মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা মদুসূদন দে, মা আর দাদা-বৌদিকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেন বাবুল চন্দ্র দে। ২৬ মার্চের সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি আজো তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
Published : 26 Mar 2013, 11:36 AM
জীবন ভয়ে সেদিন পালিয়ে গেলেও নিয়ম করেই বাবুল চন্দ্র প্রতিবছর ছুটে যান জগন্নাথ হলের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে।
জানালেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর সকালে হলের সামনেই অবস্থিত তাদের (মধুসূদন দে) বাসায় হানা দেয়।
সবার কাছে পরিচিত মধু দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিন চালাতেন। তার ফাঁকেই নানা খবরাখবর আদান-প্রদান করতেন স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের মধ্যে। মুক্তিকামী বাঙালি ছাত্র-যুবাদের প্রতি তার সহযোগিতার হাত ছিল সম্প্রসারিত। আর তাতেই মধুসূদনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পাকিস্তান সরকার।
হানাদার বাহিনীর হাতে স্ত্রী যোগমায়া দে, ছেলে রনজিত কুমার দে ও তার স্ত্রী রীনা রাণী দের সঙ্গে শহীদ হন মধুসূদন, যিনি পরিচিত হয়ে আছেন মধু দা নামে। তার নামে করা মধুর ক্যান্টিন জড়িত হয়ে আছে দেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে।
২৫ মার্চের গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে সোমবার রাত সাড়ে ১০টার পর শহীদ মিনার থেকে আসা শত শত মোমবাতি আলো ছড়াতে শুরু করে জগন্নাথ হলের গণকবরে। বাতাসে মোমবাতির আলো নিভলে সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাতে আলো জ্বালাতে দেখা যায় একজনকে। বারবার মোমবাতি জ্বালিয়ে পুরো এলাকা আলোকিত করে রাখছিলেন তিনি, সেই ব্যক্তিই বাবুল চন্দ্র দে।
অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘুরে ঘুরে আগরবাতিও জ্বালাতে দেখা যায় তাকে। গণকবরের রেলিং ধরে মাঝে মাঝেই তিনি থমকে যাচ্ছিলেন। এরই এক পর্যায়ে শিশু বয়সে দেখা মানবতার বিরুদ্ধে চরমতম নৃশংসতার কথা বলছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
বাবুল চন্দ্র বলেন, “তখন আমাদের বাসা ছিল শিববাড়িতে। শিববাড়ি ও জগন্নাথ হলের মাঝের সীমানা প্রাচীরটিও তখন ছিল না। পাকিস্তানি সেনারা সারা রাত হলের মানুষকে মাঠে এনে এনে মেরে ফেলছিল। বাসায় বসে আমরা সব কিছুই দেখছিলাম।”
সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের ভবনে হানা দেয়।
“তারা আমার দাদা-বৌদিকে হত্যা করে। বাবাকে গুলি করতে গেলে মা সামনে এসে আগলে দাঁড়ায়। তখন গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মাকে হত্যা করা হয়। বাবাকে গুলি করে তারা চলে যায়।
“গুলি লাগলেও বাবার কিছুক্ষণ প্রাণ ছিল। পরে এক বিহারী পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেয় যে, বাবা জীবিত আছে। তখন তারা আবারো বাসায় এসে বাবাকে এই জগন্নাথ হলে নিয়ে আসে। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম, তারা বাবাকে এখানে এনে মেরে ফেললো।”
বাবুল চন্দ্র জানান, ওই সময় তার বোন রানু দে আহত হন। পরে ওই ক্ষতেই তার মৃত্যু হয়।
তিনি বলেন, “২৭ মার্চ ভোরে আমরা আহত বোন রানুকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসতাপালে যাই। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা আসছে শুনে আহত বোনকে রেখেই আমরা এক চাচার সঙ্গে সাভার চলে যাই। ১০-১২দিন পর সেখান থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই আমরা।”
এরপর কুমিল্লা হয়ে আগরতলা যান জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে বাবা-মায়ের লাশের কোনো খবর পাইনি। সম্ভবত জগন্নাথ হলের এই গণকবরেই শুয়ে আছেন তারা।”
অশ্রুসজল বাবুল বলেন, “আমার ছোট মনের সেদিনের সব স্মৃতি আজো জ্বলজ্বল করছে। কোনোভাবে তা আমি ভুলতে পারি না। প্রতিবছর এই রাতে আমি এখানে আসি। মা-বাবাসহ সেদিন আত্মত্যাগী অন্যদের স্মরণ করি।”