দুর্গাপূজা: কলাবউ স্নান আর প্রকৃতির বন্দনা মহাসপ্তমীতে

নবপত্রিকায় দেবী দুর্গার বন্দনা আর মহামায়ার প্রকৃতি রূপের আরাধনায় চলছে সপ্তমী তিথির আয়োজন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2022, 02:43 PM
Updated : 2 Oct 2022, 02:43 PM

ষষ্ঠী তিথিতে মর্ত্যলোকে ঘুম ভেঙেছিল দুর্গার, প্রতিমায় চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে মহাসপ্তমীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ত্রিনয়নী দেবীর। 

রোববার সকাল থেকে মণ্ডপে-মন্দিরে দেবী দুর্গার বন্দনা হয়েছে নবপত্রিকায়, মহামায়ার প্রকৃতি রূপের আরাধনায় মহাসমারোহে চলছে সপ্তমী তিথির আয়োজন।

রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তপন ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সকাল ৭টায় নবপত্রিকায় প্রবেশ ও স্থাপনের মাধ্যমে সপ্তমী পূজা শুরু হয়। কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার পর কলাবউয়ের মহাস্নানের মাধ্যমে সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট পর্যন্ত সপ্তমী পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলে।

পুরোহিত বলেন, “দেবী দুর্গার চরণে ভক্তরা অঞ্জলি দিয়েছেন; দেবীর পদজলে উপবাস ভেঙে প্রার্থনা করেছেন। সপ্তমী পূজার মাধ্যমে সপ্ত ব্রহ্মাণ্ডের পাপসমূহ দূর হয়।”

নবপত্রিকা হল নয়টি উদ্ভিদের পাতা। এই নয়টি উদ্ভিদকে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একটি কলা গাছের সঙ্গে কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান গাছ শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বাঁধা হয়। তারপর লালপাড়ের সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে দেওয়া হয় বধূ রূপ।

তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।

নবপত্রিকার এই নয় পত্র হল রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর প্রতীক। এর সবাই দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। 

নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। দুর্গা প্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেখানে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে নানা উপাচারে দেবীকে স্নান করানো হয়।

হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, এসব ক্রিয়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণিজসম্পদ ও ভূমিসম্পদ রক্ষা ওপর আলোকপাত করা হয়।

শনিবার ষষ্ঠীতে বেলতলায় বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হয়। সন্ধ্যায় হয় দেবীর বোধন, অর্থাৎ ঘুম ভাঙিয়ে দেবীকে মর্ত্যে আসার আহ্বান জানানো হয়।

এবার সপ্তমী রোববার হওয়ায় রীতি অনুযায়ী দুর্গা এসেছেন গজে চড়ে। আর বুধবার দশমীতে কৈলাসে দেবালয়ে ফিরবেন নৌকায়।

সকল অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করতে সপ্তমী তিথিতে মন্দিরে মণ্ডপে ভিড় করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দুই ধরণের শক্তি আছে। একটা শুভ, আরেকটা অশুভ। শুভ শক্তির কাছে যেন অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটে, মা দুর্গার কাছে ভক্তরা সেটাই প্রার্থনা করছি।”

গত দুবছর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পূজার আয়োজনে ছিল সীমাবদ্ধতা। মন্দিরগুলোতে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। তবে এবছর দুর্গাপূজা আবার যেন প্রাণ ফিরে পেল। কোভিড বিধির কড়াকড়ি না থাকায় প্রাণখোলা আনন্দে মেতেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

রোববার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা কালীমন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম ঘুরে দেখা যায়, আগের দিনের তুলনায় মণ্ডপগুলোতে দর্শনার্থী বেড়েছে।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অঞ্জলি দিতে আসা পার্থ প্রীতম রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতবছর পূজার সময় বাসার অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। পূজাটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল আমাদের। এবার পূজায় মাকে নিয়ে সপ্তমীর অঞ্জলি দিয়েছি। দুর্গা মায়ের কাছে আমার মায়ের সুস্থতা কামনা করেছি।”

রমনা কালী মন্দিরে অঞ্জলি শেষে দেবপ্রিয়া সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটাই কম। বিধিনিষেধও তেমন নেই। তাই এবার বেশ আনন্দের সাথে পূজা উদযাপন করছি।

“মায়ের কাছে প্রার্থনা করি তিনি পৃথিবীর সকল অসুখ দূর করে দেন। আর গতবছরের ঘটনার কোন পুনরাবৃত্তি যেন এই বছর না হয়, সেটাই আশা করছি।”

পুষ্পাঞ্জলি শেষে এদিন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুস্থদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করা হয়। এতে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। এই সংখ্যা গতবছরের চেয়ে ৫০টি বেশি। ঢাকা মহানগরে এবার ২৪১টি পূজা হচ্ছে, যা গতবছরের চেয়ে ৬টি বেশি।

হিন্দু রীতি অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে বুধবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের দুর্গোৎসবের সমাপ্তি হবে। তারপরই এক বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী আবার ফিরে যাবেন কৈলাসের দেবালয়ে।