ভাসানচরে ঢেউ গতিরোধক বাঁধের একজন কারিগর ইসমাঈল আকন্দ

বোরহান বিশ্বাস
Published : 21 Dec 2020, 09:22 AM
Updated : 21 Dec 2020, 09:22 AM

ঢেউয়ের গতি কমাতে প্রস্তুত পাইল ও বুম। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাচ্ছে; টেলিভিশনে এ দৃশ্য দেখে ইসমাঈল আকন্দের চোখ জলে ভরে ওঠে।

আবেগি কন্ঠে স্ত্রী, কন্যা, ছেলেকে ডেকে পর্দায় দৃশ্যমান ভাসানচরকে দেখিয়ে বলেন, "এ কাজে আমারও অংশগ্রহণ আছে। ওই যে সমুদ্রে সারিবদ্ধভাবে লোহাগুলো ভাসতে দেখা যাচ্ছে, ওগুলো আমার নিজের হাতে করা।"

ইসমাঈল আকন্দের কথা শুনে সবাই আপ্লুত হন। যদি পরিবারের সবার বিষয়টি জানা। তারপরও তার মুখ থেকে শোনার পর তা যেন নতুন মনে হয়।

বুম ও পাইল ভাসানচরে পাঠানোর প্রস্তুতি পর্ব। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের এমন বড় একটি কাজে অংশ নিতে পেরে ইসমাঈল আকন্দ ও তার পরিবারের সবাই গর্বিত। তারা থাকেন ঢাকার খিলগাঁও এলাকায়।

রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাবে কি না, একটা সময় অন্য সবার মতো ইসমাঈল আকন্দেরও এমন সন্দেহ ছিল; কিন্তু সেটি এখন আর নেই। ভাসানচর নিয়ে রোহিঙ্গাদেরও ধারণা বদলেছে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে তাদের ১৬৪২ জনের প্রথম দলটি ভাসানচরে গিয়ে অন্য সবাইকে সেখানে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

বাতাস প্রবেশ করিয়ে বুমের 'লিক টেস্ট' করা হচ্ছে। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

ইসমাঈল আকন্দের সঙ্গে আলাপে জানতে পারলাম, প্রায় ১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসানচর সংলগ্ন সমুদ্রতীর ও বাঁধসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে ব্রিটিশ কোম্পানি এইচআর ওয়ালিংফোর্ড।

বাংলাদেশ নেভির এ প্রকল্পে নির্মাণ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআরসিসি)। আর এই সিআরসিসি'র কোয়ালিটি অ্যাসিউর‌্যান্স (কিউএ) এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোলার (কিউসি) ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইসমাঈল আকন্দ।

প্রায় তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে নেওয়া এ প্রকল্পের সব কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ধীরগতির ভাঙন প্রতিরোধে ৪০০-৫০০ মিটার দূরে ওয়েভ স্ক্রিন পাইলিং, গ্র্যাভেল স্থাপন ও জিও ব্যাগ সংবলিত তিন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরডিপিপি অনুযায়ী ৯ ফুট থেকে ১৯ ফুট বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ গত জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে।

ইসমাঈল আকন্দ বলেন,  ভাসানচরকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে ঢেউ গতিরোধক বাঁধ।

তিনি বলেন, "সর্বপ্রথম নেভির কনসালটেন্টরা আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেন। যাকে সাগরমুখী বলা হয়। এখানে ঢেউয়ের মাত্রাটা বেশি। নেভির কাজ থেকে বুঝে পেয়ে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আমরা কাজ শুরু করি।

"সরেজমিনে ব্রিটিশ কোম্পানি এইচআর ওয়ালিংফোর্ডের সিনিয়র প্রকৌশলী মি. মার্টিন ও সিআরসিসি'র কান্ট্রি ম্যানেজার ইউকিউসহ আমরা পরিদর্শনে যাই। সিদ্ধান্ত হয়, ২৪ মিটারের পাইলিং পাইপের ১৪ মিটার মাটির নিচে এবং ১০ মিটার উপরে রাখা হবে।"

চলছে পাইল পাইপ পরীক্ষণ। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

এ কাজের উদ্বোধন হয় ২০১৮ সালের ১১ মার্চ। পরিকল্পনা নেওযা হয় মাঝখানে যে বুমগুলো থাকবে সেগুলো জোয়ারের সময় পানিতে ভাসবে। আবার ভাটার সময় নেমে যাবে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এই বুমে এসে আছড়ে পড়লে তার গতি কমে যাবে। এতে করে বুমের অন্য অংশের পানি শান্ত থাকবে। অর্থাৎ ভাসানচরকে তা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করবে।

এ বুমের অবস্থান ভাসানচরের মূল ভূখন্ড থেকে ১৫ মিটার দূরে জানিয়ে ইসমাঈল বলেন, তিন কিলোমিটার ঢেউ গতিরোধক বাঁধে মোট ১২৯টি পাইল এবং ১২৭টি বুম ব্যবহার করা হয়েছে।

ডাবল জো হেমার দিয়ে পাইলিং করতে হয়েছে  বলে জানালেন এই ইঞ্জিনিয়ার।

"সিঙ্গেল হেমার দিয়ে এটি সম্ভব হয়নি। প্রতিটি পাইপের ঘনত্ব ছিল ১৬ মিলিমিটার। তাই এটি সিঙ্গেল হেমার দিয়ে করা সম্ভব ছিল না।"

কাজের সময় সাময়িক সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন,  "জোয়ার-ভাটার কারণে পাইলিং করার সময় কিছুটা সমস্যায় পরতে হয়েছিল। ভাসমান ক্রেনে করে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। জোয়ারের সময় এটি ভেসে থাকলেও ভাটায় মাটির সঙ্গে লেগে যেত। এতে করে এটি সমানভাবে বসিয়ে কাজ করতে বেগ পেতে হতো। তখন আমাদের জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতো হতো।"

প্রকল্প ঘুরে দেখছেন কনসালটেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মারটিন ও নেভি সদস্যরা। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

যেখানে পাঁচটি পাইলিং করা যেত জোয়ার-ভাটার কারণে সেখানে দুটি পাইলিং করেই 'সন্তুষ্ট' থাকতে হয়েছে তাদের। বৈরি আবহাওয়া তো ছিলই, আরো নানা রকম প্রতিকূলতাও ছিল; কিছু মাটি ছিল নরম, কিছু শক্ত। শক্ত মাটিতে পাইলিং করতে কিছুটা সময় লেগেছে তাদের।

ইসমাঈল আকন্দ বলেন,  "জাহাজে আসা প্লেট চট্টগ্রামের সাগরিকা ওয়ার্কশপে নিয়ে মাপ অনুযায়ী তৈরি করতাম। এরপর মাঝির ঘাট থেকে কর্ণফুলীর এফএমসি ডকইয়ার্ডে পাঠিয়ে দিতাম।"

চট্টগ্রাম এফএমসি ডকইয়ার্ডে কাজের অগ্রগতি ঘুরে দেখা হচ্ছে। ছবি – ইসমাঈল আকন্দের কাছ থেকে সংগৃহিত

এ কাজের পেইন্টিং ও ওয়েল্ডিংয়ের দায়িত্বে ইসমাঈল আকন্দ নিজেই।

বুম, পাইল তৈরি করে এফএমসি থেকে বার্জে করে ভাসানচরে সব পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

তিনি বলেন, "কাজের পুরোপুরি তদারকির জন্য আমাকে সেখানে রাত-দিন থাকতে হতো। একেবারে বার্জে তোলা পর্যন্ত।

"নেভির জাহাজে করে ভাসানচরে গেলে ৬ ঘন্টার মতো সময় লাগে। পতেঙ্গা থেকে স্পিডবোটে ২ ঘন্টা। নোয়াখালীর চেয়ারম্যান বাড়ি থেকেও যাওয়া যায়।"

ভাসানচরকে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ থেকে রক্ষা করতে তিন কিলোমিটারের যে গতিরোধক বাঁধ তৈরি করা হয়েছে তার প্রতিটি পাইপ, প্রতিটি বুম  ইসমাঈল আকন্দের 'নিজের হাতে' নির্মাণ করা।

একটি কাজে যুক্ত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন জানিয়ে  তিনি বলেন, "এগুলোতে আমার ছোঁয়া লেগে আছে। কোনো কোনো কাজের মূল্য শুধু অর্থের নিক্তিতে পরিমাপ করা যায় না।"