বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলপথের দুই পাশে নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়াল দেওয়া হলে সেটি আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের তীব্র শব্দ থেকে যেমন স্বস্তি দেবে, তেমনি ঢিল ঠেকানোর কাজটিও হয়ে যাবে এই ঢালে।
Published : 11 Jun 2023, 01:35 AM
রাজধানীবাসীকে যাতায়াতে স্বস্তি দিতে ছয় মাস আগে চালু হয়েছে মেট্রোরেল; কিন্তু ঢিল ছোড়ার এক ঘটনায় ব্যয়বহুল এ প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় পুলিশের একটি আলাদা ইউনিট (এমআরটি ইউনিট) গঠন হলেও ঢিল ছোড়ার মত ঘটনা ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ তাদের থাকবে না; কারণ, পুলিশের এ ইউনিটের দায়িত্ব হবে মেট্রো স্টেশনকেন্দ্রিক।
একজন বিশেষজ্ঞ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, রেলপথের দুই পাশে শব্দ নিরোধক দেয়াল বা নয়েজ ব্যারিয়ার বসানো হলে সেটি আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের তীব্র শব্দ থেকে যেমন স্বস্তি দেবে, তেমনি ঢিল ঠেকাতেও কাজ করবে ঢাল হিসেবে।
মেট্রোরেলের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহন ব্যবস্থা চালুর আগেই কেন ‘যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা’ নেওয়া হল না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
কয়েকশ উঁচু ভবন, উপায় কী?
গত ৩০ এপ্রিল কাফরুল থানা এলাকার কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার মাঝামাঝি এলাকার কোনো একটি ভবন থেকে ঢিল ছোড়া হয় মেট্রোরেল লক্ষ্য করে। ঢিলটি ট্রেনের জানালায় আঘাত করে। তাতে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।
এ ঘটনায় অপরাধীকে চিহ্নিত করতে আশপাশের কয়েকটি ভবন ঘিরে তদন্ত করেও কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ।
ফলে প্রশ্ন উঠছে, এরকম ঘটনা আরও ঘটতে থাকলে তা ঠেকানো যাবে কেমন করে?
প্রাথমিকভাবে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেল চললেও পরবর্তীতে ধাপে ধাপে পল্লবী, উত্তরা সেন্টার, মিরপুর ১০ সহ ওই পথের সব স্টেশন খুলে দেওয়া হয়। পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হলে মেট্রো চলবে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত।
আপাতত দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে মেট্রো চললেও পুরো কার্যক্রম শুরু হলে দিনরাত চলবে ট্রেন।
২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথের দুই পাশে রয়েছে শতশত ভবন। এসব উচুঁ ভবন থেকে যে কোনো সময়ই ঢিল ছোড়ার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
পুলিশ বলছে, এমআরটি পুলিশ স্টেশনকেন্দ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। মেট্রোরেল এলাকায় কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে তারা সংশ্লিষ্ট থানায় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করবে। আর আশপাশের ভবন থেকে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে, সেজন্য ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট থানা ও ঢাকা মহানগর পুলিশ।
মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেট্রোরেলের কিছু হলে দায় দায়িত্ব ভবন মালিককেই নিতে হবে। সেজন্য বাড়ির মালিককে বলা হবে বাড়ির প্রধান ফটক ও ছাদে ওঠার সিঁড়িতে ক্যামেরা লাগাতে।”
“প্রতিটা ভবনে তো আর পুলিশ দেওয়া যাবে না; জনগণকেই উপলব্ধি করতে হবে, মেট্রোরেল জাতীয় সম্পদ, এর দেখভাল জনগণকেই করতে হবে।”
পল্লবী থানার ওসি মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, “এমআরটি পুলিশ গঠিত হলেও মেট্রোরেলের দুই পাশের ভবন থেকে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটা থানা পুলিশকেই দেখভাল করতে হবে।”
আর এজন্য ভবন মালিকদের সচেতন করা হচ্ছে বলে জানান দুই ওসি।
মুসকিল আসান শব্দ নিরোধক দেয়ালে?
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ওয়েবসাইটে মেট্রোরেলের ‘শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য শব্দ নিরোধক দেয়াল’ স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে।
এই নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়াল চলার সময় মেট্রোরেলের শব্দ ও কম্পন কমায়। এই ব্যারিয়ারের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বায়তুল মোকাররমের মত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে শব্দদূষণের মাত্রা কমে আসবে। নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়ালের টেকনোলজি শব্দ কমাতে সহায়তা করবে বলে মেট্রোরেলের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মানুষের কাছে এটা বিরক্তির কারণ হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, নয়েজ ব্যারিয়ার বসানো হলে আরেকটি কাজ হবে, বাইরে থেকে ছোড়া ঢিল ট্রেন পর্যন্ত পৌঁছাবে না।
“মেট্রোরেলে পথের দুই পাশে নয়েজ ব্যারিয়ার দিতে হয়; যা এখনও দেওয়া হয়নি। জাপানি কনসালটেন্ট থাকা অবস্থায় এই ধরনের কমপ্রোমাইজড উন্নয়ন কীভাবে হয়! আমরা না জানতে পারি, কিন্তু জাপানিরা জানে যে নয়েজ ব্যারিয়ার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা শুধু বাইরের ঢিল বা অন্যকিছু থেকে রক্ষা করার জন্যই নয়, এই যাত্রাপথে অনেক হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পড়বে।”
এখনও নয়েজ ব্যারিয়ার দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক শামসুল হক।
মেট্রোরেলে ঢিল ছোড়া উদ্দেশ্যপ্রণিত মন্তব্য করে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, এজন্য কঠোর শাস্তির নজির স্থাপন করতে হবে।
“যারা ঢিল ছুড়েছে, আমি বলব ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। দুই একটা যদি উদাহরণ টেনে শাস্তি দেওয়া হয়, আরেকটু প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়, তাহলে আমার ধারণা এটা থাকবে না।
“সম্পত্তি নষ্ট করার জন্য সরকার যে আইনটা তৈরি করেছে, তা অত্যন্ত কঠিন। তাই প্রথম দিকেই অপরাধী ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। কালচারটা এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে, এটা (ঢিল ছোড়া) করা যাবে না, করতে গেলেই বড় ঝামেলা হবে। সেই ধরনের ইমপ্রেশন তৈরি করতে হবে।”
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
মেট্রোরেল প্রকল্পের উপপ্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নয়েজ ব্যারিয়ার রয়েছে, তবে স্যার (শামসুল হক) যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, পুরোপুরি মেট্রোরেল ঢেকে ফেন্সিং- এটা সম্ভব নয়। উপরে বৈদ্যুতিক তার রয়েছে আর সেটা অনেক ব্যয়বহুল হবে।”
ঢিল ছোড়ার ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতে অধ্যাপক শামসুল হকের বক্তব্য সমর্থন করেন তিনিও।
“ঢিলের মত ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের কঠোর সাজা হলে আর কেউ সাহস পাবে না।”
মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা জাতীয় সম্পদ; এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সবার।