পাহাড়ের সংস্কৃতিজন রনজিৎ কুমার মিত্র

তার মৃত্যুতে পাহাড় হারিয়েছে সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ আলোকবর্তিকা।

অজয় মিত্রঅজয় মিত্র
Published : 20 Nov 2022, 02:24 PM
Updated : 20 Nov 2022, 02:24 PM

রনজিৎ কুমার মিত্র সংগ্রাম করেছেন সংস্কৃতি নিয়ে। আবার একান্নবর্তী পরিবারের জীবিকার জন্যও সংগ্রাম করেছেন। পরিবার খুব বেশি সহায়ক না হলেও, তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। আঁকাআঁকি, নাটক, থিয়েটার ছিল তার রক্তে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ছাত্র হিসেবে ঢাকা চারুকলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র ও গৌতম মুনি চাকমা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক আবুল বারাক আলভী ছিলেন সেসময় তাদের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী।

পঁচাত্তর সালের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ছৈয়দুর রহমানের সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলে আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র ।১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন রাঙামাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর এইচটি ইমামের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে সাংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন।মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাষ্ট পর্যন্ত ছিলেন রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক।

ফটোগ্রাফিতে তার ছিল অসম্ভব ঝোঁক। ছবি তোলা, ডার্করুম, ডেভেলপ, রিটাচসহ খুটিনাটি শিখেছিলেন বহু জায়গায়। সেটাকেই হাতিয়ার করে সংসারের হাল কাঁধে তুলে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন চিত্রবিতান স্টুডিও। পাহাড়ের প্রায় প্রতিটা এলাকাতেই ছবি তোলার কাজেঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রকল্পেও সারা রাঙ্গামাটি জুড়েই ছবি তোলার কাজ করেছেন।

১৯৭১ সালের আগে চাকমা রাজবাড়ির বহু সাদাকালো ছবি তার হাতে তোলা বলেই জেনেছিলাম উনার নিজের মুখেই।

১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রাঙামাটি আর্টস্কুল।ছেলেমেয়েদের আর্ট শেখাতে আনা-নেওয়া করতে গিয়ে রাঙ্গামাটির এক সময়কার জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর স্ত্রী এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের স্ত্রী আবৃত্তি ও কাপড়ের নকশা আঁকা শিখেছিলেন এখানে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত জাতীয়, স্থানীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় সারা বছর জুড়ে ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন, দেওয়াল লিখন নিয়ে ব্যস্ত সময়ই কাটতেন রনজিৎ কুমার মিত্র । যা থেকে আয়ের পুরোটাই উজার করে দিতেন তার তিন ভাইয়ের ২৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে।তিনি কখনো এককভাবে ভাবেননি নিজের কথা, ভবিষ্যৎ সংকট, স্বার্থ এসব।

রনজিৎ কুমার মিত্র কিছুদিন দৈনিক মানবজমিনের জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক গিরিদর্পণ, ঝিনাইদহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সীমান্তবাণী, পাক্ষিক পত্রিকায় লেখালেখিও করেছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ফেডারেশন রাঙামাটি সদরথানা’র সভাপতি।

রাঙ্গামাটির তৎকালীন আর্ট কাউন্সিল হল, রাজার মাঠে যখন এক্সিবিশন হতো। তিনি দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন আঁকাআঁকি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে।

আমৃত্যু সংস্কৃতিমনস্ক রনজিৎ কুমার মিত্র নিজের হাতে গড়ে তোলেন বহুরূপী নাট্যসংস্থা। যেখানে সুনামের সাথেই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহু নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন তিনি।

রাঙ্গামাটিতে ১৯৮০ সালে স্বর্ণশীলা এবং ঢাকায় ১৯৮২ সালে জাতীয় নাট্য উৎসবে ভারতীয় বিখ্যাত নাট্যকার শম্ভুমিত্রের ’চোর’ নাটক মঞ্চায়ন করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।পরে কর্ণফূলী থিয়েটার থেকেও নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন সমমনা নাট্যকর্মীদের সাথে নিয়ে।

সেসময় পাহাড়ি এই মফস্বল শহরে পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চায়ন করা ছিল দুরূহ। যেহেতু এখানে টিকেট কেটে নাটক দেখার সংস্কৃতি নেই, সেহেতু নাট্যকর্মীদের পকেটের টাকা দিয়ে নাট্যচর্চা সব সময় বেশি দূর এগোয় না।

২০১৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত দেশের সমস্ত জাতীয় দিবস ও উৎসবে, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন, জেলা তথ্য অফিসের সচেতনতা মূলক কার্যক্রম, সরকারী বিভিন্ন দফতরসহ বিভিন্ন অফিস-প্রতিষ্ঠানের নাটকসহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজনের অপরিহার্য একজন মানুষ ছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র

তার প্রত্যক্ষ তদারকিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারএক্টিভ পপুলার থিয়েটার কার্যক্রমের আওতায় ইউনিসেফ ও সরকারী অর্থায়নে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও  প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতামূলক নাটকের উপর দেশ বরণ্য নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ ও আরণ্যক নাট্যদলের সান্নিধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার প্রতিটা ইউনিয়নে মঞ্চায়ন করেছেন বিষয় ভিত্তিক নাটক।

নাটক প্রাণ রনজিৎ কুমার মিত্রের সঙ্গে সখ্যতা ছিল কিংবদন্তী নাট্যজন আনোয়ার হোসেন, গোলাম হাবিবুর রহমান মধু, রহমত উল্লাহ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, প্রখ্যাত বেহালা বাদক নজরুল ইসলাম তিতাস সহ আরো অনেকের।

উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ও রাঙামাটি জেলা শিশু একাডেমির চিত্রাংকন ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক ছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির অংকন, আবৃত্তি ও নাট্য প্রশিক্ষক।

উদ্বোধনের পর ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কেন্দ্রে নিয়মিত নাটক-নাটিকা, জীবন্তিকা, কথিকা রচনা, পরিচালনা ও তালিকাভুক্ত নাট্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।

১৯৯০ সালে পার্বত্য রাঙ্গামাটিতে নাট্যসপ্তাহ উপলক্ষে মঞ্চায়িত নাটকে প্রথম স্থান অধিকার করেন রনজিৎ কুমার মিত্র।১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নাটকের উপর মাসব্যাপী উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৯৯ সালে রাঙ্গামাটিতে সার্ক মীনা দিবস ও জাতীয় শিশু সপ্তাহে আয়োজিত নাট্যানুষ্ঠানের জন্য প্রশংসিত হন।

২০০১ সালে রাঙামাটি পার্বত্যজেলা পরিষদ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে জেলার শ্রেষ্ঠনাট্য ব্যক্তিত্বের সম্মাননা গ্রহণ করেন।

তাকে বিশিষ্ট নাট্যজন সম্মাননা ২০০৪ দেয় স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পী নিকুঞ্জ।

২০১১ সালে প্রথমবার স্ট্রোকের পর ডান হাতের কিছুটা অক্ষমতা নিয়েও করে গেছেন নাট্যচর্চা।

তারপর ঢাকায় ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্য উৎসবে  রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ নাট্যদল নিয়ে সম্মাননা গ্রহণ করেন তিনি।

২০২১ সালে ওয়ার্ল্ডপিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইট স্সোসাইটি, রাঙ্গামাটি  থেকে নাট্য অভিনেতা সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক তুলে দেওয়া হয় তার স্ত্রীর হাতে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, রাঙামাটি জেলার সভাপতিও ছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র।পার্বত্য অঞ্চলের সুপ্রাচীন শ্রী শ্রী রক্ষা কালী মন্দির কমিটিতে দীর্ঘদিন কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক,সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ছাত্রজীবনে স্কাউট আন্দোলনে যুক্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমণ করেন তিনি।

নাটক নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চেও অভিনয় করেছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্ভুদ্ধ করতে জয়বাংলা নামে পথনাটক করেছিলেন কলকাতার পথে পথে।

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ের পর তার বড় ভাই সুনীল কান্তি মিত্র শয্যাশায়ী হন। আর সে কারণে কলকাতার একাধিক চলচিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রনজিৎ কুমার মিত্র।  

২০১৩ সালের ২ অগাস্ট শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটায় স্ট্রোকের চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

রনজিৎ কুমার মিত্র আমার বাবা। তার মৃত্যুতে আমি বাবা হারিয়েছি,  আর পাহাড় হারিয়েছে সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ আলোকবর্তিকা।