ঋণ কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে চাপের মুখে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের তিন সপ্তাহের মাথায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমকে অপসারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
Published : 19 Dec 2017, 11:42 AM
গভর্নর ফজলে কবিরের এই নির্দেশ মঙ্গলবার সকালে ফারমার্স ব্যাংকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জানিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে আমানতকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ফারমার্স ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করা হয়েছে।”
এ কে এম শামীমকে কেন ওই পদ থেকে অপসারণ করা হবে না- তা জানতে চেয়ে গত ২৬ নভেম্বর নোটিস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাত দিনের মধ্যে ওই নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
সেই নোটিসে দুটি অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় এমডি ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে নগদ জমা বা সিআরআরের এবং সংবিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের অর্থ রাখতে পারেননি তিনি। তার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করে গেছে।
এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নোটিসের পরদিনই ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের পদত্যাগের খবর আসে। ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও পদত্যাগ করেন।
তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ওইদিনই মোহাম্মদ মাসুদকে নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়।
সেইসঙ্গে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠনের কথাও জানানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নিয়মের বেশি ঋণ দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এসব ঋণ এখন আদায়ও হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে খুব বেশি সাড়া পাচ্ছে না ব্যাংকটি। উল্টো আমানত তুলে নেওয়ার চাপ বাড়ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে চার বছর আগে যাত্রা শুরু করা এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
মার্চ-জুন সময়ে ব্যাংকটি খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে মাত্র সাত কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ১৩৪ কোটি টাকা।
তারল্য সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা আমানত চেয়ে চিঠি দিয়ে কোনো সাড়া পায়নি ব্যাংকটি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রেপোর মাধ্যমে ৯৬ কোটি টাকার জোগান দিয়েছে ব্যাংকটিকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক অনুমোদন পায়। তখন মোট আটটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, যা রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বীকার করেছিলেন।
দেশের ‘চাহিদার চেয়ে বেশি’ ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ায় সরকারকে সে সময় সমালোচনায় পড়তে হয়েছিল। যাত্রা শুরুর তিন বছর না যেতেই ফারমার্স ব্যাংকে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়লে সেই সমালোচনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
অনিয়ম ধরা পড়ায় বেসরকারি এই ব্যাংককে কড়া নজরদারিতে আনতে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; যদিও পরে তা আদালতে আটকে যায়।
গত অক্টোবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংককে দেশের আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সেখানে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংক সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে অর্থ নিয়ে চলছে। দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই ব্যাংকটির। ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ফারমার্স ব্যাংকের নতুন ঋণ দেওয়ার বিষয়টিও প্রকাশ পায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সেই অনুসন্ধানে।
অনিয়ম ও দুর্নীতির দশ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় গত ৬ ডিসেম্বর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমানকেও অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
ফারমার্স ব্যাংকের মতই ধুকতে থাকা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও সম্প্রতি ঢেলে সাজানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফরাসত আলী; নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন তমাল এস এম পারভেজ।
এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণের আদেশ হাই কোর্ট স্থগিত করে দিলেও তাকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিএমডি কাজী মো. তালহাকে।