বাছাইতে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা আপিল করতে পারবেন মঙ্গলবার থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
Published : 04 Dec 2023, 11:29 PM
ঋণ খেলাপি হওয়ায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থিতা থেকে ছিটকে পড়েলেন অনেকেই; যাদের মধ্যে আলোচিত রাজনীতিক, বর্তমান সংসদ সদস্য, সঙ্গীতশিল্পীও রয়েছেন। কয়েকজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে নিজে খেলাপি নন; কিন্তু জামিনদার হয়েছিলেন খেলাপি হওয়া ঋণের।
বাছাই বাতিলের তালিকায় নাম ওঠায় তাদের কেউ কেউ তড়িঘড়ি করে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য চেষ্টা-তদবিরও শুরু করেছেন। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, ন্যূনতম অর্থের চেয়েও কম টাকা জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করছেন না তারা। যারা সব শর্ত পূরণ করতে পারছেন, কেবল তাদের ঋণই নিয়মিত করা হচ্ছে।
সোমবার মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিন খেলাপি ঋণের কারণে যারা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব, ব্যবসায়ী অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল মান্নান, যুগ্ম-মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী, নোয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণ, কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদ, লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল, সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী।
তারা রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন মঙ্গলবার থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ইসির পরিপত্র অনুযায়ী, কমিশনকে সম্বোধন করে ইসি সচিবের কাছে স্মারকলিপি আকারে আপিল দায়ের করতে হবে। মনোনয়নপত্র গ্রহণ বা বাতিলের তারিখ; আপিলের কারণ সম্বলিত বিবৃতি এবং বাতিল বা গ্রহণ আদেশের সত্যায়িত কপি সংযোজন করতে হবে।
আপিল দায়েরের সময় শেষ হওয়ার ছয় দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবে ইসি। সেই হিসেবে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সব আপিল নিষ্পত্তি হবে।
কেন বাদ
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ১২ অনুচ্ছেদের ধারা-১ অনুযায়ী, ‘‘কোনো ব্যক্তি কৃষি কাজের জন্য গৃহীত ক্ষুদ্র কৃষি ঋণ ব্যতীত, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখের পূর্বে কোনো ব্যাংক হইতে গৃহীত কোনো ঋণ বা ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধে খেলাপি হইয়া থাকিলে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হইবেন।’’
একই অনুচ্ছেদের ধারা-১ এর উপ-ধারা(এম) অনুযায়ী, “কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো কোম্পানির পরিচালক বা ফার্মের অংশীদার হন যা কোনো ব্যাংক হইতে গৃহীত কোনো ঋণ বা ঋণের কোনো কিস্তি তাহার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখের পূর্বে পরিশোধে খেলাপি হইলে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হইবেন।’’
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর প্রার্থীর তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়; সিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থীরা ঋণ বা বিল খেলাপি কি না, তাদের দেওয়া আর্থিক তথ্যে অসঙ্গতি আছে কি না- তা যাচাই করা হয়েছে। যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিধানগুলো দেখে প্রার্থিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
কাটা পড়লেন যারা
আব্দুল মান্নান: ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান থাকাকালেই ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে বিকল্পধারার মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে। কয়েক হাজার কোটি টাকার সেসব কেলেঙ্কারির খবরের পর পরিচালক পদ হারনো মান্নান এখনও ঋণ খেলাপি। যে কারণে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন লক্ষীপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা সুরাইয়া জাহান।
লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান একই আসন থেকে ভোট করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
যাচাই-বাছাই শেষে সুরাইয়া জাহান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী আব্দুল মান্নান ঋণ খেলাপি।
মাহি বি চৌধুরী: মুন্সীগঞ্জ-১ (শ্রীনগর-সিরাজদিখান) আসনে প্রার্থী হতে চাওয়া বিকল্পধারার যুগ্ম-মহাসচিব মাহি বি চৌধুরীরর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রির্টানিং কর্মকর্তা আবুজাফর রিপন।
তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘খেলাপি হওয়া ঋণের জামিনদার থাকায় মাহি বি চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।’’
ডলি সায়ন্তনী: এনসিসি ব্যাংক থেকে নেওয়া ক্রেডিট কার্ডে খেলাপি হওয়ায় প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে পাবনা-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনীর।
রোববার সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করে বলেন, “ডলি সায়ন্তনীর ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত খেলাপি ঋণের কারণে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। ’’
পরে ডলি সায়ন্তনী বলেন, “ক্রেডিট কার্ডের বিষয়টি আমার খেয়াল ছিল না। বিষয়টি আমি দ্রুত সমাধান করে আপিল করব।”
একই অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের (আড়াইহাজার) স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফুল ইসলামের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। ব্যাংক প্রতিনিধি আপত্তি করায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহমুদুল হক।
সালাহউদ্দিন: কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর বাতিল করা হয়েছে।
কক্সবাজারের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তালিকায় গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত খেলাপি থাকায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ‘ফিস প্রিজারভারস’ নামের একটি কোম্পানি জনতা ব্যাংক থেকে ৪৭ কোটি টাকার ঋণ এখন খেলাপি হয়েছে। এ কোম্পানির পরিচালক থাকা অবস্থায় ঋণটির জামানতকারী (গ্যারান্টার) ছিলেন তিনি। জামিনদার হিসেবে তিনিও খেলাপির তালিকায় আছেন।
নৌকার প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন। আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।
এম এ আউয়াল: ঋণখেলাপির অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের মনোনয়নপত্র স্থগিত রেখেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এবার তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
মামুনুর রশিদ কিরণ: খেলাপি হওয়ার কারণে নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তালিকায় ঋণ খেলাপি হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
আইয়ুব হোসেন: মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁর সাপাহার শাখা থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আইয়ুব হোসেন। তিনি ওই উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
ব্যাংকরে শাখাপ্রধান মিলন কুমার সরকার জানান, ২০১১ সালে আইয়ুব ১৬ লাখ টাকা নিলেও শোধ না করায় সুদ-আসলে তা ৫১ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। তিনি দুই লাখ টাকা জমার বিপরীতে ঋণ নিয়মিত করার দাবি তুললেও রাজি হয়নি ব্যাংক।
আরও বাদ যারা
পটুয়াখালী-১ (পটুয়াখালী সদর, দুমকি, মির্জাগঞ্জ) আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী নাসির উদ্দীন তালুকদার এবং জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাবুলের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে খেলাপি হওয়ার কারণে।
নাটোর-১ আসনে ঋণ খেলাপির জন্য জাসদের (ইনু) মোয়াজ্জেম হোসেনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
মানিকগঞ্জ-১ ও ৩ আসনের লাঙ্গলের প্রার্থী জহিরুল আলম, মানিকগঞ্জ-১ আসনে বিএনএমের মোনায়েম খান, মানিকগঞ্জ-২ আসনে লাঙ্গলের প্রতীকের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আব্দুল মান্নানের মনোনয়নও বাতিল হয়েছে একই কারণে।
সতর্ক ব্যাংক
সাধারণত বছরের শেষ ভাগে খেলাপি হওয়া ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিলে তোড়জোড় থাকে ব্যাংকের। ঋণ নিয়মিত করতে পারলে ব্যাংকের কাছে যেমন নগদ কিছু অর্থ আসে, তেমনি খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখার অর্থও বেঁচে যায়; তাতে মুনাফা বাড়ে ব্যাংকের।
এবার নির্বাচন যোগ হওয়ায় সেই প্রচেষ্টায় গতি এসেছে। তারপরও পুরো শর্ত না মানায় বেশিরভাগ ব্যাংকই খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করতে রাজি হচ্ছে না।
ভোটের কারণে এবার বেশি সতর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব শর্ত পূরণ না করায় অনেক খেলাপির ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়নি। আমরা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি করছি। কোনো ধরনের চাপ ও তদবিরকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। খেলাপি হওয়ার পর টাকা দিয়েই নিয়মিত করতে হবে ঋণ।
‘‘গত কয়েক মাস থেকে কিছু খেলাপি গ্রাহক ঋণ নিয়মিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা রাজি হইনি শর্ত না মানায়। এখনও আবেদন আসছে-কিন্তু আমরা স্ট্রিক্ট (কঠোর) অবস্থানে আছি আদায়ে।’’
খেলাপিদের মধ্যে একজন নির্বাচনে অংশ নিতে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে (এমিটিবি) গিয়েছিলেন মাস তিনেক আগে। কিন্তু ব্যাংক শর্ত পূরণে কঠোর হওয়ায় ঋণটি নিয়মিত করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি ওই খেলাপি গ্রাহক।
এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আমরা খুব সতর্কতা অবলম্বন করছি। ব্যবসায়িক কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের বিষয়ে ব্যাংক ইতিবাচক হলেও সবার জন্য না।’’
সৈয়দ মাহবুবুর বলেন, “সব শর্ত পূরণ করতে পারলেই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি খেলাপি হন, তাহলে কিভাবে জনসেবা করবেন? ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনুরোধ আসলেও আমরা তা উপেক্ষা করছি।’’
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল লোকাল শাখার ব্যবস্থাপক রেজউল করিম বলেন, “‘খেলাপিদের বিষয়ে তথ্য প্রধান কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে কারও খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়নি।’’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
গত জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ৭২ হাজার ৭১২টি। এসব মামলায় আটকা আছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।