‘দুর্গতিনাশিনী’র বন্দনায় বিপুল আয়োজনে যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল চার দিন আগে ষষ্ঠীর সকালে, দশমী তিথিতে মহাসমারোহে তাকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হতে যাচ্ছে সে আয়োজনের।
বুধবার বিদায় বেলায় বিহিত পূজা, আরাধনা আর সধবা নারীর সিঁদুর খেলার আচারে মুখরিত প্রতিটি মণ্ডপ।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ‘পিতৃগৃহ’ থেকে পুত্র-কন্যা নিয়ে দুর্গা ফিরে যাবেন কৈলাসে তার ‘স্বামীর’ ঘরে। এক বছর পর নতুন শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে।
তাই দশমীর দিন সকাল থেকে 'আসছে বছর আবার হবে' ধ্বনিতে তোলপাড় পূজা প্রাঙ্গণ, সেই সঙ্গে নানা আচারে চলছে দেবী বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা।
পূজা শুরুর পর দুদিন আকাশে মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেলা চললেও, দশমীতে আকাশের গায়ে পুরোপুরি শারদীয় সাজ। তাই মন্দিরগুলোও শেষ দিনের ভিড়ে জমজমাট।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তপন ভট্টাচার্য বলেন, পঞ্জিকা মতে সকাল ৯টা ১১ মিনিটের মধ্যে দশমীর বিহিত পূজা এবং দর্পণ বিসর্জনে শেষ হয় দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন। পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। এরপর পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হয়।
দর্পণ বিসর্জনের সময় প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে তাতে দেবীকে দেখে তার কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নেন ভক্তরা। মূলত এ আচারকেই দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন বলে। এছাড়া মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রতিমা থেকে ঘটে এবং ঘট থেকে আবার ভক্তের হৃদয়ে ‘মাকে’ নিয়ে আসাও বিসর্জনের আচার।
কোভিড মহামারীতে গত দুই বছরে নিয়মের ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিল দুর্গাপূজার আচার পালনের আনুষ্ঠানিকতা। সংক্ষিপ্ত আয়োজনে হয়নি সিঁদুর খেলা আর বিসর্জনের শোভাযাত্রা। এবার সেই রঙিন আয়োজনে মেতে উঠেছেন ভক্তরা।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দর্পণ বিসর্জনের পর মণ্ডপে চলে ‘মাকে’ বরণ। শ্বশুরালয়ে ফেরার আগে অন্নপূর্ণাকে পান, সুপারি মিষ্টি আর দুর্বা দিয়ে বরণ করে নেন নারী পূণ্যার্থীরা। এর মধ্য দিয়ে জরা কাটিয়ে পৃথিবী যেন শস্য শ্যামল হয়ে ওঠে, সেই প্রার্থনা করা হয়। বাজে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি।
আর দুর্গার চরণে সিঁদুর দিয়ে সেই সিঁদুর এক নারী পরিয়ে দেন আরেকজনের কপালে। বিবাহিত নারী স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সংসারের সুখ শান্তি কামনায় এবং অবিবাহিতরা ভালো স্বামী পাওয়ার আশায় এই সিঁদুর বিনিময় করেন।
তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অল্প বয়সী মেয়েরাও একে অপরের গালে কপালে সিঁদুর লাগিয়ে মাতে ‘সিঁদুর খেলায়।“
দুর্গাকে বিদায় জানাতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসা সদ্য বিবাহিত দম্পতি স্বপন মজুমদার ও প্রিয়াংকা নাথ জানালেন বিয়ের পর এটাই তাদের প্রথম দুর্গাপূজা।
স্বপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবার পূজা আমাদের কাছে একটু ভিন্ন রকম আনন্দের। গত কয়েকটা দিন বেশ আনন্দে কাটিয়েছি।“
আনন্দের সাথে বিসর্জনের বিদায় রাগেও সিক্ত ভক্তদের হৃদয়।
“দেবী বিসর্জনের ব্যথা তো আছেই, কিন্তু পরের বছর মা আবার আসবেন। সেই অপেক্ষায় থাকব,” বললেন প্রিয়াংকা।
বিকালে শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনি বাদ্যে দেবী বন্দনার গানে গানে হবে বিজয়ার শোভাযাত্রা। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে ভক্তরা যাবেন বুড়িগঙ্গার তীরে।
ঘাটে আসার পর ভক্তরা শেষবারের মত ধূপধুনো নিয়ে আরতি নাচবেন। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্যে নৌকা থেকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ‘মাতৃরূপী’ দেবীকে এক বছরের জন্য বিদায় জানাবেন ভক্তরা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত।
শাস্ত্র বলছে, মহাসপ্তমীর দিন রোববার হওয়ায় এবার দেবী দুর্গা এসেছেন হাতিতে।
শাস্ত্রমতে গজ দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। তাই দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে; পূর্ণ হয় ভক্তদের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্ত্যলোকের অধিবাসীরা। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ হয়।
বুধবার বিজয়া দশমীতে মা দুর্গা পুত্র-কন্যা সহ কৈলাশে ফিরবেন নৌকায় চেপে।
শাস্ত্রমতে, সপ্তমী বা দশমী বুধবার হলে দেবীর আসা বা যাওয়া হয় নৌকায়। তাতে প্রবল বন্যা ও খরা দেখা যায়। তবে নৌকায় মনোকামনা পূর্ণ হওয়াও সূচিত হয়; ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা।
আরও পড়ুন