২০২৩ থেকেই থ্রিজি বিদায়ের শুরু: মন্ত্রী

সরকার টুজি নেটওয়ার্ক আরও কয়েক বছর রাখতে চায়। তবে আগামী বছরের শুরু থেকেই ফোর জি নেটওয়ার্কে মনোযোগ বাড়াতে চায় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2022, 04:42 PM
Updated : 6 Nov 2022, 04:42 PM

সরকার এখন চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে জোর দিচ্ছে জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, আগামী বছরের শুরু থেকে থ্রিজি ডিভাইসের আমদানি ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

রোববার রাজধানীর রমনায় বিটিআরসি কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে নির্দেশনা পেয়েছি, সেটি হচ্ছে আমরা টুজি নেটওয়ার্কে আরও কয়েক বছর থাকব। এই মুহূর্তে টুজি বাদ দেওয়ার মত অবস্থা নাই। আগামী বছরের প্রথম দিন থেকে থ্রিজি নেটওয়ার্কে আমরা থাকব না।”

দেশের ৯৮ শতাংশ অঞ্চল এরইমধ্যে ফোর জি নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, থ্রিজিতে থাকার দরকার আর বাংলাদেশের নেই।

“থ্রিজি ডিভাইসগুলো আমদানি এবং উৎপাদন দুইটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের গুরুত্ব থাকবে ফোরজির ওপর। আমরা বর্তমানে ফাইভ জি নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে পেরেছি, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক।”

মোবাইল ফান অপারেটরদের সেবার মান পরিমাপের জন্য ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস বেঞ্চমার্কিং সিস্টেম’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন মোস্তাফা জব্বার।   

তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে কোনো অপারেটরেরই গ্রাহকসেবা সন্তোষজনক না। প্রতিনিয়ত গ্রাহকের কাছ থেকে নানান ধরনের অভিযোগ আসে। গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ফোনে কথা বলবে, কলড্রপ সহ্য করার মত গ্রাহক বর্তমানে আর নেই।”

Also Read: ফোর জি যুগে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রথম চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। এর দুই দশক পর ২০১৪ সালে মোবাইল সেবার থ্রিজি প্রযুক্তি বাংলাদেশে চালু হয়। এরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ফোরজি যুগে প্রবেশ করে। 

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ বলছে, মোবাইল অপারেটররা দিন দিন কেবল গ্রাহক বাড়ানোর দিকেই নজর দিচ্ছে, অথচ তাদের উচিত বর্তমান গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া।

দেশে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সেবার মান যে ‘সেই অর্থে বাড়েনি’, তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমদিকে মোবাইল ফোন চালু করা হয়েছিল কিছু সংখ্যক লোকের জন্য; তারপর সেটা হয়ে গেল শহরকেন্দ্রিক, এরপর মোবাইল পৌঁছালো গ্রামে গ্রামে, এখন প্রত্যেকটি বাড়িতেই মোবাইল এবং ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে।

“গ্রামের একজন গরিব চাষিও বিদেশে থাকা তার ছেলেকে নিজের বাড়িটা দেখাতে চায়, ভিডিওকলে নিজেরা নিজেদের দেখতে পায়। এখানে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তারা কেন সহ্য করবে?”

গ্রাহক বৃদ্ধি সাময়িক ব্যবসার হাতিয়ার হলেও দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই ব্যবসার জন্য গ্রাহক সন্তুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মোস্তাফা জব্বার।

তিনি বলেন, “পরিবর্তিত প্রযুক্তির এই যুগে সেবার মানের দিকে নজর না দিলে গ্রাহক ধরে রাখা কঠিন হবে। এমএনপি চালু হওয়ায় নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলানোর সুযোগ রয়েছে।”

২০১৮ সালে তরঙ্গ নিলাম হলেও ২০২২ সালেও সেই তরঙ্গ পুরোপুরি ‘রোল আউট’ করতে পারেনি মোবাইল অপারেটররা। ২০২২ সালের মধ্যে সে তরঙ্গ চালু করার জন্য অপারেটরদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

বিটিআরসি গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা উন্নয়নশীল দেশের জন্য ‘মাইলফলক’ দাবি করে তিনি বলেন, এখন মোবাইল ডেটার দাম নির্ধারণ করে দিতে পারলে গ্রাহক উপকৃত হবে।

গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা

দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার একটি কারণ এদিন পাওয়া গেল মন্ত্রী ও কমিশনের কর্মকর্তাদের কথায়।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “সেবার মান নিশ্চিত না করা পর্যন্ত গ্রামীনফোন নতুন কোনো সিম বিক্রি করতে পারবে না। তারা পুরান সিম বিক্রির সুযোগে নতুন গ্রাহক তৈরি করছিলেন। সেবার মান বাড়াতে না পারলে নতুন গ্রাহক তৈরির দরকার নেই।”

বিটিআরসির হিসাবে গ্রাহকের হাতে থাকা ১৮ কোটির বেশি সক্রিয় সিমের ৪৫ শতাংশই গ্রামীণ ফোনের। ভয়েস কল ও ইন্টারনেট সংযোগে গ্রাহকদের ‘মানসম্মত সেবা দিতে না পারার’ কারণ দেখিয়ে গত জুনে গ্রামীণফোনের নতুন সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বিটিআরসি।

গত সেপ্টেম্বরে তাদের পুরোনো সিম বিক্রির অনুমতি দেওয়া হলেও তা তুলে নেওয়ার কথা জানা গেল এ অনুষ্ঠানে।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বললেন, সিম রিসাইক্লিংয়ের (পুরনো সিমি বিক্রির) অনুমতি দেওয়া হয়েছিল গ্রামীণফোনকে। কিন্তু ‘তাদের সেবার ত্রুটির কারণে’ ৩৪ লাখ গ্রাহক কমে গেছে।

“যেহেতু সেবার মান বাড়াতে পারেনি, তাই মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামীণফোনের সব ধরণের সিম বিক্রি বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করার কোনো কারণ নেই।”

এ বিষয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “সিম বিক্রির ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতির ব্যাপারে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে বিশেষ কারণে গ্রামীণফোনের সিমের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

“বিশেষ কারণটাও অজানা নয়। পদ্মাসেতু যেদিন উদ্বোধন হয়, সেদিন সেখানে নেটওয়ার্ক ভালো ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এই অভিযোগ করেছেন। যে কারণে মাননীয় মন্ত্রীপরিষদ সচিব আমাদের মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে ফোন করেছিলেন। এটা নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।”

এর বাইরেও গ্রাহকদের কাছ থেকে ‘প্রচুর কল ড্রপের’ অভিযোগ আসে জানিয়ে জব্বার বলেন, “এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে গ্রামীণফোনের নতুন সিম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

কিউওএস বেঞ্চমার্কিং সিস্টেম

বিটিআরসি জানিয়েছে, কিউওএস বেঞ্চমার্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে সারাদেশে গ্রাহকসেবার মানের উন্নতির ক্ষেত্রে আরও বেশি সক্ষমতা অর্জন করবে কমিশন। এ সিস্টেমের মাধ্যমে সব মোবাইল অপারেটরের ভয়েস, থ্রিজি, ফোরজি সেবা, ওটিটি সেবা, নেটওয়ার্ক কভারেজের মত বিষয়ে পরিবীক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদারের সভাপতিত্বে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ সিস্টেমের উদ্বোধন করেন।

অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব খলিলুর রহমান টেলিকম খাতে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কলড্রপ হ্রাস এবং ডেটা স্পিড বৃদ্ধিসহ সেবার মান বাড়াতে অপারেটরদের প্রতি আহ্বান জানান।

কিউওএস বেঞ্চমার্কিং সিস্টেম সর্ম্পকে উপস্থাপনা করেন বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের মহাপরিচালক এহসানুল কবীর।

তিনি বলেন, বিটিআরসিতে স্থাপিত একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সেবার মান পরিমাপের চারটি ইউনিট সার্বক্ষণিক সংযুক্ত থাকবে এবং স্মার্ট-মনিটর নামের এ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ড্রাইভ-টেস্ট কার্যক্রমে ব্যবহৃত সব ইউনিটের রিমোট মনিটরিং, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

চারটি ইউনিটের পরিবীক্ষণের লগ ফাইল সহজেই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় গ্রহণ করে পোস্ট-প্রসেসিং অর্থাৎ ড্রাইভ টেস্টের ফলাফল দ্রুত সময়ে পাওয়া যাবে।

>> একসঙ্গে চার জায়গায় সেবার মান পরিবীক্ষণ করা যাবে।

>> একসঙ্গে সব মোবাইল অপারেটরের বিভিন্ন প্রযুক্তির ভয়েস, থ্রিজি ডাটা, ফোরজি ডাটা, ওটিটি সেবাসমূহ, নেটওয়ার্ক কাভারেজ পরিবীক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

>> সিস্টেমটি ফাইভ জি প্রযুক্তির সেবার মান যাচাই করতে পারবে।

>> কেন্দ্রীয়ভাবে সব যন্ত্রপাতি এবং পরিবীক্ষণ কার্যক্রম লাইভ টাইম পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

শিগগিরই টেলিকম মনিটরিং সিস্টেম চালু হতে যাচ্ছে জানিয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, “এটি বাস্তবায়িত হলে বিটিআরসি থেকে দেশের সকল এলাকার মোবাইল সেবার মান নজরদারি করা যাবে এবং অপারেটরদের থেকে রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা আসবে।”

তিনি বলেন, “ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর ) কার্যকর হওয়ায় বাজারে অনিবন্ধিত হ্যান্ডসেট থাকবে না।”

টাওয়ার রেডিয়েশন নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার হয় উল্লেখ করে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “বিটিআরসির রেডিয়েশন পরিমাপে পরিবেশ ও মানব দেহের ক্ষতিকর জন্য কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।”

অন্যদের মধ্যে কমিশনের লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের কমিশনার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন, স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার শেখ রিয়াজ আহমেদ, প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসাইন, সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক নাসিম পারভেজ স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক মনিরুজ্জামান জুয়েল, লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু, সচিব (বিটিআরসি) নুরুল হাফিজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।