সিত্রাং বাড়াল সবজির দর; আটা চিনি পেঁয়াজ ফের ঊর্ধ্বমুখী

এখন খাবার খরচকে বাধ্য হয়ে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রয়োজনীয় অনেক কেনাকাটা আগের মত করা সম্ভব হচ্ছে না, আক্ষেপ এক ক্রেতার।

তাবারুল হকনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2022, 03:13 PM
Updated : 28 Oct 2022, 03:13 PM

নিত্যপণ্যের চড়া বাজারে নতুন করে বেড়েছে আটা, ময়দা, আলু, পেঁয়াজ ও চিনির মূল্য। একইসঙ্গে মুরগি ও ডিমের পাশাপাশি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজিও।

শুক্রবার রাজধানীর শান্তিনগর, মালিবাগ, রামপুরা, মগবাজার, উত্তর বাড্ডা, মহাখালী কাঁচাবাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ভোক্তাদের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। চড়া বাজারে গিয়ে সদাই কিনতে অনেককেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাহিদানুযায়ী সবকিছু কিনতে টাকায় কূলোচ্ছে না।

আর দোকানিরা বলছেন, প্রায় সব জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় সীমিত আয়ের বহু মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে অল্পস্বল্প পরিমাণ সদাই কিনে ফিরছেন। তাদের অনেকেই নিত্যপণ্যের বহু জিনিস কিনতে পারছেন না।

আবার দোকান থেকে বাকি কিনে এক-দুই দিনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা বলে কেউ কেউ পরে সেই দোকান এড়িয়ে চলছেন বলেও জানিয়েছেন কোনো কোনো দোকানি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা আটা কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেড়ে ৬০ থেকে ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, প্যাকেট আটার দাম এখন ৬৪ টাকা। ময়দা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা।

বাজারে ঘাটতি ও অভিযান নিয়ে আলোচনার মধ্যে আরেক দফা বেড়েছে চিনির দাম। কয়েক দিনের মধ্যে বাজারভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে কেজিপ্রতি দর ১১০ থেকে ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

এছাড়া আলু কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৫৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে।

তবে আগের মতই ডিম কিনতে চড়া দাম গুনতে হচ্ছে। প্রতি ডজন দোকান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।

আর ব্রয়লার মুরগির দর আগের সপ্তাহের মতই ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা কেজি রয়েছে; সোনালী মুরগি ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৪৮০ থেকে ৫৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে সব ধরনের সবজির দামও চড়া বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব কিছু সবজির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। এরমধ্যে দাম বেড়ে পটল ৬০ টাকা, লম্বা বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা ও গোল বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শীতের আগাম সবজি বাজারে এলেও দাম এখনও বেশি। শিম ১০০ থেকে ১২০ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকা, গাজর ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, বরবটি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ফুলকপি ছোট আকারে জোড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এছাড়া কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শসা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কচুর মুখি ও মুলা ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

চলতি সপ্তাহে সবজির দাম গড়ে কেজিতে ৫ টাকা বাড়ার তথ্য দিয়ে শান্তিনগর বাজারের বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, “গত সপ্তাহের চেয়ে প্রতিটি সবজি কেজিতে গড়ে ৫ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সবজির ক্ষতি হয়েছে। আবার খারাপ আবহাওয়ার কারণে মফস্বল থেকে ঢাকায় সবজি আসতেও সমস্যা হয়েছিল, যে কারণে কিছু দাম বেড়েছে।”

কিনছেন কম

রামপুরা হাজীপাড়ার আদিবা স্টোরের দোকানি আব্বাস আলী গত বেশ কিছু দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ও বেড়েছে। যে কারণে কেউ কেউ দোকানে বাকি করেও টাকার অভাবে যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছেন না বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষ্য, “আগে যারা নিয়মিত বাজার-সদাই করতেন তাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। আবার কিছু লোক আছে দুই-এক দিনের মধ্যে বাকি নেওয়ার কথা বলে আর দোকানে আসছেন না। হয়ত তারা বাকির টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না, সেই কারণে আসছেন না।”

প্রতিটি জিনিসের দাম গড়ে অন্তত ৫০ শতাংশ বেড়েছে, এমন আনুমানিক হিসাব দিয়ে ওই দোকানি জানন, মানুষ দোকানের সামনে এসে হতাশা ব্যক্ত করে। প্রথমেই এই জিনিস সেই জিনিসের দাম কত জানতে চান। আগে তাদের এমনটা করতে দেখা যায়নি।

‘দাম জিজ্ঞাসা করার কারণও আছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে আটা আগে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি ছিল তা এখন দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ময়দার দাম বেড়েছে। বিস্কুট, সাবান, টিস্যু, ওয়াশিং পাউডারের দাম অনেক বেড়েছে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে কোনো কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে।”

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই বাজারে এসে কী রেখে কী কিনবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। সেই কথাই উঠে এসেছে এক পোশাককর্মীর কথায়।

গত মঙ্গলবার পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা ও পোশাক কর্মী আছিয়া খাতুন স্থানীয় এক দোকানিকে ১৫ টাকার ডাল, দুই কেজি মোটা চাল, দুইটি ডিম, ১০ টাকার পেঁয়াজ দিতে বললেন। এই অল্প সদাই কিনেই তাকে ১৬০ টাকা দাম দিতে হল।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আয় ও সংসারের ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে আছিয়া বলেন, “১৩ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই, তা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। সংসারে আমার দুই বাচ্চা ও মা আছে। বৃদ্ধ মা আশপাশের বাসায় দুই/এটা কাজ করে কিছু আয় করে। জিনিসপত্রের যে দাম অনেক হিসাব করেও মাস চালাতে পারি না।”

চাল, ডাল, পেঁয়াজ ও ডিম ছাড়াও এদিন কিছু শাক ও এক জাতের সবজি কিনতে আরও ৫০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিদিন ২০০ টাকার বেশি খরচ করব না বলে হিসাব করি, কিন্তু কুলানো যায় না।”

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে আসা এ পোশাককর্মীর ভাষ্য, “বেতন তো বাড়ে না, করোনার সময় অনেক দিন বেকার থাকতে হয়েছে। এখন চাকরি থাকলেও ডেইলি জিনিসের দাম বাড়ছে। দামের কারণে বাজারে গেলে কিছু কেনা যায় না। কোনো কোনো দিন বাচ্চাদের মুখে দুই মোটো ভাত দিতে পারলেও সাথে অন্য কিছু দিতে পারি না। গ্রামেও কোনো কাজ নেই যে সেখানে গিয়ে কিছু একটা করবো।”

শুধু নিম্ন আয়ের লোকজন নন, সীমিত আয়ের অন্যরাও সংসারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন।

একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও উত্তরার বাসিন্দা নূর আলম শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে ১০ হাজার টাকায় বাজার-সদাই করলে এক মাস চলে যেত, এখন সেই জায়গায় ১৫ হাজার টাকাও হয় না।”

পণ্যের পাশাপাশি জীবনযাত্রায় অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে ব্যয় অত্যধিক বাড়ছে সেই কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সংসারের খরচ বেড়েছে। বাচ্চার স্কুলের ব্যয় বেড়েছে, যাতায়াত ব্যয় বেড়েছে। এখন খাবার খরচকে বাধ্য হয়ে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। যে কারণে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা আগের মত করা সম্ভব হচ্ছে না।”

আরও পড়ুন:

Also Read: বাজারের উত্তাপ এবার ব্রয়লার মুরগিতে

Also Read: ডিমের দাম নির্ধারণে ‘মনোপলি’ মানা হবে না: মন্ত্রী রেজাউল

Also Read: ছুটির প্রভাবে ক্রেতা কম মাছের; ঝাঁজ বেড়েছে কাঁচামরিচে

Also Read: চিনিতে প্রভাব নেই সরকারি দামের

Also Read: ‘সবজির বাজারেও হাত পোড়ার অবস্থা’

Also Read: বাজারে আবার আলোচনায় ডিমের দামবৃদ্ধি

Also Read: চাহিদায় হেরফেরে দাম বাড়ছে ডিম মুরগি আলুর