মঙ্গল কামনায় মহানবমীতে দেবী দুর্গার আরাধনা

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে পূজায় তেমন প্রভাব পড়েনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2022, 04:14 PM
Updated : 4 Oct 2022, 04:14 PM

শারদীয় দুর্গোৎসবে মহানবমী তিথিতে ষোড়শ উপচারে দেবীর বন্দনা ও মহাস্নান-যজ্ঞ, আর সন্ধ্যায় আরতি বন্দনায় আনন্দময়ীর অর্চনা করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলোতে ছিল ভিড়। পৃথিবীর দুঃখ-দুর্দশা ঘুচে আগামী দিনগুলোতে শান্তির কামনায় দেবী দুর্গতিনাশিনীর সামনে করজোড়ে প্রার্থনা করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

এ দিন দুপুর ২টা ৪ মিনিটে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে ত্রুটির কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ দেশের অর্ধেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে যায়। তবে তাতে পূজা উদযাপনে ছেদ পড়েনি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "বিভিন্ন এলাকার পূজা উদযাপন কমিটির সাথে আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করে জানতে পেরেছি, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। জেনারেটরের মাধ্যমে মণ্ডপগুলোতে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।"

রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সন্ধ্যায় আরতি প্রতিযোগিতার সময় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মন্দির-মণ্ডপগুলোতে কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হয় নবমীর আনুষ্ঠানিকতা।

দুপুরে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুই মেয়েকে নিয়ে পূজা করতে এসেছিলেন সত্যজিৎ কর। এ বছর মার্চ মাসে হারিয়েছেন মাকে। মায়ের আত্মার সৎগতি কামনা করে প্রার্থনা করেছেন দেবী দুর্গার কাছে।

সত্যজিৎ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবছর পূজার আমেজ তেমন নেই আমাদের। তবুও মেয়েদের নিয়ে এসেছি দেবী দুর্গার দর্শনে। দেবী মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছি- আমার মায়ের জন্য।"

সত্যজিৎ করের মেয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী পূজা কর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমাদের পরিবারের মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছি। মা আমাদের সব কষ্ট কমিয়ে দেবেন।"

মন্দির প্রাঙ্গনে বিকাল থেকেই ছিল ভক্ত ও দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়৷  অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন সন্ধ্যা আরতির।

মন্দিরে আসা শ্রাবণ কুমার নাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্ধ্যা আরতির জন্য অপেক্ষা করছি। প্রতিবছর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখার মতো সুন্দর হয়।”

এ বছর দেবী দুর্গার কাছে কী প্রার্থনা করেছেন, তার জবাবে শ্রাবণ বলেন, "নিজের জন্য তো কতকিছুই চেয়েছি! পাশাপাশি পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসুক, সবাই আনন্দের সাথে সামনের দিনগুলো কাটাক- এই আশাই করেছি মায়ের কাছে।"

প্রতিবছর দুর্গোৎসবে রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকার মণ্ডপগুলো সরগরম হয়ে উঠে দর্শনার্থীদের ভিড়ে। এবছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

নবমীর দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভিড় কিছুটা কম থাকলেও দুপুরের পর থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে তাঁতীবাজার থেকে শাঁখারিবাজারের অলিগলি আর পূজামণ্ডপগুলো। পূজাকে কেন্দ্র করে অলগলির ছোট ছোট দোকানগুলোও জমজমাট হয়ে উঠতে দেখা যায়। তবে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার পর ওই এলাকার কয়েকটি মণ্ডপে জনাসমাগম কমে যায়।

শাঁখারীবাজারের একটি পূজামণ্ডপে পূজা করতে এসেছেন এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী নিশি সাহা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি স্কুল থেকে এবার পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি।

নিশি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "পরীক্ষা বেশ ভালোই দিয়েছি৷ পরীক্ষার পর ঢাকায় মামার বাড়িতে চলে এসেছি ঢাকার পূজা দেখার জন্য। মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছি যেন পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হয়।"

গত দুবছর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে উৎসব সেভাবে না জমলেও এবার দুর্গা পূজা বেশ উপভোগ করছেন বলে জানান নিশি।

এবছর ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এখনও পর্যন্ত পূজা চলাকালীন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি৷ এবার সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবেই পূজা উদযাপিত হয়েছে৷ ঢাকা মহানগরেও বেশ সুশৃঙ্খলভাবে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়েছে।

“এবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও নিরাপত্তার ব্যাপারে বেশ তৎপর ছিল। আশা করছি আগামীকাল বিজয়া দশমীর প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত সবকিছু সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে।"

দুইবছর করোনাভাইরাস মহামারীর বিধিনিষেধের পর এবছর প্রতিটি মণ্ডপে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে বলে জানান পূজা উদযাপন পরিষদের এই নেতা।

গত বছরের চেয়ে এবার বেড়েছে মণ্ডপের সংখ্যাও। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে দেবীবন্দনায় মেতেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। পূজা উদযাপন পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এবার প্রায় ৩২ হাজার ১৬৮ মণ্ডপে দুর্গা পূজা হচ্ছে। এই সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৫০টি বেশি। ঢাকা মহানগরে এবার পূজা হবে ২৪১টি মণ্ডপে, যা গতবারের চেয়ে ৬টি বেশি। গতবার সারাদেশে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১১৮টি।

হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ সারাদেশের মন্দিরে-মণ্ডপে গত ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়া তিথির মাধ্যমে শুরু হয়েছে এ উৎসবের আচার- আনুষ্ঠানিকতা।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।

রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত।

শাস্ত্র বলছে, মহাসপ্তমীর দিন রোববার হওয়ায় এবার দেবী দুর্গা এসেছেন হাতিতে।

শাস্ত্রমতে গজ দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। তাই দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে; পূর্ণ হয় ভক্তদের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্তলোকের অধিবাসীগণ। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ হয়।

বুধবার বিজয়া দশমীতে মা দুর্গা পুত্র-কন্যা সহ কৈলাশে ফিরবেন নৌকায় চেপে।

শাস্ত্রমতে, সপ্তমী বা দশমী বুধবার হলে দেবীর আসা বা যাওয়া হয় নৌকায়। তাতে ফল শস্য বুদ্ধিস্তথাজলম অর্থাৎ প্রবল বন্যা ও খরা দেখা যায়। তবে নৌকায় মনোকামনা পূর্ণ হওয়াও সূচিত হয়; ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা যায়।