মহাসমারোহে সাজছেন ত্রিনয়নী

কিছু মণ্ডপে প্রতিমার রঙ আর সাজসজ্জার কাজটিই কেবল বাকি; শুক্রবার রাতের মধ্যে সেসব কাজও সারা হবে; শনিবার যে দেবীর বোধন!

মেহেরুন নাহার মেঘলানিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 10:54 AM
Updated : 30 Sept 2022, 10:54 AM

তিন দশক ধরে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জন্য দেবী দুর্গার প্রতিমা নিজ হাতে গড়েছেন সুকুমার পাল, এবার সেই কাজ শুরু করেছেন দুই মাস আগে; সময় একেবারে ঘনিয়ে আসায় রাতভর রঙের কাজ সেরেছেন, দুর্গা মাকে পোশাকের সাজসজ্জা আর অলঙ্কার পরিয়ে বাকি কাজ শেষ করবেন শুক্রবারের মধ্যেই।

ঢাকেশ্বরী মন্দির ছাড়াও ঢাকার বাইরে আরও তিনটি মন্দিরের জন্য প্রতিমা তৈরি করেছেন এ কারিগর। শেষ সময়ে এক সহকারীকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।

কাজ কতদূর, এ প্রশ্ন করতেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুকুমার বললেন, “রঙের কাজ শেষ হয়ে গেলে বাকি কাজ করতে বেশি সময় লাগবে না। আমরা দুইজন মিলে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। শুক্রবার রাতের মধ্যেই মণ্ডপের জন্য দেবীকে প্রস্তুত করে দিতে পারলে স্বস্তি।”

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকার পূজা মণ্ডপগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। জাঁকজমকের সঙ্গে প্রতিটি মণ্ডপের জন্য তৈরি হচ্ছে দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ, অসুর, সিংহ, হাঁস, পেঁচা, ময়ুরসহ বিভিন্ন প্রতিমা।

ঢাকার পূজা মণ্ডপগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ কারিগর রঙের পর অলঙ্কার এবং সাজসজ্জায় দেবীর পরিপূর্ণ অবয়ব ফুটিয়ে তুলছেন। কিছু মণ্ডপে রঙ আর সাজসজ্জার কাজটিই কেবল বাকি আছে। তবে শুক্রবার রাতের মধ্যেই দেবী দূর্গা তার পরিপূর্ণ সাজে হাজির হবেন মণ্ডপে। শনিবার ষষ্ঠী তিথিতে হবে দেবীর বোধন।

সারাদেশে এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে দুর্গ পূজা হবে। তার মধ্যে ২৪১টি মণ্ডপ ঢাকা মহানগরে। ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে মণ্ডপের সংখ্যা ১৫৪টি, উত্তরে ৮৭টি।

সবচেয়ে বেশি পূজামণ্ডপ পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে। সেখানে মোট ২৫টি মণ্ডপের কাজ চলছে বলে জানালেন ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতারা।

রমনা কালী মন্দিরে প্রধান কারিগর রতন পাল তৈরি করেছেন দুর্গার মূল অবয়ব। রঙসহ বাকি সাজসজ্জার কাজ করছিলেন তার সহকারী বিবেকানন্দ পাল।

গত তিন মাস ধরে প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন জানিয়ে বিবেকানন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিমা তৈরির জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম আনা হয়েছে গোপালগঞ্জ থেকে। প্রতিমার রঙের কাজ একদফা শেষ হয়েছে। এখন আরেক দফা রঙসহ সাজসজ্জা বাকি। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুর্গা মা তার অপরূপ মূর্তিতে ভক্তদের কাছে হাজির হবেন।”

গত তিন মাসে মোট ১১টি প্রতিমা তৈরি করেছেন এই শিল্পী। এর মধ্যে তিনটি বরিশালে; ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও নিলফামারীতে একটি করে এবং ঢাকার জন্য মোট পাঁচটি।

রমনা কালী মন্দিরের পূজার প্রস্তুতি জানিয়ে পূজা কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছরই জাঁকজমকপূর্ণভাবে রমনা কালী মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হয়। তবে এ বছর আমরা একটু বেশিই আড়ম্বরের সাথে উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

“কারণ দীর্ঘদিন করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা উদযাপনে উদ্দীপনা কম ছিল। এবার আমরা সেই সময়টা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। তাই এবার ভক্তদের ভিড়ও বেশি হবে।”

শাঁখারীবাজারের একটি দোকানে প্রতিমা তৈরির কাজ করছিলেন পল্টন পাল। প্রতিবছর বেশ কয়েকটি প্রতিমা তৈরির কাজ করলেও এবার শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার কারণে দুর্গা পূজার জন্য তিনটি প্রতিমা গড়েছেন তিনি।

পল্টন বললেন, “প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন কেবল মাথার মুকুটসহ দশহাতে অস্ত্রসজ্জার কাজ বাকি আছে।”

পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোড কালী ও দুর্গা মাতা মন্দির প্রাঙ্গণে চলছে বেশ কয়েকটি প্রতিমা তৈরির কাজ। সেখানে কাজ করছিলেন শিল্পী নিশি পাল। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি। এবছরও নিজ হাতে গড়েছেন ১২টি দুর্গা প্রতিমা, যেগুলোর বেশিরভাগই সময়মত চলে যাবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন মণ্ডপে।

নিশি পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিমা তৈরির কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। তবুও কিছু কাজ বাকি আছে। দুই একটা প্রতিমার রঙের কাজ বাকি। তারপর অলঙ্কার পরিয়ে দিলেই কাজ শেষ হবে।”

প্রতিমা শিল্পীদের সারা বছরের আয়ের একটি বড় উৎস দুর্গাপূজা। প্রতিটি প্রতিমা তৈরির জন্য ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক নেন তারা।

নিশি পাল জানান, এবার তার সবচেয়ে দামী প্রতিমাটি তিনি তৈরি করেছেন রংপুর জেলার একটি পূজামণ্ডপের জন্য। ওই প্রতিমার জন্য তিনি পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীদের ভিড় জমেনি। সীমিত আয়োজনে অর্চনা শেষে দেবীকে বিদায় জানাতে হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। এর মধ্যে গতবছর কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শারদীয় দুর্গোৎসবে ছায়া ফেলে যায়।

এবার কোভিড সংক্রমণকে ঘিরে সেই বিধিনিষেধ না থাকায় দর্শনার্থীদের সমাগম বেশি হবে মনে করেন ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সহ-সভাপতি এবং জাতীয় পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জ্জী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পূজা উপলক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে। শুধুমাত্র প্রতিমা তৈরির কাজ খানিকটা বাকি রয়েছে। শিল্পীরা যথাসময়ের মধ্যেই তাদের কাজটি শেষ করবেন বলে আশা করছি।”

এ বছর পূজা উপলক্ষে মন্দিরের নিরাপত্তা বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দূর্গাপূজা সার্বজনীন, মানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উৎসব। তবুও এর মধ্যে দুর্বৃত্তরা নানাভাবে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।

“গতবছরের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর এ বছর প্রশাসনিকভাবে যথেষ্ট তৎপরতার সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ ভাইয়েরা আমাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি এবার পূজায় কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে না।”