জ্বালানি সংকটে কারখানা বন্ধের শঙ্কায় বিটিএমএ

সংকট আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে জানিয়ে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমরা মিলগুলো কতদিন চালু রাখতে পারব বা এর কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কতদিন সামাল দিতে পারব জানিনা।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2023, 12:05 PM
Updated : 30 May 2023, 12:05 PM

টানা কয়েক মাস ধরে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো বন্ধ হতে চলেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ।

মঙ্গলবার ঢাকার পান্থপথে বিটিএমএ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, দেশের মিলগুলো গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সক্ষমতার অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারছেনা; ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে দেশীয় তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরাও এখন দেশীয় সুতা না কিনে সুলভ মূল্যের জন্য বিদেশ থেকে সুতা আমদানি করে পণ্য রপ্তানি করছে। এদিকে টেক্সটাইল মিলগুলোর সুতার স্তুপ জমছে।

সংকট আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে জানিয়ে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমরা মিলগুলো কতদিন চালু রাখতে পারব বা এর কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কতদিন সামাল দিতে পারব জানিনা।”

সংকটের বড় কারণ গ্যাস না পাওয়া

বিটিএমএ সভাপতি খোকন বলেন, সর্বশেষ শিল্প ও ক্যাপটিভ গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের দাম এক লাফে ৮৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা করা হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার জন্য এলএনজি আমদানির বাড়তি খরচ মেটাতে এই মূল্য বৃদ্ধি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ট্যারিফ বৃদ্ধির আগে এবং পরে গ্যাস সরবরাহ অবস্থা শোচনীয়ই রয়ে গেছে। বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

“গ্যাস ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে স্পিনিং মিলগুলোর সুতার উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একই সঙ্গে গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। উৎপাদন ক্ষমতার সম্পূর্ণ ক্যাপাসিটি ব্যবহার করতে না পারায় সুতার উৎপাদন খরচ আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে।”

২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাস ট্যারিফ ৬১৭ শতাংশ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের অগাস্টে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ১৮ পয়সায় এবং শিল্প সংযোগের জন্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৮৬ পয়সায় গ্যাস দেওয়া হতো। এখন তা বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে।

দেশে সুতার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ায় মিলগুলোর সুতা বিক্রি বন্ধের উপক্রম হয়েছে বলে জানান তিনি।

“২০২২ সালের জানুয়ারিতে যে সুতার (৩০ কাউন্ট) মূল্য প্রতিকেজি ৪ দশমিক ৯ ডলার ছিল গত এপ্রিলে তা কমে প্রতি কেজি ৩ দশমিক ১০ ডলার হয়েছে। মিলগুলো শুধু তাদের উৎপাদন অব্যাহত, শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতাদি পরিশোধসহ ইউটিলিটি বিল নিয়মিত দেওয়ার জন্য উৎপাদন খরচের চেয়েও ১৮ থেকে ২০ শতাংশ কম মূল্যে সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সৃষ্ট প্রোডাকশন লস, গ্যাস ব্যবহার না করে অতিরিক্ত গ্যাস বিল ও অতিরিক্ত নিরাপত্তা জামানত প্রদানের কারণে স্পিনিং মিলগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গত ১৫ মাসে (জানুয়ারি ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩ ) প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

ইডিএফ ফান্ড নিয়ে সংকট

বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ ফান্ড থেকে পর্যন্ত বরাদ্দ না পাওয়া এই খাতের সংকটের আরেকটি কারণ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

খোকন বলেন, “ইডিএফ রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল স্পিনিং মিলগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু গত এক বছর ধরে এ তহবিলটি থেকে সংশ্লিষ্ট মিলের অনুকূলে ঋণ বরাদ্দ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। পর্যায়ক্রমে এ তহবিলটির আকার প্রতিটি স্পিনিং মিলের ক্ষেত্রে ৩০ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। ঋণের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় মিলগুলো পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ কাঁচামাল তথা তুলা আমদানির প্রয়োজন হয়, তা করতে পারছেনা। মিলগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ক্ষমতার বাইরে থেকে যাচ্ছে, যা উৎপাদন খরচকে বৃদ্ধি করছে।

“সুতা, কাপড় ও ড্রেস-ম্যাটেরিয়েলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে স্থানীয় সুতার মজুদ বৃদ্ধি পেয়ে মিলগুলোর আর্থিক অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক। ইতোমধ্যে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কয়েকটি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আরো মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী ঈদুল আজহার সময় মিলগুলো শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, মজুরি বোনাস পরিশোধ এবং একই সাথে প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি বিল প্রদান করতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমরা শংকিত,” বলেন তিনি।

সংকট মোকাবেলায় বিটিএমএর পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এগুলো হল-

>> বর্তমান সংকট বিবেচনায় নিয়ে ও বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বিটিএমএর রপ্তানিমুখী স্পিনিং মিলে তৈরি সুতার ন্যূনতম একটি অংশ ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে সংগ্রহের বিধান।

>> ইডিএফ সুবিধা অব্যাহত রাখাসহ কাঁচামাল আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা।

>> নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফের উপর অতিরিক্ত নিরাপত্তা জামানত আদায় থেকে বিরত থাকাসহ গ্যাসের মূল্য সমন্বয়।

>> ব্যাংক ঋণের কিস্তি ও সুদ অন্তবর্তীকালীন সময় তথা আগামী জুন, ২০২৪ পর্যন্ত ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখার সুযোগ।