“পরশু একটা ফোন আসছে; আমাকে দেখা করতে বলে। যখন বললাম, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অনেককেই চিনি, তখন বলে জি স্যার, জি স্যার।”
Published : 13 Mar 2025, 08:06 PM
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সেখানকার কোনো কোনো কর্মী তাদের চেয়ারম্যানের চেয়েও ‘শক্তিশালী’ বলে মন্তব্য করেছেন এক ব্যবসায়ী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, সেখানেই এমন মন্তব্য আসে।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সভাপতি শাহদাত হোসেন সোহেল এনবিআর চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, “ব্যবসায়ীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আপনি দুর্নীতি বন্ধ করুন; ব্যবসায়ীরা আপনাদের সব কিছু দেবে।”
তার ভাষ্য, “যাদের বন্ড নাই, তাদের এক্সপোর্ট যখন যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছু হয়। আমার কাছে প্রত্যেকটা জিনিস আছে। ভয়েস মেসেজসহ আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। এখনও বন্ধ হয় নাই।
“আপনার কাছে আবারও অনুরোধ করব, আপনার এআরও (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা); ওনারা অনেক শক্তিশালী। আপনার মেম্বার (এনবিআর সদস্য) সাহেব; আপনার থেকেও শক্তিশালী।”
সাম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরে এ ব্যবসায়ী বলেন, “পরশু একটা ফোন আসছে। আমাকে দেখা করতে বলল। আমি যখন বললাম, আমি এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অনেককেই চিনি, তখন বলে জি স্যার, জি স্যার- দিস ইজ দ্য সিনারিও।”
এসব অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “আপনাদের অভিযোগ জানাতে হবে।
“আপনি না দিলে সে নেবে কোথা থেকে। আপনি দেন, সেটা আমাদের কাছে এসে বলেন। প্রমাণ দেন; দুদক ধরতে পারে; এনবিআরও ধরতে পারে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “ট্রানজেকশন এখন ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করে ফেলা যায়। কথোপকথন রেকর্ড করে ফেলা যায়। শত শত কোটি টাকা খরচ করে অনলাইনে অভিযোগ জানানোর সিস্টেম চালু করেছি। এটা আপনাদের ব্যবহার করতে হবে।”
অনিয়মের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কে এম ইকবাল বলেন, “কদিন আগে পানগাঁওয়ে দুটি কনটেইনার আটকানো হল আমান প্লাস্টিকের। দুইটার ডিউটি ৭ কোটি টাকা দাবি করা হয়।
“ওই ছেলেটা এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমি ওকে ফিরিয়ে আনছি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই কনটেইনার ছেলেটি কোটি টাকা দিয়ে ছাড়িয়েছে।”
ব্যবসায়ী সংগঠনের চাওয়া কী?
বিটিটিএলএমইএ উৎসে কর্তনের হার হ্রাস করা, নগদ প্রণোদনা থেকে উৎসে কর কর্তনের হার কমানো ও ১০ কাউন্ট ও ২০ কাউন্ট সুতায় শুল্ক ও কর কমানোর প্রস্তাব দেয়।
রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের নীতি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)।
সংগঠনটি আগামী ৫ বছরের জন্য উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা, ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করা, কোম্পানির ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী আমানত, স্থায়ী আমানত ইত্যাদির সুদ/মুনাফার উপর উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবও দিয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তিখাতে কর অব্যাহতি ২০৩১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার দাবি জানায় বেসিস।
এছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠার আগে ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের শর্ত শিথিল করা, দেশি সফটওয়্যার ও তথ্য প্রযুক্তির ভ্যাট প্রত্যাহার, সফটওয়্যার রপ্তানিতে প্রণোদনা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয় সংগঠনটি।
প্লাস্টিকে খেলনা প্রস্তুতে ২৪ ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে করছাড় চায় বিপিজিএমইএ।
আমদানি করা ১৪টি কাঁচামালের করছাড় চায় বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি।
রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আরোপযোগ্য শুল্ক ও করের বিপরীতে শতভাগ ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বন্ড সুবিধার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফার্নিচার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এলপিজি অটোগ্যাস সেক্টরে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা চায় বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এলপিজি কনভারশন কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধাও চায় তারা। ভোক্তা পর্যায়ে অটোগ্যাসের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সংযোজিত মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাবও দিয়েছে সংগঠনটি।
বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি নগদ সহায়তায় ১০ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)।
বাংলাদেশ বিস্কুট, ব্রেড ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি কেক, বিস্কুট ও কনফেকশনারি পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি চেয়েছে।
হীরা আমদানির মূসকে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া ও স্বর্ণের গহনার ক্ষেত্রে তিন বছরের জন্য মূসকে ৫০ শতাংশ ভর্তুকির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
আর বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে এআইটি ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে।
২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৫ শতাংশ হারে আয়কর দেওয়ার দাবি জানায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন, যা নিয়ে তাদের সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যানের বাহাস হয়।
সংগঠনটির পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, “ভারতীয় সুতার প্রভাবে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাত থেকে আট কোটি টাকার সুতা অবিক্রিত রয়েছে। আমরা মুনাফা করতে পারছি না।”
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “করপোরেট কর যেটা নেওয়া হয়, সেটা আয়ের ওপর পারসেন্টেজ। গত পাঁচ-সাত বছরে করপোরেট কর অনেক কমিয়েছি। কমাতে কমাতে ২৫ শতাংশে এনেছি। ১০০ টাকা লাভ হলে ২৫ টাকা সরকারকে দেবেন।
“আপনাদের লাভ হয় না বলছেন। তাহলে সরকারকে টাকা দেওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে আপনার রিডিউস রেট যেটা আছে, ১৫ শতাংশ, সেটা আপনাদের কেন দরকার। আমাকে বোঝান।”
ভারতীয় সুতা এত কম দামে কীভাবে আসে, সেই প্রশ্ন তুলে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আপনার ১৫ শতাংশ কেন হবে। এটার কোনো লজিক দেখি না। এটাতে আপনাদের বদনাম হচ্ছে। বলা হচ্ছে টেক্সটাইল সেক্টরে করহার কম। আপনারা রেগুলার রেটে চলে আসেন। ট্যাক্স হলে দেবেন, না হলে দেবেন না।”
মোশাররফ হোসেন বলেন, “আপনাকে আমরা ঠিক মত বোঝাতে পারিনি। আমরা আপনার সঙ্গে পরে একদিন আধা ঘণ্টা বসতে চাই। আপনাকে আজ বোঝাতে সক্ষম হইনি।”
তখন এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “গত কয়েক মাসে আমরা অনেক কর অব্যাহতি বাতিল করেছি। সে সব অব্যাহতি এ বছরের জুনে শেষ হবে, একটাও আর নতুন করে বাড়বে না। সবচেয়ে বেশি আপনাদের কথা শুনেছি। আপনারা বোঝাতে পারছেন না কেন। আরও বোঝান। দরকার হলে আজ সারাদিন শুনব। আমরা কেউ বুঝব না, এটা তো হয় না।”