ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গারা নিতে চান অন্যদেরও

কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে বাঁশ আর তারপুলিন দিয়ে তৈরি ছাপড়া ঘর, অনিরাপদ আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে ভাসানচরের পরিকল্পিত আবাসনে এসে স্বস্তি ও তৃপ্তির কথা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা।

রিয়াজুল বাশার ভাসান চর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2020, 12:14 PM
Updated : 5 Dec 2020, 12:49 PM

এদের অনেকেই এখন আত্মীয়-স্বজনদেরও কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন।

ভাসানচরে নিজের বুঝে পাওয়া ঘরে প্রথম রাত কাটানোর পর রোববার সকালে ঘরের সামনের ফাঁকা মাঠে কয়েকজন সঙ্গে আড্ডারত অবস্থায় কথা হয় মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে।

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বালুখালী ক্যাম্প থেকে তিনি ভাসনচরে এলেও সেখানে রেখে এসেছেন বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার।

হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে অনেক ভালো লাগছে। আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাব। ওখানে গিয়ে নিয়ে তাদের নিয়ে আসব। আর তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসব।”

কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে আসা মোহাম্মদ জোবায়ের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না। জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি। আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে।”

ভাসানচরে গিয়ে মোহাম্মদ জোবায়ের বলছেন, এত ভালো পরিবেশের কথা তারা ভাবতেই পারেননি। ছবি: রিয়াজুল বাশার

কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ নাগরিকের মধ্যে এক লাখ জনকে আনতে প্রায় ৩১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার।

স্থানান্তরের প্রথম ধাপে শুক্রবার কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বাসে ও জাহাজে করে দুই দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি দুপুরে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছের ১৩ হাজার একর আয়তনের দ্বীপ ভাসানচরে পৌঁছায়।

পৌঁছানোর পরই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় সারি সারি লাল ছাউনির বাড়িগুলোতে; আর নতুন ঠিকানায় পৌঁছনো প্রায় সবারই চোখেমুখে দেখা গেল আনন্দের ছাপ।

তাদের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে নতুন ঠিকানার খবর জানাচ্ছিলেন কক্সবাজারের পুরনো ঠিকানায় রেখে আসা সঙ্গীদের, ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলেনও। খোলা জায়গা পেয়ে শিশুরা মেতে উঠেছিল খেলায়।

ভাসানচর দেখে রোহিঙ্গাদের অনেকে মোবাইল ফোনে নতুন ঠিকানার খবর জানাচ্ছিলেন কক্সবাজারের পুরনো ঠিকানায় রেখে আসা সঙ্গীদের। ছবি: রিয়াজুল বাশার

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসছে; যদিও বাংলাদেশ সরকার বলছে, এই স্থানে রোহিঙ্গারা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে নিরাপদে থাকতে পারবে।

ভাসানচর প্রকল্প আর কক্সবাজারের ক্যাম্পের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে রোহিঙ্গা জোবায়ের বলেন, “দুটোর মধ্যে তুলনাই হয়না। ওইটা পলিথিনের বাসা, এখানে পাকা ঘর। অনেক ভালো লাগছে এখানে।”

স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাসানচরে আসা জোবায়ের আর কখনও কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফিরতে চান না বলেও জানান।

প্রিয়জনের লাশ আর পুড়তে থাকা ভিটেমাটি পেছনে ফেলে প্রাণ হাতে করে তিন বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। তার আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল আরও প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবও প্রকট হয়ে উঠেছিল। ক্যাম্পগুলোতে খুনের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। এছাড়া মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবরও আসছে প্রতিনিয়ত।

তাই ভাসানচরে পৌঁছেই নিজেকে অনেকটা নিরাপদ ভাবছেন বালুখালীর ক্যাম্প থেকে আসা আবদুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওখানে আমার ভয় লাগছিল। চলাফেরা করতে গেলে বিভিন্ন মানুষ আমার গায়ে হাত দিয়েছে। এখানে সেই সমস্যা নেই। আমি ভালোভাবে চলতে চাই।

“ওখানে প্রয়োজনে বাইরে যেতে গেলেই কেউ বলত চোর, কেউ বলতো অমুক। এখন এখানে কেউ সেটা বলবে না।”

ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, এমন পরিবেশ দেখে তারা খুশি। ছবি: রিয়াজুল বাশার

ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য বর্ণনা করে তিনি বলেন, “ওখানে ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেত। ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারত। এখানে তা পারবে না। যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ। কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না।”

আবদুর রহমান ভাসানচরে গাড়ি চালিয়ে বা দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন দেখছেন। 

ভাসানচরের নতুন ঠিকানায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার নিজেদের জন্য আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা। সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, এমনকি জীবিকা নির্বাহের সুযোগও।

এই আশ্রয়ন প্রকল্পে ১২০টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছগ্রামের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার থাকার জায়গা। প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ১২টি হাউজ এবং চারতলাবিশিষ্ট ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। পাকা দেয়ালের ওপর টিনের শেডের প্রতিটি হাউজে রয়েছে ১৬টি করে কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে চারজনের একটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা।

জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী, আবাসনের ক্ষেত্রে যেখানে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গার কথা বলা হয়েছে, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশিই জায়গা রাখা হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক জানালেন।

শুক্রবার যে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা ভাসানচরে এসেছেন, তাদের জন্য ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর ক্লাস্টারের ৪৮টি হাউজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার থেকে প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা এসেছেন ভাসানচরে। ছবি: রিয়াজুল বাশার

স্কুল, মাদ্রাসা ও খোলামেলা পরিবেশের জন্য ভাসানচর অনেক ভালো লাগছে বলে জানালেন বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে আসা আব্দুস সামাদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। ঘরবাড়ি অনেক। অনেক বড় বড় রুম। এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে। বড় খেলার মাঠ আছে।

“কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম। মানুষ অনেক। একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না।” 

ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য বর্ণনা করে জমিনা আক্তার বলেন, “এখানে বেশি ভালো লাগছে। ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো।”    

ভাসানচরে যেতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো যেমন অভিযোগ করছে, বিপরীতে ভাসানচরে না আসার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল বলে জানালেন রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ।

উদ্বেগ নিয়ে এলেও ভাসানচরে পৌঁছে এখন স্বস্তি ও তৃপ্তির ছাপ এই রোহিঙ্গা নারীর চোখে-মুখে। ছবি: রিয়াজুল বাশার

মোহাম্মদ আলি উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসার আগে আমাদের অনেকে ভয় দেখাচ্ছিল যে, পানি উঠবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কুমিরে খাবে। এনে এখানে পানিতে ফেলে দেবে।

“এখানে এসে দেখছি, যারা ভয় দেখাচ্ছিল তাদের কথা ঠিক না। অনেক ভালো লাগছে এখানে এসে। চলাফেরা করতে পারবো। অনেকটা স্বাধীনভাবে থাকতে পারব। অনেক জায়গা আছে। চাষ করে, ক্ষেত করে খেতে পারব। কুতুপালংয়ে কেনো চাষ করার কোনও জায়গা ছিল না।”

ভাসান চর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “যারা এখানে আসবেন, তাদের জীবনযাপনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থাপনা এখানে করা হয়েছে। তারা এখানে আগের চেয়ে ভালো থাকবেন।”

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে। ছবি: রিয়াজুল বাশার

সরকারের অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামসু-দ্দৌজা বলেন, আপাতত ২২টি এনজিওর মাধ্যমে এই রোহিঙ্গাদের খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হবে।

“প্রথম সাতদিন তাদের রান্না করা খাবার খাওয়ানো হবে। এর মধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে দেওয়া হবে এলপিজি সিলিন্ডার। তখন তারা নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবে। এই এনজিওগুলো তাদের খাদ্য সরবরাহ করে যাবে।”

সাগরে মাঝে নির্জন এই দ্বীপে বসবাসের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করে আসছে, তা প্রশমনে নানা ‍পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার।

রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ৩১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার।

দ্বীপের ১৭০২ একর জমির চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য।

এর ভেতরেই রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার জন্য ৪৩২ একর এবং ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের কাজে ৯১৮ একর এলাকা রাখা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের থাকার প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য রয়েছে একটি করে চারতলা কম্পোজিট স্ট্রাকচারের শেল্টার স্টেশন। এই শেল্টার স্টেশন ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে সক্ষম।

প্রতিটি হাউজে বসবাসকারী নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা। প্রতিটি হাউজের ছাউনির ওপর রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। ঘরে আছে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা।

যার যার ঘরে ওঠার আগে ভাসানচর আশ্রয়ন প্রকল্পের খাদ্যগুদামে মোনাজাতে অংশ নেয় রোহিঙ্গারা

এর আগে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়েছিল।

এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে দেখার জন্য ভাসানচরে পাঠানো হয়।

তারা ফেরার পর তাদের কথা শুনে রোহিঙ্গাদের একাংশ ভাসান চরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে বলে জানানো হয় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এরপর নেওয়া হয় প্রথম দলটিকে স্থানান্তরের উদ্যোগ।