ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়ে গেছে জানিয়ে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “গতকাল রাত্রে কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীকে ধরতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এবং কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করেছে।”
Published : 07 Apr 2024, 02:09 PM
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পাহাড়ের সশস্ত্র দল কেএনএফ (কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) শান্তি আলোচনা শুরুর পর তাদের ‘বিশ্বাস’ করা হলেও তারা ভেতরে ভেতরে ‘ষড়যন্ত্র’ করেছে।
তবে কেএনএফ এর তৎপরতায় গত কয়েক দিনে পাহাড়ে নতুন করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘সম্পর্ণরূপে সক্ষম’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
দুই দিনে তিন ব্যাংকে ডাকাতি, অপহরণ ও গোলাগুলির প্রেক্ষাপটে রোববার বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলা পরিদর্শন শেষে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন মাঠে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা বলেন সেনাপ্রধান।
তিনি বলেন, “তাদেরকে শুরুতে আমরা একটু বিশ্বাস করেছিলাম। (ভেবেছিলাম) শান্তি আলোচনা হচ্ছে, যেহেতু শান্তি আলোচনা শেষ হয়নি, শান্তির ভেতরেই শেষ হবে। কিন্তু এর ভেতরে এই অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
“প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইনশাআল্লাহ জনগণের ভেতর শান্তি ফিরে আসবে। এবং দেখতে পারবে যে এই সন্ত্রাসীদের কোনো জায়গা বাংলাদেশে নাই।”
ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়ে গেছে জানিয়ে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “আতঙ্ক দূর করার জন্যই আমরা সশরীরে এখানে আসছি। যা আমাদের করণীয়, সর্বাত্মকভাবে করছি। আপনারা ইতোমধ্যে বোধহয় জেনেছেন, গতকাল রাত্রে কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীকে ধরতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এবং কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করেছে।”
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে এই সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিস্ত প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের শুরুর দিকে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে এ সংগঠন গঠন করার কথা বলা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। সে কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফ বলছে, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ গঠন করতে চায় তারা।
সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে ২০২২ সালে খবর দেয় র্যাব।
কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও অগাস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়।
পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মত কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
‘শান্তি আলোচনা’ শুরুর পর পাহাড়ে হত্যা-সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরইমধ্যে ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন।
তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং এক ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।
দুটি ঘটনাতেই কেএনএফ এর নাম আসার পর ৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর ‘সম্ভব নয়’।
রোববার হেলিকপ্টারে বান্দরবানে এসে রুমা ও থানচির পরিস্থিত ঘুরে দেখেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি বান্দরবান সেনা রিজিয়ন মাঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমরা এখন সরকারের ওভারঅল স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যেভাবে এটা সরকার চিন্তা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের সমন্ত অর্গান, আমাদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, এবং অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন, সব সমন্বিতভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করব।
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে দায়িত্বগুলো পালন করার, বিশেষ করে যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া, সেইগুলো আমরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অলরেডি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। কিছু কার্যক্রম দৃশ্যমান, কিছু কর্যক্রম আপনারা দেখতে পাবেন না। বাট এর ফল আপনারা সময় মত পাবেন ইনশাআল্লাহ।
“আমি আপনাদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চাই, আমার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের শান্তির জন্য, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যা করণীয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ, সেটাই করতে হবে। আর সেটা বাস্তবায়নে সক্ষম হব বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি।”
প্রথম ব্যাংক ডাকাতির পর পাঁচ দিন হয়ে গেছে, সেনাবাহিনী জরুরি কোনো অভিযান করেছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “আপনার বুঝতে হবে, এখানে যদি একটা ফোর্স ডিফেন্স নিয়ে থাকত, আমি গিয়ে অ্যাটাক করে দিলাম। এরকম কেউ ডিফেন্স নিয়ে কোথাও আছে? আপনি জানেন কোথায় কে লুকিয়ে আছে? বাংলাদেশের পাড়ার ভেতর, জনগণের ভেতর কেউ যদি লুকিয়ে থাকে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর যেয়ে আমরা কি হামলা করব?
“সো আমাদের তথ্য নিশ্চিত হতে হবে কোথায় কে আছে, ধীরে ধীরে এগুলো ক্ল্যান্ডেস্টাইন অপারেশন, কোনো জায়গায় কমবাইনড অপারেশন, কোনো জায়গা যদি ডাইরেক্ট কনফ্রন্টশনে যেতে হয়, সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী যাওয়া হবে। তারা অস্ত্র ফেলে জনগণের সাথে মিশে সারা জায়গায় কোথায় কীভাবে আছে, সেইগুলো আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”
কেএনএফ যে হামলা করতে পারে, তেমন কোনো আগাম তথ্য ছিল কি না, সেই প্রশ্ন সেনাপ্রধানকে করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে তিনি শান্তি আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে বলেন, “আগাম তথ্য থাকলে তো আমরা ডেফিনিটলি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম। আমরা তো তাদেরকে বিশ্বাস করেছি। তারা তো দুইবার বসেছে শান্তি আলোচনায়। তৃতীয়বারও বসার কথা। তারা কি কোনো সময় বলেছে যে, ‘না এটা হবে না, আমরা এটা করছি না, মানি না’।
“৩১ তারিখে (৩১ মার্চ) ইস্টার সানডে সেলিব্রেট করার জন্য আমাদের তত্ত্বাবধানে এই রুমা জোনেই ৩৮টা কেক বিভিন্ন চার্চে আমরা দিয়েছি। খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিস্থিতি। বেথেল পাড়ার ভেতরে গিয়ে আমরা দিয়ে আসলাম। … ২ তারিখে এই ঘটনা!”
সেনাপ্রধান বলেন, “আপনি বন্ধুত্ব…. সব কিছু ঠিক আছে। ভেতরে ভেতরে আপনি কিছু করলে, মানুষের মনে ভেতরে তো আর ঢোকা যায় না। ভেতরে কোনো কিছু ষড়যন্ত্র করলে একটা…।”
তবে বমদের সবাই যে এসব ঘটনায় জড়িত না, সে বিষয়টি তুলে ধরে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “যেটুকু আমি শুনছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, সবাই এগুলোতে জড়িত না। কিছু আছে শান্তি চায়, কিছু কিছু আছে তারা চাচ্ছে না। সেগুলোকে এলিমিনেট করা হবে।”
কেএনএফ যে তাদের ফেইসবুক পেইজে শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার বিষয়ে উল্টো প্রশাসনকে দোষারোপ করেছে, সে কথা তুলে ধরে সেনাপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক।
উত্তরে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “আপনি যখন কোনো অপকর্ম করবেন, তখন তো আপনার চেষ্টাই থাকবে দোষটা অন্যের ঘাড়ে দিয়ে দেওয়ার। আপনারা তো সঠিক জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন। আমি যেটা বলেছি, এর ভেতর কোনোটাতো গল্প বা কিছু না। সবই তো বাস্তব কাহিনী বললাম।”
কেএনএফ কী উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তি আলোচনা থেকে সরে এল- সেই প্রশ্নে সেনাপ্রধান বলেন, “সেটা তারাই বলতে পারবে। আমি সুনির্দিষ্ট করে জানি না। কেন সরে যেতে চাচ্ছে, কী হচ্ছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাশের দেশের’ সন্ত্রাসীদের অস্ত্র কেএনএফ এর হাতে পৌঁছেছে বলে তথ্য পেয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সেনাপ্রধান বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত একটি প্রক্রিয়া চলছে। এখানে যার যার কাজের ক্ষেত্র আলাদা। সে কারণে ওই বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চান না।
“আপনাদের যে সমস্ত জিজ্ঞাস্য, যারা কনসার্ন, তাদের কাছ থেকে এটা জানলে ভালো হবে। আমরা একে অন্যের পয়েন্টটা বলা শুরু করলে হয়ত একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গা সৃষ্টি হবে।”
পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ১৩০টি ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ায় সেই সুযোগ কেএনএফ নিয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, “সুযোগ তো কিছুটা নিয়েছে, যেসব জায়গায় গ্যাপ হয়ে গেছে, আমরা সেগুলো কিছু আবার ফিলাপ করছি।”
সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, “যখন পরিস্থিতি অশান্ত হয় তখনই সেনাবাহিনীর দরকার। শান্তির ভেতরে সেনাবাহিনীর কী দরকার? যখন শান্তি থাকবে, তখন তো অসামরিক পরিবেশ, অসামরিক প্রশাসন, তারা সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করবে, প্রতিটা জায়গায় যা হচ্ছে, তাই হবে। এইসব দৈনন্দিন কাজ তো সেনাবাহিনীর না। যদি অশান্ত হয় তখনই আমাদের দরকার হবে।”