যাত্রী কল্যাণের দুর্ঘটনার হিসাব মানে না বিআরটিএ, তালিকা চেয়ে চিঠি

যাত্রী কল্যাণ সমিতির ওই তালিকাকে ‘কাল্পনিক’ বলছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2023, 09:41 AM
Updated : 4 May 2023, 09:41 AM

যাত্রী কল্যাণ সমিতি ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জনের মৃত্যুর যে তথ্য দিয়েছে, তা মানতে নারাজ সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ।

তাদের দাবি, ওই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৫৩টি, আর মৃত্যুর সংখ্যা ২৩৯টি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি ঈদে বাড়ি যাওয়া ও নগরে ফেরার সময়সীমা ১৫ দিন ধরলেও বিআরটিএ বলছে, ঈদযাত্রা সর্বোচ্চ হতে পারে ৯ দিন, এর বেশি নয়।

বিআরটিএ এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতিকে চিঠিও দিয়েছে। তাতে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও তালিকা চাওয়া হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত ১৭ এপ্রিল বিআরটিএতে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে কেবল গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি করা পরিসংখ্যান প্রকাশ না করে সরেজমিনে যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলেও জানানো হয় এই চিঠিতে।

সেখানে লেখা হয়, “সরেজমিনে যাচাই-বাছাই ছাড়া দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব না। প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য একেক রকম হওয়ায় তা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে।”

বিআরটিএর দাবি, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অনেক সময় ভুল হয়। কাজেই প্রতিবেদন তৈরির আগে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন যাচাই করা উচিত।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি অবশ্য বলছে, তারা যে তথ্য তুলে ধরেছে, সেটি কোনোভাবে বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। বরং সব দুর্ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ও মৃ্ত্যুর সংখ্যাটি আসলে আরও বেশি।

কী বলেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি

প্রতি বছর ঈদের পর বাড়ি যাওয়া ও ফেরার পথে দুর্ঘটনার সংখ্যা, প্রাণহানির তথ্য এবং দুর্ঘটনার ধরণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগঠনটি। বরাবরই সংবাদমাধ্যমে আসা দুর্ঘটনার খবর সঙ্কলিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। 

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গত ২ মে সংবাদ সম্মেলনে করে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, আর প্রাণহানি ২১ দশমিক ১ শতাংশ এবং আহত ৩৩ শতাংশ কম হয়েছে।

সমিতি হিসাব করে দেখেছে, ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে দেশে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৫৬৫ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪১টি, মৃত্যু হয় ৩৫৫ জন। আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২০ জনে।

এই সময়ে রেলপথে ২৭টি ঘটনায় ২২ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ১০টি দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত ও ২২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মত এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত, ১২০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪.৩ শতাংশ, নিহতের ৫১ শতাংশ এবং আহতের প্রায় ২১.৩ শতাংশ ।

যেসব বাহন দুর্ঘটনায় পড়েছে, তার ৩৬.৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬.৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ- কাভার্ডভ্যান, ৫.৬ শতাংশ কার মাইক্রোবাস ও জিপ, ৪.৬ শতাংশ নছিমন-করিমন ট্রাক্টর-লেগুনা মাহিন্দ্রা, ৬.৭ শতাংশ অটোরিকশা, ১২.৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, এবং ১৬.৯ শতাংশ বাস।

এসব দুর্ঘটনার ২৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭.২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২০.৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৬.৪ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা।

মোট দুর্ঘটনার ২৯.৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৭.২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৬.৬ শতাংশ ফিডার রোডে হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে হওয়া মোট দুর্ঘটনার ৬.৬ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমার পাশাপাশি এবার ঈদে বাড়ি ফেরা কমেছে বলেও ধারণা করছে সমিতি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায়, অতিরিক্ত গরমসহ নানা কারণে” এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম মানুষ ঈদে যাতায়াত করেছে।

কেন মানছে না বিআরটিএ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে নিহত এবং আহত যাত্রীর সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে ‘অতিরিক্ত’ দেখানো হয়েছে। এ কারণে ওই প্রতিবেদন অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

যাত্রী কল্যাণ সমিতিকে দেওয়া এক চিঠিতে সরকারি সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আবদুল আউয়াল লিখেছেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২২জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা ‘বাস্তবসম্মত নয়’।

সরকারি সংস্থাটির দাবি, ১৫ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ২৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩৯ জন নিহত ৫১০ জন আহত হয়েছে। কিন্তু যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে ৫১টি দুর্ঘটনা, ৮৯ জন নিহত এবং আহত ৫৫ জন বেশি দেখানো হয়েছে।

Also Read: ঈদের পথে এবার দুর্ঘটনা ১৮.২%, মৃত্যু ২১.১% কমেছে: যাত্রী কল্যাণ সমিতি

এই পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় ও যাচাই বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘এটাই সঠিক’।

অবশ্য বিআরটিএ ঈদযাত্রাকে ১৫ দিন মানতে নারাজ। তাদের চিঠিতে বলা হয়, “ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি ছিল ১৯ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত। বিআরটিএর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা ছিল ১৭ থেকে ২৫ এপ্রিল, পর্যন্ত। এ কারণে ঈদযাত্রাকে সর্বোচ্চ ১৭ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত নয়দিন বিবেচনা করা যায়।”

কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসেবে অনুযায়ী এই ৯ দিনে সড়কে ১৪২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৬ জন নিহত এবং ২৫৮ জন আহত হয়েছে বলেও জানানো হয় চিঠিতে।

গণমাধ্যমে অনেক সময় ভুল তথ্য আসে: বিআরটিএ চেয়ারম্যান

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের সংস্থার কর্মীরা ৬৪টি জেলা থেকে তথ্য পাঠায়। পুলিশ, জেলা প্রশাসন থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এজন্য হতাহতের এই সংখ্যার পার্থক্য ‘এত হওয়ার কথা নয়’।

তিনি বলেন, “তাদের (যাত্রী কল্যাণ সমিতি) ওই তালিকা কাল্পনিক। মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমেও হতাহতের সংখ্যা ভুল আসে।

“তারা গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিক ঠিক আছে, কিন্তু সেটা যাচাই করে নিলে তো সমস্যা নাই। তারা কয়েকজন লোক নিয়োগ করুক তথ্য নেওয়ার জন্য, তাহলেই হয়। আমরা মনে করি যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বিভ্রান্তিকর।”

দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ‘প্রকৃত সংখ্যা’ আরও বেশি: মোজাম্মেল

বিআরটিএর এই চিঠির প্রতিক্রিয়ায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার যে তথ্য এসেছে তা সঠিক। দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, চিত্রও আরও ভয়াবহ। বিআরটিএ দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করতে দিতে চায় না।”

বিআরটিএ এর চিঠির ভাষা ‘মাস্তানি মনে হচ্ছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দুর্ঘটনা তো আমি ঘটাই না, গণমাধ্যমে যে তথ্য আসে তা আমরা জড়ো করে প্রতিবেদন তৈরি করি। কিন্তু সব দুর্ঘটনার খবরও তো গণমাধ্যমে আসে না। বাস্তব অবস্থা তো আরও খারাপ। আসলে তারা সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কোনো পরিকল্পনা নাই, মেকানিজম নাই, দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

“দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ হলে তাদের উপর দেশি-বিদেশি চাপ আসে। তথ্য প্রকাশ করায় তারা যে বিরক্ত হচ্ছে এই চিঠি তারই বহিঃপ্রকাশ। এর আগেও আমাদের কাছ থেকে ৫-৭টি প্রতিবেদন নিয়েছে, কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।”