“মধুর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বই যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসার কারণ হয়ে উঠেছিল এসব কিছুই শত্রুদের বোধগম্যতায় আসেনি।”
Published : 24 Mar 2024, 11:02 PM
তিনি শিক্ষক নন, গবেষক নন, শিল্পীও নন, সাধারণ একজন চায়ের দোকানদার। তারপরও তিনি কীভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা পেতে পারেন?
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাষায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সেই সাধারণ চায়ের দোকানির যে অবদান, সেই জায়গায় তিনি ব্যতিক্রম, তিনি মধুসূদন দে, মধুর ক্যান্টিনের মধুদা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্ররা ছিলেন সামনের সারিতে। সেসব ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মধুর ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনের পরিচালক মধুদা ছিলেন সেইসব আন্দোলনকর্মী আর বহু তরুণ বুদ্ধিজীবীর নীরব পৃষ্ঠপোষক।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাজুড়ে তাণ্ডব চালানোর পর ২৬ মার্চ সকালে বাসা থেকে তুলে নিয়ে মধুসূদনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা করা হয় তার স্ত্রী, এক কন্যা, এক পুত্র ও পুত্রবধূকেও।
৫৩ বছর পর মধুদাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ পর্যন্ত যে ৫৬০ জনকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মধুসূদন দে একজন।
সরকারি গেজেটে বলা হয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম মধুসূদন দে (মধু’দা); পিতা-মাতা: আদিত্য চন্দ্র দে ও যোগমায়া দে; অবদান সমাজসেবা; ঠিকানা: রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মধুদা স্মারক গ্রন্থে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাও চলত মধুর ক্যান্টিনে। সংস্কৃতি সংসদ এবং নাট্যকেন্দ্রের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর শুরুটা হয়েছিল মূলত ৫০ এর দশকের প্রথমার্ধে, ছাত্রদের চায়ের কাপের আড্ডায়।
শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আতিকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং জহির রায়হানের মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
মধুর ক্যান্টিন এখন চালান মধুসূদন দের ছেলে অরুণ কুমার দে। বাবার শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদাপ্রাপ্তির খবর তার জন্য ‘অন্যরকম আনন্দের’ উপলক্ষ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অরুণ বলেন, “আজ আমার খুব খুশি লাগছে। আমার বাবাকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ বের হয়েছে অনেক আগে, তার অবদানের কথা স্মরণ রেখেছে সবাই। ৫২/৫৩ বছর পর আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন সম্মান দেওয়া হয়েছে জেনে আমার মন জুড়িয়ে গেল।”
মধুদার অবদানকে সম্মান দিয়ে তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রাখায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তার ছেলে।
‘একমাত্র ব্যতিক্রম’
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তবে বিজয়ের প্রাক্কালে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। আর এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছিল দেশীয় দোসররা।
ডিসেম্বরের মধ্যভাগে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় যখন অনিবার্য; তখন এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের; এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেওয়া।
শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
প্রায় অর্ধ শতক পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। রোববার চতুর্থ ধাপে ১১৮ জন বুদ্ধিজীবির তালিকা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। এ নিয়ে মোট ৫৬০ জনকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হল।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকায় সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, আইনজীবী, লেখক, চাকরিজীবী, প্রকৌশলী, নাট্যকার, সাংবাদিক, সংগীত শিল্পী এবং সংস্কৃতিকর্মীরা রয়েছেন। ব্যতিক্রম কেবল মধুদা।
এই তালিকা করা আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ২০২১ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।
সেখানে বলা হয়, যে সকল সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
সেই সংজ্ঞায় না পড়লেও মধুদাকে কেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দেওয়া হল, তা ব্যাখ্যা করে মোজাম্মেল হক বলেন, “বিশেষ বিবেচনায়…। উনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন; শিক্ষকও না, গবেষকও না, শিল্পীও না। উনি এমন এক ব্যক্তি, সবাই তাকে চেনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনসহ যত আন্দোলন হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, সেই রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, যেখানে উনার যে অনন্য ভূমিকা ছিল, সেই হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে।”
মন্ত্রী বলেন, “মুধদা সিম্পলি একজন চায়ের দোকানদার। বলতে পারেন উনি কীভাবে বুদ্ধিজীবী হয়? বাট উনার যে কন্ট্রিবিউশন, সেই ২৩ বছরে যত নেতারা যত কর্মীরা দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের সহযোগিতা করেছেন, উদ্ধুদ্ধ করেছেন। বিনা পয়সায় চা খাইয়েছেন। এই কারণে একটা একসেপশন। আমরা মধুদা ছাড়া কোনো ব্যক্তিক্রম করি নাই।”
দায় শোধ
শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রণয়ণে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য শাহরিয়ার কবির বলছেন, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অবদান এবং সে কারণে শহীদ হয়েছেন, যারা, মূলত তাদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
“তবে ১৯৭১ সালে এ ধরনের অবদান শুধু শিক্ষক, গবেষকরাই রেখেছিলেন– তা নয়; নানা শ্রেণিপেশার লোকজন নিজেদের নানাভাবে যুক্ত করেছিলেন। কেবল রাজধানীতে নয়, সারাদেশে অবদান রেখেছেন তাদের সংখ্যা অনেক।”
শাহরিয়ার কবির বলেন, “আমরা নানা মাধ্যমে তাদের অবদানের কথা অনুসন্ধান করে তালিকাভুক্ত করছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ… নানা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মধুদা সেসময় শুধু ব্যবসায়ী ছিলেন না, তিনি নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। বিনে পয়সায় মুক্তিযোদ্ধাসহ আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করেছেন। মধুদার মত অনেককে তাদের ভূমিকার জন্য টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে।”
এ গবেষক বলেন, “মধুদাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় যুক্ত করে ৫২/৫৩ বছর পর কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হয়েছে দেশ। মধুদাসহ শহীদদের পরিবারের খবর কেউ রাখেনি। এখন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় যারা স্থান পাচ্ছেন, তার কোনো অর্থমূল্য নেই; কিন্তু সম্মানটুকু দেওয়া হচ্ছে। মধুদার মত রাজধানীর বাইরে অনেকে অবদান রেখেছেন; যারা মুক্তিযুদ্ধের জমিনটাই তৈরি করেছিলেন। বিশেষ শ্রেণি পেশার বুদ্ধিজীবীর বাইরেও অন্যদের ভূমিকা আমরা ভুলব না।”
এই সিদ্ধান্তের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। মধুদা বুদ্ধিজীবীদের সেবা করেছেন। মধুদা আমাদের বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রধান চরিত্র। তার ক্যান্টিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান বয়সী।
“প্রথমে আমতলায় ছিল, তারপর ১৯৬৫ তে যখন নতুন কলাভবন তৈরি হলে তিনি বর্তমান ক্যান্টিনের জায়গায় চলে আসেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের যত সভা হত, সব ওখানে হত। অনেকেই তার ক্যান্টিনে বাকিতে খেতেন। অনেকে তার টাকা শোধ করতে পারেনি। মধুদা অকাতরে সবাইকে দিয়ে গেছেন। তিনি চেয়েছেন, দেশটা যেন মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়।”
একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, “মধু দাকে স্মরণ করব আমরা ২৫ মার্চের রাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন থাকবে, ততদিন মধুদার নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আজকের ছাত্রনেতারাও।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক আগেই তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এখন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, তার প্রতি আমাদের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হল। যে অঙ্গীকার সামনে রেখে তিনি ছাত্র আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছেন, সেটা জাগ্রত রাখা বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে আমি মনে করি।”
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মধুদাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের এবং গর্বের। এটা আরও আগে দেওয়া দরকার ছিল।”
মধুর ক্যান্টিন পরিক্রমা
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এ এলাকায় খাবারের ব্যবসা করতেন আদিত্য চন্দ্র দে। তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে ছেলে মধুসূদন দের ওপর পরিবার চালানোর ভার পড়ে।
১৯৩৯ সালে মারা যান মধুসূদনের বাবা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছোট ইটের তৈরি একটি ভবন মধুসূদনকে দেন ক্যান্টিনের কাজ চালানোর জন্য।
সবার কাছে পরিচিত মধুদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিন চালাতেন। তার ফাঁকেই নানা খবরাখবর আদান-প্রদান করতেন স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের মধ্যে। মুক্তিকামী বাঙালি ছাত্র-যুবাদের প্রতি তার সহযোগিতার হাত ছিল প্রসারিত। কালের পরিক্রমায় সেই ক্যন্টিন হয়ে ওঠে মধুর ক্যান্টিন।
যেভাবে হত্যা করা হয় মধুদাকে
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে নির্বিচারে গুলি চালায়। পরদিন সকালে হলের সামনেই শিববাড়ি আবাসিক এলাকায় মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দের বাসায় হানা দেয় তারা।
মধুসূদন দের ছেলে, মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান পারিচালক অরুণ দে তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার সামনেই তার বাবা মধুসূদন দে, মা যোগমায়া দে, বড়ভাই রনজিত কুমার দে ও বৌদি রীনা রাণী দেকে হত্যা করা হয়।
সেই ঘটনা স্মরণ করে অরুণ দে বলেন, “প্রথমে গুলির শব্দ, পরে বোমা ও ট্যাংকের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমরা জেগে ছিলাম সারা রাত। বারন্দায় দাঁড়িয়ে শুধু গুলির শব্দ আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনতে পাই। পরদিন সকালে বাবাকে খুঁজতে আমাদের বাসায় এসে প্রথমে আমার বৌদিকে গুলি করে। পরে বড় ভাইকে হত্যা করে তারা। আমার বোন রানুর মুখে ও বুকে গুলি লাগে।”
মধুসূদন দেকে পাকিস্তানি সেনারা নিয়ে যাওয়ার সময় তার মা বাধা দেন, তখন তাকেও হত্যা করা হয়।
“খান সেনারা গুলি চালালে মার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে দেহের বিভিন্ন স্থানের মাংস ছিটকে দেয়ালে লেগে থাকে। তখন বাবার পায়েও দুটো গুলি লাগে, তিনি সেখানে বসে পড়েন। মায়ের মাথা তখন বাবার কোলে। এরপর খান সেনারা চলে যায়।”
পরে পাক সেনারা হলের কর্মচারী শ্যামলাল ও মোহন রায়কে সঙ্গে নিয়ে এসে মধুসূদন দেকে ধরে নিয়ে যায় বলে জানান অরুণ দে।
“আমার হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি রক্তে ভিজে গেছে, ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পানির তেষ্টায় পাশের বাসার রান্নাঘরে পানি খেতে যাই, সেখান থেকে দেখি ওরা বাবাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক জিসি দেবকেও ওই মাঠে আনছে তার বাংলো থেকে।”
অরুণ বলেন, “যুদ্ধের পরে শ্যামলাল ও মোহন রায়ের সঙ্গে দেখা হলে বাবার কথা জানতে চেয়েছিলাম। তারা জানায়, ওইদিন পাক সেনারা গুলি করে বাবাকে হত্যা করে।”
মধুদা স্মৃতি সংসদ প্রকাশনী’র উদ্যোগে প্রকাশিত ‘মধুদা: শহীদ মধু সূদন দে স্মারক গ্রন্থ’ এর ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লেখেন, “একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুর ভালবাসা আর অন্যদিকে মধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা- এসব কিছু পাকিস্তানিদের কাছে মধুকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল। ব্যবসায়িক লেনদেনের মাঝে এত চমৎকার স্নেহ আর সম্প্রীতির সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠতে পারে? এখানে অবশ্যই সন্দেহজনক কিছু চলছে। মধুর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বই যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসার কারণ হয়ে উঠেছিল এসব কিছুই শত্রুদের বোধগম্যতায় আসেনি।”
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ এবং ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির কার্যক্রমের সকল পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি এই মধুর ক্যান্টিনে বসেই নেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর চোখে পড়ে যান মধু। তাদের আক্রমণে বহুবার মধুর ক্যান্টিনে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।
এখন মধুর ক্যানটিনের সামনে রয়েছে মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য। সেখানে লেখা: জন্ম ১৯১৯ সালের এপ্রিলে, শহীদ হন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ।
১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমদ ভাস্কর্যটি প্রথম উদ্বোধন করেন। পরে ২০০১ সালের ২৭ মার্চ ভাস্কর্যটির পুনর্নির্মাণ করে উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী। এর ভাস্কর তৌফিক হোসেন খান।
পুরবো খবর-
চতুর্থ দফায় আরও ১১৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ