত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে আলোচনা হবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সফরে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করছি, তার মধ্যে প্রথমত হল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন। দ্বিতীয়টা অবশ্যই মালদ্বীপে যেসব বাংলাদেশি অনিয়মিত হিসেবে রয়েছেন তাদের নিয়মিতকরণ।
“বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ কর্মী আনার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করবেন বলেও আশা করছি। নতুন শ্রমিক আনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও অনিয়মিত শ্রমিকদের নিয়মিতকরণের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সরাসরি এদেশের রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন, তখন তারা নিশ্চয়ই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।”
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।
মালদ্বীপে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশির থাকার তথ্য দিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, দেশটিতে কর্মরত মোট প্রবাসী কর্মীর ৭০ ভাগই বাংলাদেশি।
তবে বাংলাদেশিদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অনিয়মিত কর্মী হিসেবে রয়েছেন।
নাজমুল হাসান বলেন, “নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে মালদ্বীপকে প্রবাসী শ্রমিক নিতে হবে। এখানকার নির্মাণ শিল্পের চাহিদা অন্য কোনো দেশের শ্রমিকরা মেটাতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষেরা কাজের প্রতি আন্তরিক, পরিশ্রমী এবং তারা স্বল্প বেতনে কাজ করতে রাজি আছেন। এটা অন্য কোন দেশ থেকে তারা পাবে না।”
মহামারীর কারণে মালদ্বীপে নির্মাণ শিল্প গত দেড় বছর ধরে স্থবির হয়ে রয়েছে।
“নির্মাণশিল্পটা যখন আবার চাঙা হয়ে উঠবে, তখন তাদের বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনতেই হবে। এছাড়া তাদের হাতে অন্য উপায় নেই,” বলেন রাষ্ট্রদূত নাজমুল।