মাতৃরূপী দুর্গার মুখ উন্মোচিত হয়েছে মণ্ডপে। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতীকে নিয়ে মণ্ডপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন দশভূজা দেবী।
Published : 20 Oct 2023, 11:36 PM
নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনেই জমতে শুরু করেছে উৎসব। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খনাদ আর খোল-করতাল মাতিয়ে তুলেছে পূণ্যার্থীদের মন।
সপ্তমীতে শুরু হবে মূল পূজা। তবে ষষ্ঠী তিথির সন্ধ্যাতেই ভক্তদের ভিড়ে দুর্গা মণ্ডপ জনারণ্যে পরিণত হয়। নানা বয়সী পূণ্যার্থী দুর্গা প্রতিমার সামনে এসে প্রণাম করেন। কেউ কেউ দেবীর কাছে প্রকাশ করন মনেবাঞ্ছা।
ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুক্রবার শুরু হয়েছে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শনিবার মহাসপ্তমী। ভক্তরা উপবাস রেখে অঞ্জলি দেবেন এবং প্রসাদ গ্রহণ করবেন।
স্বামীর ঘর স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে পিতৃগৃহে পদার্পণ করছেন দেবী দূর্গা। পাঁচ দিনের এ সফরে তার সাথে রয়েছেন চার সন্তান গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। আরও আছে কার্তিকের কলা বউ।
ষষ্ঠী সন্ধ্যায় প্রথমে দেবীর বোধন হয়, জাগিয়ে তোলা হয় দেবীকে। পরে অধিবাস এবং দেবী পূজার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। এদিন মাতৃরূপী দুর্গার মুখ উন্মোচিত হয় মণ্ডপে। দেবী দর্শনে ভিড় জমান ভক্তরা। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতীকে নিয়ে মণ্ডপে অধিষ্ঠিত হন দশভূজা দেবী।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা হয় অকাল বোধন।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম, বরোদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, গুলশান- বনানী সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদ মণ্ডপ, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারে মহাসমারোহে হচ্ছে দুর্গা পূজা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় রমনা কালীমন্দিরে দেখা যায়, আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ। শত শত ভক্ত এসেছেন দেবী দর্শনে। তাদের কেউ ছবি তুলছেন মণ্ডপে। কেউবা প্রণাম করছেন দেবী দুর্গাকে।
প্রবেশ পথের দুই পাশে বিভিন্ন স্টলে নানা রকম পণ্যের সমাহার নিয়ে বসেছেন দোকানীরা।
একই চিত্র দেখা যায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরেও। তবে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা পরিদর্শনে আসবেন বলে নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছিল চোখে পড়ার মত।
মন্দিরের ভেতরের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্টল সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা। কাঁসার থালা, শঙ্খসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।
মন্দিরের বেলগাছতলায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দেখা যায় বোধনে ব্যস্ত পুরোহিতসহ পূজারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবিন্তা সাহা মণ্ডপে এসেছিলেন দেবী দর্শনে। তিনি বলেন, “কাল সকালেই গ্রামের বাড়ি চলে যাব, ঢাকার মণ্ডপে ঘোরা হবে না। এজন্য আজকেই বেরিয়েছি। কয়েকটা মণ্ডপে ঘুরব।"
ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা প্রণব চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সন্ধ্যায় বোধন এবং অধিবাসের মধ্য দিয়ে দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সপ্তমী থেকে মূলত পূজা শুরু হবে। বোধনটা হলো উপলব্ধি করা যে তিনি এসেছেন।"
এর আগে ষষ্ঠীর সকালে হয়েছে কল্পারম্ভ, যার মধ্য দিয়ে শুভ শক্তির প্রত্যাশা করে পূজার জন মনোবাসনা করা হয়।
প্রণব চক্রবর্তী বলেন, "কল্পারম্ভ মানে হলো আমরা সংকল্প করলাম যে পূজা করব। কোনো অশুভ শক্তি যেন বিঘ্ন না ঘটায়। আমাদের ধারণা বা বিশ্বাস এবং আমরা কল্পনা করছি যে, দেবী বিল্ব বৃক্ষে এসেছেন। তাকে আমরা পূজা করব, এই সংকল্প করাটাই হল কল্পারাম্ভ।"
দেশজুড়ে এবার ৩২ হাজার ৪০৭টি মন্দির-মণ্ডপে পূজা হচ্ছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দশভূজা দেবী দুর্গা; বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, শনিবার মহাসপ্তমীর সকালে প্রথমে নবপত্রিকা স্থাপন করা হয়। এদিন থেকেই মূলত পূজা শুরু হয়।"
‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান এই নয়টি উদ্ভিদকে পাতাসহ একটি কলাগাছের সঙ্গে একত্র করা হয়।
পরে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম ‘কলাবউ’।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে বিবেচনা করা হয়। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমোঃ’ মন্ত্রে পূজিত হন।
নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন উপচারে দেবীকে স্নান করানো হয়।
পঞ্জিকামতে, দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যে এসেছেন ঘোটকে অর্থাৎ ঘোড়ায় চড়ে। যাবেনও ঘোড়ায় চড়ে। এর ফল ‘ছত্রভঙ্গ’।
পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, “ঘোটকে দেবীর আগমন এবং গমন অশুভের বার্তা দিচ্ছে, তবে ভক্তের আরাধনায় দেবীর মন তুষ্ট হলেই মিলবে শান্তি।”
অষ্টমী ও নবমী শেষে মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের।